অরাজ
আর্টওয়ার্ক: ইনটেলেকচুয়াল টেররিজম শিল্পী: নাোয়ার খলিল সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট
প্রচ্ছদ » মতাদর্শ নয়– পথ

মতাদর্শ নয়– পথ

  • সেলিম রেজা নিউটন

মতাদর্শের চক্করে বাংলাদেশ

অন্ধ-বিশ্বাস আর অন্ধ-অবিশ্বাসের চক্করে পড়েছে বাংলাদেশ। নতুন করে। এর কারণ মতাদর্শের মোহ। মুক্তচিন্তা, মুক্ত-পর্যালোচনা এবং মুক্তপ্রকাশের পথে বিপুল বিক্রমে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল, নানা প্রকার ধর্ম-রাজনৈতিক গোষ্ঠী, এবং তাদের প্রতি অন্ধ আনুগত্যপ্রবণ নানান মহল। সব গোষ্ঠীই নিজের নিজের একটা করে অভ্রান্ত মতাদর্শ দাঁড় করিয়ে বাকি সবাইকে আদর্শ-বহির্ভূত জ্ঞান করছে – রাষ্ট্রের নামে, ধর্মের নামে, মুক্তিযুদ্ধের নামে, নানাবিধ জাতীয়তাবাদের নামে। এমনকি আমাদের বহু সাধের, অনেক স্বপ্নের প্রজন্ম-চত্ত্বরও আস্তে-ধীরে আটকে পড়েছে মতাদর্শের জলাবদ্ধতায়। তার মতাদর্শ হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় বলপ্রয়োগ। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সম্প্রতি এলোমেলো করে লিখে রাখা কিছু কথা, চিন্তার কিছু টুকরা এক জায়গায় জড়ো করে রাখা দরকার বলে মনে হচ্ছে।

মতাদর্শের মোহ

মতাদর্শের নাম আপনি যা-ই দেন না কেন, ওটা আসলে কোনো না কোনো প্রকারের কর্তৃত্বতন্ত্রই বটে। কোনো মতাদর্শই মনে করে না যে মানুষ নিজেই নিজেদেরকে পরিচালনা করতে পারে। কোনো মতাদর্শই মনে করে না স্ব-অধীনতা, স্বাধীনতা, স্বশাসন বা ব্যক্তি-সামাজিক আত্মকর্তৃত্ব দিয়ে সমাজ-সম্প্রদায় ভালোভাবে চলতে পারে। মতাদর্শের জন্য তাই দরকার পড়ে মহান রাখাল। মতাদর্শিক রাখালতন্ত্র মানব-সমাজকে স্রেফ একটা ভেড়ার পাল বলে গণ্য করে। আপনার মহান মতাদর্শের নাম আপনি দিতে পারেন গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ধর্মতন্ত্র মঙ্গলতন্ত্র কল্যাণতন্ত্র কিংবা বিজ্ঞানতন্ত্র। আপনার যা খুশি। আপনার যেমন দরকার তেমন। কিন্তু ঘটনা হলো, আপনি আসলে ঐ মতাদর্শের ‘শুদ্ধতার’ জোরে বসতে চাচ্ছেন ক্ষমতায়। আপনি চাচ্ছেন ঐ মহাশুদ্ধ মতাদর্শটির ‘সঠিক’ বা ‘বৈজ্ঞানিক’ বাস্তবায়ন। এবং আপনার বিশ্বাস, সিংহাসনে আরোহন না করে কোনো প্রকার কল্যাণতন্ত্রই আপনি প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না। শাসক ছাড়া তাই মতাদর্শ নাই। এরই নাম শাসনতন্ত্র। এরই নাম বলপ্রয়োগতন্ত্র। এরই নাম মতাদর্শতন্ত্র।

মতাদর্শের জন্য লাগে ট্রেনিং। ট্রেনিং আমাদের পিছু ছাড়ে না। অসীম শক্তি-সম্ভাবনাময় মনুষ্যসন্তানকে বনসাই করে রাখার চেষ্টা বহু কালের। গুটিকয় মানুষের হুকুম মোতাবেক গোটা একটা কওম-কমিউনিটি-রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। কোটি কোটি লোক নিজেরাই ভাববেন যে তাঁরা নিজেরা নিতান্ত অযোগ্য, অক্ষম। তাঁরা ছোট মানুষ। তাঁদের কাজ হলো স্রেফ যোগ্য নেতাটাকে খুঁজে বের করা। সেই নেতার বন্দনামূলক পালা-কীর্তন রচনা করা। আর নেতা-হুজুর-বিশেষজ্ঞ-বসের হুকুমতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। কেননা তাতেই মঙ্গল। তাতেই কল্যাণ। দাসত্বেই শৃঙ্খলা। দাসত্বেই মুক্তি।

বন্দুকের জোর ছাড়া গুটিকয়ের শাসনতন্ত্র পরিচালনার কোনো উপায় নেই ঠিকই, কিন্তু এই যে কোটি কোটি মানুষ, অসীমের আত্মার আলো বুকে করে জন্মানো অগণন মানুষ – এঁরা যদি নিজেরাই নিজেদেরকে অক্ষম ভেবে কুঁই কুঁই না করে, তাহলে স্রেফ বন্দুক দিয়ে তো আর এই জনসমুদ্রকে পুকুর বানানোর কোনো বুদ্ধি নাই! মানুষ নিজেই নিজেকে গুটিকয় ‘উন্নত’ মানুষের তুলনায় ‘বানর’ বলে ভাববে – তা তো আর আপনাআপনি সম্ভব না! তারই জন্য লাগে বিস্তারিত ট্রেনিং। আজন্ম-আমৃত্যু প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ-দীক্ষায়ন-অনুসরণ। যাবতীয় নেতাতন্ত্র, হুজুরতন্ত্র, হুকুমতন্ত্র টিকে থাকার জন্য তাই কমপক্ষে দুইটা জিনিস লাগে। এক হচ্ছে বন্দুক-বলপ্রয়োগ। আরেক হচ্ছে শাস্ত্র-দীক্ষায়ন-প্রশিক্ষণ। একদিকে চড়-থাপ্পড়-জেল-জুলুম-খুনখারাবি। অন্য দিকে আদর-সোহাগ-শাস্ত্র-মন্ত্র আর জুজুবুড়ির ভয়। ছোট বেলা থেকে আমরা না জেনে না বুঝেই এগুলো শিখে আসি। এই শিক্ষা অব্যর্থ। এই শিক্ষা অবিরাম। কর্তাতন্ত্র মোক্ষম।

যখন আমরা আমাদের জাতিগোষ্ঠীশ্রেণীগত ও ব্যক্তিগত মুক্তির কথা ভাবি তখনও তাই আমরা আজন্ম ট্রেনিঙের আছর থেকে মুক্ত হওয়ার কথা ভাবি না। ট্রেনিংটা যে আদৌ ট্রেনিং তা তো আমরা খেয়ালও করি না। প্রশ্নাতীত প্রশিক্ষণ মোতাবেক আমাদের কাছে তাই ন্যায়বিচার মানে প্রতিশোধ। তুমি আমার ভাইকে মেরেছ। আমি অথবা আমার গোষ্ঠী অথবা আমাদের সুমহান আইনের শাসন তোমাকে মারবে। আমাদের কাছে তাই যুদ্ধ মানেই শান্তি। যুদ্ধে ‘ভয়াবহ’ সব শত্রুদেরকে চির-পরাস্ত না করলে তো শান্তি আসবে না দেশে। ‘লাল কমিউনিস্ট’দেরকে সমূলে বিনষ্ট করতে না পারলে গোটা পশ্চিমা সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে। ‘ইসলামী সন্ত্রাসবাদী’দেরকে চিরতরে বিধ্বস্ত করতে না পারলে মনুষ্য-সভ্যতা বলে কিছু থাকবে না পৃথিবীতে। কিংবা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তিকে ফাঁসিকাঠে না ঝোলালে বাংলাদেশ বলে কিছু থাকবে না আর। এটা পাকিস্তান হয়ে যাবে (যদিও পাকিস্তান নিজেই ইদানীং ‘পাকিস্তান’ হিসেবে টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে। আবার ভারতের দালাল ও নাপাক-নাস্তিক ‘আওয়ামী’ শক্তিকে এই দেশ থেকে চিরতরে উৎপাটন না করলে বাংলাদেশ পরিণত হবে ভারতের অঙ্গরাজ্যে।

আর্টওয়ার্ক: আইডিওলজি
শিল্পী: ভ্লাদেমির কাজানেভস্কি
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

মতাদর্শ আদতে ভ্রান্তচেতনা। মিথ্যা চেতনা। ফল্‌স‌্‌ কনশাসনেস। কিন্তু শাসকবৃন্দের দিক থেকে হিংসাকে জায়েজ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে অভ্রান্ত মতাদর্শের দোহাই। সঠিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার দোহাই। নির্মূল-বিনাশ-উৎপাটন ও হিংসাই কর্তাতন্ত্রের প্রাণভোমরা। এর এক নম্বর কথা হচ্ছে অসৎ, অযোগ্য, বেদ্বীন, প্রতিবিপ্লবী, মৌলবাদী কর্তা-নেতা-হুজুরদেরকে ধ্বংস করে দিয়ে ‘আমাদের’ (অর্থাৎ সঠিক) মানদণ্ড মোতাবেক সৎ, যোগ্য, ধর্মপরায়ণ, বিপ্লবী ও প্রগতিশীল মুক্তিযুদ্ধের বা তৌহিদী জনতার সপক্ষের কর্তা-নেতা-হুজুরতন্ত্রকে ক্ষমতায় বসানো।

এই খায়েশ এমনকি আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের ভেতরেও ছিল। আশৈশব দীক্ষায়নের এই টনটনে ট্রেনিং আদি ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা-তন্ত্রের মধ্যেও ছিল। মার্কস-এঙ্গেলসদের মধ্যেও ছিল। এই ট্রেনিংতন্ত্র মানুষের ইনবিল্ট-বিচারবুদ্ধির ওপর আস্থা রাখে না। বরং মানুষের অন্তর্জাত-সহজাত বিবেক-বুদ্ধির বিশ্লেষণী ক্ষমতাকেই তার সবচে বড় ভয়। মতাদর্শ চায় মানুষ শিখুক মুখস্ত ভালোমন্দ। মতাদর্শ চায় মানুষ শুধু অনুকরণ করুক। অনুসরণ করুক। ঠেকে না শিখুক। ভুল করতে করতে না শিখুক। শুধু মেনে চলুক। অভ্রান্ত মতাদর্শের প্রশ্নাতীত শিক্ষাকে চিরকাল অভ্রান্ত মনে করুক। মানুষের কাজ দাসত্ব করা। পুঁজে ভরা পুঁজি-প্রশিক্ষণের দাসত্ব অথবা দাম্ভিক বিজ্ঞানীর ‘দাস ক্যাপিটাল’-এর দাসত্ব।

মতাদর্শ সবসময়ই মানুষের চেয়ে বড় মনে করে নিজেকে। ‘মানুষ’ বলতে মতাদর্শ কখনো তাজা, রক্তমাংশের ব্যক্তি-মানুষকে বোঝে না। ‘মানুষ’ বলতে মতাদর্শ বোঝে একটা বিমূর্ত ধারণাকে। কারণটা হলো: এই মুহূর্তে প্রাণবন্ত মানুষকে খুন না করে, তার ওপর দমনপীড়ন জোর-জবরদস্তি না করে, কোনো মতাদর্শই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। মতাদর্শ এসব জেলজুলুম-খুনখারাবি করে বিমূর্ত ভবিষ্যতের ‘শুভ ও সুন্দর মানবসমাজ’ প্রতিষ্ঠার নামে। আসলে যা সে করে তা হলো মতাদর্শের পুরুৎঠাকুরদেরকে শাসনক্ষমতায় বসানো। এই পুরুৎঠাকুর হতে পারেন বলশেভিক প্রতিবিপ্লবের মহামতি লেনিন-ট্রটস্কি-স্টালিনরা। এই পুরুৎঠাকুর হতে পারেন জেহাদি ইসলামের বিন-লাদেন বা আল-জাওয়াহিরিবৃন্দ। এই পুরুৎ-ঠাকুর হতে পারেন সেকুলার বিজ্ঞানতন্ত্রের অভ্রান্ত বৈজ্ঞানিকবৃন্দ কিংবা গণতান্ত্রিক মালিক-শাসকপক্ষও। মতাদর্শ মানে তাই মারাত্মক মতিভ্রম। মতাদর্শ মানে তাই মুক্তিবিনাশী মোহ।

গুরু-গোঁসাই-গ্রন্থ এবং গুপ্তজ্ঞান প্রসঙ্গে

যেকোনো পাঠের একাধিক অর্থ থাকবেই। অর্থ নির্ভর করে বক্তার ওপরে নয়, শ্রোতার ওপর। কোনো গ্রন্থই এর ব্যতিক্রম নয়। মানুষের বিচার-বুদ্ধি-বিবেক-বিবেচনা দিয়েই মানুষকে তার জীবন ও জগৎ সম্পর্কে উপলব্ধি করতে হয়। কোনো টেক্সটেরই কোনো অনড় অর্থের দোহাই দেওয়ার মানে হয় না। জীবন-জগৎ অনড় নয়। সদাপরিবর্তনশীল। মানুষ তো মানুষ, অন্য প্রাণীরাও কোনো অনড় যান্ত্রিক শৃঙ্খল মেনে লেফটরাইট করে জীবনযাপন করতে পারে না। পশুপাখির জিন পর্যন্ত বদলায়। জিনের মিউটেশন হয়। জড় তো বদলায়ই।

একটা মাত্র গ্রন্থ দিয়ে পৃথিবীর তাবৎ কিছুকে ব্যাখ্যা করতে পারার দাবি কোনো মহাগ্রন্থই নিজে করে না। আমাদের লাগে অজস্র গ্রন্থ। অজস্র পাঠ। মানুষের জন্য শেষ বলে কিছু নেই। প্রশ্ন-জিজ্ঞাসা-কৌতূহল-অনুসন্ধান ইত্যাদি প্রভৃতি সব বেতাল জিনিসপত্র দিয়েই মানুষ গড়া। মানুষের এই গড়নকে অস্বীকার করার মানে হয় না। সুতরাং ভালোবাসা-সহিষ্ণুতা-উদারতা-স্বাধীনতা-সংহতি-সৃজনশীলতা জাতীয় প্রাথমিকতম মানবিক মূল্যবোধগুলোর ওপর আস্থা রাখার চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।

সত্য এক, কিন্তু তার প্রকাশ সীমাহীন ধরনের বিচিত্র। এটাই সত্যের স্বরূপ। জগৎ একশিলা বা মনোলিথিক জিনিস নয়। বিচিত্র বিষয়ে ভরা। এটাই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সত্য। যিনি নিজে সত্য, সত্য শুধু তিনিই জানেন। কিন্তু কোনো এক বা একাধিক জনের জানাটাকেই ‘চূড়ান্ত সত্য’ বলে দাবি করতে গেলে জবরদস্তি আসে। জোর-জবরদস্তি করে মঙ্গল হয় না।

সত্যের কোনো সদাপ্রস্তুত ম্যানুয়াল নাই; রেডিমেড দণ্ডবিধি নাই। প্রত্যেককে তাঁর নিজের মতো করে আপন আপন জীবন-জগত-সমাজের সত্য উপলব্ধি করতে হয়। কোনো গুরু-গোঁসাই-গ্রন্থই কাউকে পূর্বনির্ধারিত কোনো সদা-সত্য-উপলব্ধি গিলিয়ে দিতে পারে না। আমি কোনো গোপন গুরুতন্ত্রে বিশ্বাস করি না। ‘গুরু’ কোনো আগাম-নির্দিষ্ট বা আমলাতান্ত্রিক বা কর্তৃত্বক্রমতান্ত্রিক পদ হতে পারে না। মানুষের অজস্র শিক্ষক থাকেন, গুরু থাকেন। মানুষ মানুষের কাছ থেকে শেখে। প্রকৃতি-জীবজন্তু থেকে শেখে। যা দেখা যায় না তা থেকেও শেখে।

আর্টোয়ার্ক: ফর ইয়োর থটস
শিল্পী: সুরেন্দ্র রাসাদুরাই
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

শিক্ষার সার্থকতা আমলে-অনুশীলনে-চর্চায়। ‘আপনি আচরি ধর্ম অপরে শেখাও’-এর চেয়ে ভালো কোনো পদ্ধতি আছে বলে মনে হয় না (দ্রষ্টব্য: কৃষ্ণদাস কবিরাজ কর্তৃক বিরচিত ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’)। এ হচ্ছে শেখার এবং শেখানোর মুক্তিপরায়ণ তত্ত্ব। মুক্তিপরায়ণ শিক্ষাতত্ত্ব। শিক্ষার সার্থকতা শেয়ারিঙে। যত বেশি শেয়ারিং করা যায় ততই মঙ্গল। আমি আপনার কাছ থেকে শিখি। আপনি আমার কাছ থেকে শেখেন। বোঝাপড়া-শিক্ষা-উপলব্ধি একমুখী রাস্তা নয়। কিন্তু গুরুতন্ত্র একমুখী কর্তৃত্ব দাবি করে। এই দাবি প্রতিষ্ঠা পায় গোপন জ্ঞানের (গুপ্তধনের মতো গুপ্তজ্ঞানের) একচ্ছত্র মালিকানার ওপর।

সংগুপ্ত সত্যের, গুপ্তজ্ঞানের তত্ত্বে আমি বিশ্বাস করি না। সত্যকে গোপন রাখার কোনো মঙ্গলজনক যুক্তি আমার কাছে নাই। যা আমি ভালো বলে উপলব্ধি করেছি তার প্রকাশ্য অনুশীলনই আমার কাম্য। তার জন্য মূল্য দিতেও আমি প্রস্তুত। আবার, যাহা সংগুপ্ত তাহাই তো প্রকাশ্য। কে কীভাবে দেখছেন তার ওপর নির্ভর করে মাত্র। শাসনতান্ত্রিক/আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দিক থেকে দেখলে দেখা যায়, নানা ধরনের সত্যকে সিক্রেসি দিয়ে ঢেকে রাখে শাসকরা (দ্রষ্টব্য জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ, ২০০৬)। সিক্রেসি ছাড়া শাসন-তন্ত্র চলতে পারে না। কথিত ‘গণতান্ত্রিক’ শাসকদেরকে তো গোপনীয়তার সাংবিধানিক শপথ পর্যন্ত নিতে হয়। গুরুতন্ত্র তাই শাসনতন্ত্রই বটে।

গুরুতন্ত্রের গুরু আসলে কর্তৃত্বতন্ত্রের একচ্ছত্র কর্তা। (গুরুর ধারণা আদিতে একেবারেই আলাদা ছিল বলে আমার ধারণা। সেটা ছিল মাতৃতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটের সামাজিক ঘটনা। পরে এর মধ্যে পুরুষতন্ত্র এবং কর্তৃত্বতন্ত্র বাসা বেঁধেছে। এসব নিয়ে আরেক দিন কথা বলা যাবে।) গুরুতন্ত্র কায়েম করে গোপনীয়তাভিত্তিক কর্তৃত্বতন্ত্র। গোপনীয়তা বলতে এখানে ‘সিক্রেসি’ বোঝাচ্ছি, ‘প্রাইভেসি’ নয়। দ্রষ্টব্য: বর্তমান লেখকের ‘প্রাইভেসি কী বস্তু’)। আদি, আসল ও সহি সত্যের মালিকানা দাবি করে গুরুতন্ত্র, যাজকতন্ত্র, পুরোহিততন্ত্র, প্রফেসরতন্ত্র, মোল্লাতন্ত্র, রাষ্ট্রতন্ত্র এবং যাবতীয় কর্তৃত্বতন্ত্র। এরকম মালিকানা দিয়ে মানুষকে চিন্তাদাসই বানানো যায় বড় জোর। গুরু ছাড়া, কর্তা ছাড়া, মালিক ছাড়া দাসতন্ত্র দাঁড়ায় না। আবার, দাস ছাড়া, গোলাম ছাড়া, আবাল-অনুগত অনুচর ছাড়া গুরুতন্ত্র-কর্তৃত্বতন্ত্র-মালিকতন্ত্র টেকে না। এ এক পরস্পরনির্ভর বা মিথোজীবিতাকেন্দ্রিক দ্বিমুখী প্রক্রিয়া: ‘গোলাম মালিক খোঁজে, মালিক গোলাম’ (কবীর সুমনের গান)।

আলাপ-আলোচনার ধারা যদি উন্মুক্ত হয়, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, সত্যের একচ্ছত্র মালিকানা দাবি করার দিকে ঝুঁকে না পড়ে, তাহলে যার যা বোঝার সেটুকু বুঝে নেওয়ার মতো অবকাশ তৈরি হয়। আমি যা বলি তা আমারই উপলব্ধি মাত্র। আমারই সত্য মাত্র। কিন্তু এই উপলব্ধিকে আমি সহি সত্য বলে, বা একমাত্র সত্য বলে দাবি করি না। যত কাল্লা তত আল্লা। যাঁরা একমাত্র সত্য বা চূড়ান্ত সত্য জানেন বলে দাবি করেন, তাঁরাই ‘সত্যহীন’দেরকে শাসন করার, পরিচালনা করার ‘যোগ্যতা’ অর্জন করেন। তাঁরা লেনিনবাদী-লাদেনবাদী-লিবারালবাদী। আমার সংশয় হয়: আর যা-ই হোক, সত্য নিয়ে কারবার তাঁদের নয়। আমি অরাজপন্থার মানুষ। অরাজ আমার পন্থা; স্বরাজ আমার স্বভাব। আমি কাউকে পরিচালনা করি না, আমাকে পরিচালনা করার সুযোগও কাউকে দিতে চাই না। অন্যের কাছ থেকে নিরন্তর শিখি। আগ বাড়িয়ে শেখাতে যাই না। বাধ্যতামূলক কোনো শিক্ষাও গ্রহণ করি না অন্তরে।

তর্কবিতর্ক-পর্যালোচনার পদ্ধতি প্রসঙ্গে

কারো কারো কথায় অস্পষ্ট একটা ধারণা আমার মনে জন্মায়: গুরুতন্ত্র সম্পর্কে যাঁর সংশয় আছে তিনি আবার গুরু নিয়ে বা গুরুতন্ত্র নিয়ে আদৌ কথা তোলেন কোন যুক্তিতে? প্রশ্নকর্তা যেন কোনো অসঙ্গতির দিকে আঙুল তুলছেন বলে মনে হয়। যেন তিনি বলতে চাইছেন, যিনি নিজে বিবাহ করেছেন, তিনি আবার বিবাহ নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মুশকিল নিয়ে কথা বলেন কীভাবে? আলোচ্য বিবাহিত ব্যক্তিটি যেন এক প্রকার সুবিধাবাদী অবস্থান নিচ্ছেন এক্ষেত্রে।

এই ধারার সমালোচনা বা প্রশ্নের পেছনকার যুক্তিবোধ আমার কাছে স্পষ্ট হয় না। পরিবারপ্রথার সমস্যা নিয়ে কথা তুলতে গেলে আমাকে পরিবারবহির্ভূত হয়ে জন্মগ্রহণ করতে হবে? কেন্দ্রীভূত কর্তৃপক্ষ (যথা বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামো বা রাজনৈতিক দল) আমি পছন্দ করি না বলে এসব বস্তু নিয়ে কিছু বলাই যাবে না? রাষ্ট্রের বাইরে গিয়ে কথা বলতে হবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা প্রণালীর সমস্যা নিয়ে কথা বলা যাবে না? তার জন্য এই প্রশ্ন উঠবে যে: নিজে ঠিকই বিশ্ববিদ্যালয়-অধ্যাপনার সব সুযোগসুবিধা নিয়ে আবার বিশ্ববিদ্যালয়েরই বদনাম করা হচ্ছে? আবার, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নন, তিনি বিদ্যমান কর্তৃত্বপরায়ণ অধ্যাপনাতন্ত্র তথা বিদ্যা-বুরোক্র্যাসি নিয়ে কথা তুললে হয়ত বলা হবে, যিনি নিজে অধ্যাপক নন তিনি অধ্যাপনাতন্ত্রের ভালোমন্দ নিয়ে কী বোঝেন? এই সব প্রশ্ন-সমালোচনা বিদ্রুপ আসলে চিন্তার ও পর্যালোচনার মুক্ত-প্রকাশের পথে অন্তরায় মাত্র। প্রশ্ন-পর্যালোচনা চিন্তাভাবনার কোনো পূর্বশর্ত থাকতে পারে বলে আমার মনে হয় না।

আর্টওয়ার্ক: এ সোসাইটি এন্ড ডিজএবিলিটি
শিল্পী: ভ্লাদেমির কাজানেভস্কি
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

আরেকটা মুশকিলও খেয়াল করছি। কোনো সামাজিক প্রপঞ্চ নিয়ে জিজ্ঞাসা-কৌতূহল-পর্যালোচনা হাজির করলে অনেকে প্রায় ধরেই নেন পর্যালোচক ঐ প্রপঞ্চটিকে ‘মানেন না’। রাষ্ট্র নিয়ে কথা তোলা মানে আমি রাষ্ট্র মানি না। এর চেয়ে আজগুবি দৃষ্টিভঙ্গির কথা অনুমান করাও কঠিন। মানা বা না মানার তো প্রকৃত কোনো পর্যালোচনার বিষয়ই হতে পারে না। আমি আমার বিশ্বাসের কথা আমার ধারণার কথাটুকুই বলতে পারি মাত্র। সেটা কতটুকু ঠিক তা বাস্তব পরিস্থিতি-পরীক্ষণ-প্রয়োগ থেকেই আন্দাজ করা যেতে পারে মাত্র। ‘মানি না’ বললে অপ্রয়োজনীয় ধরনের মুখোমুখি একটা অবস্থা দাঁড়ানোর সুযোগ তো থাকেই, উপরন্তু সুযোগটা আমিই দিয়েছি বলে ভাবার অবকাশ থাকে। আমি আসলে সেটা চাই না।

আমি ঠিক তর্কবিতর্ক করতে চাই না। ‘মানি না’ বললে কেমন প্রতিবাদ প্রতিবাদ শোনায়। ইদানীং আমি আর বিবাদী-প্রতিবাদী হতে চাই না। স্রেফ বাদী হতে চাই। ইতির ওপর জোর দিতে চাই। নেগেটিভ এনার্জি খরচ করতে চাই না। এতে করে আমার মনের শান্তি অক্ষুণ্ণ থাকে। বিবাদ-প্রতিবাদ করতে গেলে আমার অস্থির লাগে। ভালো লাগে না। নিজের বেলায় আমার মনে হয়, নিজের কথাটুকু যুক্তি-ব্যাখ্যা-প্রসঙ্গসহকারে বললেই তো হয়, অন্যের মতের প্রতিবাদ করার, কিংবা অন্যের মতের অসারতা প্রতিপন্ন করার কী দরকার আমার। আমি যদি কারো মতের প্রতিবাদ করতে চাই, কাউকে অসার প্রতিপন্ন করতে চাই, তাহলে তাঁকেও আমার মতটার প্রতিবাদ করতে, আমাকে অসার প্রতিপন্ন করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তখন ক্যাচাল বাধে। ভালো লাগে না। ইদানিং আমি তাই নির্দিষ্ট কারো কোনো কথা ধরে কোনো আপত্তি তুলতে চাই না। আমার নিজের কথাটুকু জানিয়ে রাখি শুধু। আর অন্যেরা আমার কথা যদি কিছু বুঝে না থাকেন, এবং সেটা যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমি শুধু সেটুকুর একটু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতে পারি। ব্যস্। আর কিছু না।

আরেকটু ভেঙে বলা যাক। অন্যের সাথে আমার যা মেলে না তা নিয়ে এখন আমার আগ্রহ কাজ করে না। (যদিও সবসময়ই ভিন্নমতগুলোকে আমি নিজের মতো করে ধৈর্য নিয়ে বুঝতে চাই। ভালো করে বুঝতে চাই। ভাবি, আলাদা আলাদা মত তো থাকবেই। কোনো মানুষ নিজের মতামত নিয়ে খোলা মনে চিন্তার করার মতো মানুষ হলে তাঁর যা বোঝার তা ঠিকই বুঝে নেবেন। খুঁজে নেবেন। তবে যদি এমন হয় যে অমিলের জায়গাটা আমার মধ্যে প্রশ্ন বা কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে, তাহলে আমি তাতে আগ্রহী হয়ে উঠি। সে ক্ষেত্রে নিজেই ভাবি। খুঁজি। যদি দেখি যাঁর সাথে অমিল, তিনি কমবেশি খোলা মনের মানুষ, তাহলে তাঁকে প্রশ্ন করে করে আরো ভালো করে তাঁর ভিন্নমতটা বুঝে নিতে চাই। কিন্তু তাঁর সাথে তর্কে যাই না। যেতে চাই না। না যাওয়ার চেষ্টা করি অন্তত। সবসময় সফল হই না, বলা বাহুল্য। এ রকম অসফলতা আমার মনে অশান্তি সৃষ্টি করে।

আবার, অন্যের সাথে যা আমার মেলে তা নিয়ে আমি স্বস্তি পাই, যদি তিনি আমার বিবেচনায় যুক্তিশীল-বুঝদার-খোলামনা হয়ে থাকেন। তখন আগ্রহও পাই। ভাবি এ ব্যাপারে আরো কিছু জানাবোঝার সুযোগ হবে হয়ত। এক সাথে কাজ করার আনন্দ পাওয়ার অবকাশও তৈরি হবে হয়ত। এমনকি তাঁর মিথ্যা-মিথ্যা ‘প্রতিপক্ষ’ সেজে প্রশ্ন করে করে তাঁর মতটার পক্ষের (মানে এ ক্ষেত্রে আমারই মতের পক্ষের) যুক্তিগুলোকে আরো ঝালাই করে নেওয়া যাবে হয়ত। কিন্তু যাঁর সাথে আমার মিলল, তিনি যদি সেরকম মুক্তমনা মানুষ না হন বলে আন্দাজ করি, তাহলে অস্বস্তি হয়, বিব্রত বোধ করি, কথা বাড়াই না।

অনেকে আমাকে অনেক দিন থেকেই জানেন। তাঁরা বুঝবেন: আমার এসব উপলব্ধি খুব বেশি দিনের না। অতীতে আমি তর্কপ্রিয় ছিলাম। নানা জনের সাথে তর্ক করেছি। তুমুল তর্ক। শেষে দেখেছি ভালো লাগে না। মলিন হয় মন। মলিন মানে মলে আচ্ছন্ন। ভালো লাগে না সত্যি। ইত্যাকার অভিজ্ঞতা থেকে আমি এসব নিয়ে নতুন করে ভেবেছি। নতুন করে শিখেছি মনে হয়।

মতাদর্শের মোহ নয়, মুক্তিমুখীন পথ

মতাদর্শ এমন এক মহান ঘটনা, যা দিয়ে আপনি যেকোনো প্রতিপক্ষকে অবৈধ-অসিদ্ধ-অমতাদর্শিক প্রতিপন্ন করতে পারবেন। এ দিয়ে আপনি প্রতিপক্ষের ভালো কাজকেও নাপাক নাজায়েজ বলে চালিয়ে দিতে পারবেন। প্রতিপক্ষকে প্রয়োজন মতো আপনি রাষ্ট্রদ্রোহী, দেশদ্রোহী, ধর্মদ্রোহী, গণতন্ত্রবিরোধী, সমাজবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত করতে পারবেন। তারপর সেই উপাধির সম্মান রক্ষার জন্য আপনি এমনকি, আপনার সাধ্যমতো, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যেকোনো ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারবেন। মতাদর্শ এমন এক মহান ঘটনা, যা দিয়ে আপনি নিজের যেকোনো কাজকে বিধিসিদ্ধ বা জায়েজ বলে চালিয়ে দিতে পারবেন। আপনার লাগবে শুধু একটা বলপ্রয়োগকারী বাহিনী, একপাল স্তাবক-বুদ্ধিজীবী, আর প্রচারণামাধ্যম।

সাধারণ যুক্তিবুদ্ধি, ইনবিল্ট-বিবেকবৃুদ্ধি, কিংবা তথ্যভিত্তিক ও অনুমান-পর্যবেক্ষণ-বিশ্লেষণজাত বিচার-বিবেচনা নিতান্তই অবান্তর হয়ে পড়ে মতাদর্শের সামনে। সে দোহাই শুধু শাস্ত্রের। ধর্মগ্রন্থের। আইনের। সংবিধানের। মৃত অক্ষরের। ধর্মগ্রন্থ বা আইনসংহিতার অন্তর্ভুক্ত অক্ষরের স্বাধীন ও জীবন্ত পাঠ-অর্থ-ব্যাখ্যা তার জন্য বিভীষিকা। কার্ল মার্কসের বই পড়ে কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডিয়াম যে অর্থ নির্ধারণ করবে সেটাই হবে একমাত্র আদর্শ অর্থ, অর্থাৎ অনুকরণীয় অর্থ। এভাবে আজকের প্রেসিডিয়াম, পলিটব্যুরো, মজলিশে শুরা হয়ে উঠতে থাকে মধ্যযুগের চার্চ। যাজকতন্ত্র-হুজুরতন্ত্র-নেতাতন্ত্রই হয় মতাদর্শের মুরুব্বি। বাকিরা সবাই হবে নাবালক, অনুগত, অনুসরণকারী – এই হয় মতাদর্শের কামনা। স্বাধীন ব্যক্তি তার চরম অপছন্দ। মানুষ নিজেই নিজের মুরুব্বি হবে কেন? শাসক-মোড়ল-অভিভাবকের তাহলে কী হবে? চার্চতন্ত্র ছাড়া, শাসক-যাজকতন্ত্র ছাড়া শাস্ত্রের হেফাজত করবে কে? শাসক হয়ে হয়ে ওঠেন শাস্ত্রের মালিক। ঈশ্বরের প্রতিনিধি। ঘোষিত বা অঘোষিত প্রতিনিধি। মুরুব্বি ছাড়া মতাদর্শ বাঁচে না। ঈশ্বরবিশ্বাসের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে শাসক-যাজক-মুরুব্বির প্রতি আস্থা।

মতাদর্শ টিকে থাকে হিংসার ওপর। হনন করিবার ইচ্ছার ওপর। প্রতিপক্ষকে দমন করবার আকাঙ্ক্ষার ওপর। প্রতিশোধপরায়ণতাই মতাদর্শের প্রাণ। মতাদর্শ টিকে থাকে মিথ্যার ওপর। বিমূর্ত বিচারে সত্য এক হলেও, তার মূর্ত প্রকাশ বহু-বিচিত্র। যেকোনো একটা বা একসেট প্রকাশকেই শুধু সত্য বলে ঘোষণা করলে তা মিথ্যার নামান্তর হয়। মতাদর্শ সত্যের বহুবিচিত্র, অনন্ত প্রকাশকে সহ্য করতে পারে না। নিজের বিবেচনাবোধ ছাড়া আর কারো বিবেচনাবোধের ওপর সে আস্থা রাখতে পারে না। অন্যকে সন্দেহ করাই তার কাজ। অন্যকে ভ্রান্ত মনে করাই তার কাজ। আত্ম-অনুসন্ধানের সাথে পরিচয় থাকে না মতাদর্শের।

মতাদর্শ মানেই চোখের ঠুলি। উল্টা-ইমেজ। ক্যামেরা-অবস্কিউরা। মতাদর্শ মানেই সত্য-মিথ্যা নির্ণয়ের মাতব্বরি। কোড অব কন্ডাক্ট। মতাদর্শ মানেই শাস্ত্র। শাস্ত্র চিরকাল শাসন-সাধনের উপায়-যন্ত্র-হাতিয়ার। মানুষের ওপর মানুষের শাসন আমার কাছে অগ্রহণযোগ্য। তা সে যে শাস্ত্র-মতাদর্শ-থিওক্রেসির দোহাই দিয়েই চালানো হোক না কেন। মতাদর্শ লাগে যেহেতু শাসনের জন্য, মতাদর্শ মানে তাই শাস্তির ভয় এবং পুরস্কারের লোভ। এই সূত্রে মতাদর্শ মাত্রেই সম্ভাব্য দণ্ডবিধি। আল্লাহ মানুষকে বিচার-বিবেক-বিবেচনা যুক্তি-বুদ্ধি সহকারে স্বাধীনভাবে সৃষ্টি করেছেন। কাউকে উত্তম কাউকে অধম হিসেবে পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুসারে মানুষ সৃজিত হয় নি। বাস্তবে মানুষ কী হবে, কেমন হবে তা নির্ভর করে ব্যক্তিক-জাগতিক-আত্মিক-মানসিক-আর্থসামাজিক অনেক কিছুর ওপর। আমার ধারণা, শাসন-প্রণালীর বদলে মানুষেরা নিজেরা-নিজেরা নিজেদের চালাতে পারে। অটোনমি-সংহতি-সৃজন-শীলতার ভিত্তিতে। স্বাধীন বোঝাপড়া ও স্বাধীন চুক্তি দিয়ে। এটাই আমার চোখে উত্তম পদ্ধতি। ইতিহাস ও বিবর্তন থেকে আমি এর নমুনা পাই। নিশানা পাই। আল্লাহর ইশারা পাই।

আর্টওয়ার্ক: আইডেনটিটি
শিল্পী: ভ্লাদেমির কাজানেভস্কি
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

যেকোনো থিওক্রেসিই মতাদর্শ। মতাদর্শ নিজেকে বা নিজের কোনো অংশকে সম্ভাব্য-ভ্রান্ত বলে ধরে নিতে পারে না কখনোই। নিজেকে অভ্রান্ত ভাবাই মতাদর্শের লক্ষণ। এতে করে পথ রুদ্ধ হয়। শাসন পোক্ত হয়। মানুষের স্বাধীনতা বিপন্ন হয়। দাসত্বের সূচনা ঘটে। মনুষ্যত্ব বিনষ্ট হতে থাকে। মানুষের অপমান হয়। খোদার ওপর খোদগারি করা হয়। আল্লাহর সর্বময়-সার্বভৌম ক্ষমতাকে অস্বীকার করা হয়। শেরেকি করা হয়। আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করাই শেরেকি। তা সে রাষ্ট্রই হোক, পার্টিই হোক, বা কোনো মতাদর্শই হোক।

উদাহরণত বলা যায়, ইসলাম আমার কাছে মতাদর্শ নয়। বদ্ধতা নয়। আমার কাছে ইসলাম একটা পথ। পথ মানেই খোলা। পথ মানে উন্মুক্ত উদ্দেশ্য, এবং তা হাসিলের উন্মুক্ত উপায়। ইসলাম আমার কাছে অনেক পথের একটা পথ। একমাত্র পথ নয়। অবিকল্প অন্তরায় নয়। সকল পথই আল্লাহর তরফে। সকল পথই তাঁর উদ্দেশে। সব তরিকাই তাঁর তরিকা। যেকোনো পথেই হোক, হাঁটলেই তাঁকে পাওয়া যায়। আন্তরিকভাবে হাঁটলে। অনুসন্ধিৎসা নিয়ে হাঁটলে। জানবাজি-আত্মাবাজি ধরে হাঁটলে। পথিকের মতো হাঁটলেই শুধু ইঙ্গিত মেলে তাঁর। মুখস্ত আবৃত্তির চর্বিত-চর্বণে জগতসত্তাকে বোঝা যায় না। চেনা যায় না। নিজের কর্তব্যও নির্ধারণ করা যায় না অতএব।

পথ মানে বাঁধানো পথ নয়। পথিক মানে টিকেট-কাটা-প্যাসেঞ্জার নয়। আগে থাকতে শানবাঁধানো সড়ক তো রাজপথ স্রেফ। রাজার রাস্তা। শাস্ত্রের সড়ক। শাসকের সত্য। মানুষের পথ সদা-অনির্ধারিত। মানুষের সত্য ভুলে ভরা আবিষ্কার-সাপেক্ষ। পা এবং আত্মা রক্তাক্ত হওয়া সাপেক্ষ। মুসাফিরের পথই তাই পথ। বাকি সবই পথের নামে শাস্ত্র-মতাদর্শ-থিওক্রেসি আর দণ্ডবিধি। শয়তানের চোখ-মারা। ইবলিসের ইশারা। সেই ইশারায় ভড়কে গিয়ে ভুল-ঠিকের আত্মঘাতী ও আত্মরতিশীল মানদণ্ড বিনির্মান এবং সেই মানদণ্ডের ভিত্তিতে কল্পিত বেঠিকের বিনাশই মতাদর্শের দণ্ডনৈতিক কর্তব্য, শাস্ত্রীয় কর্মসূচি।

কিন্তু প্রকৃতিতে ভুল কোনো ফুল নেই। সব ফুলই পুষ্প। আমি তাই রামকৃষ্ণ পরমহংসের গলায় বলি: ‘যত মত তত পথ’। সুফি সাধকদের জিকিরে আত্মা মিলিয়ে বলি: ‘যত কাল্লা তত আল্লা’। এমনকি বন্দুকের নলকে সমস্ত ক্ষমতার উৎস হিসেবে গ্রহণ না করেও আমি চীনের কমরেড মাও সেতুঙের সাথে পথ হাঁটতে হাঁটতে বলি: ‘শত ফুল ফুটুক, শত মত বিকশিত হোক’, শত পথ উদঘাটিত হোক।

বিভিন্ন খসড়া: ১৭ই মে, ১৯শে মে, ১০ই জুন ২০১৩
আদি পরিমার্জনা: ১২ই সেপ্টেম্বর ২০১৩, সর্বশেষ পরিমার্জনা: ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৩
দৈনিক বণিক বার্তা: ১৪ই সেপ্টেম্বর ২০১৩

সেলিম রেজা নিউটন

লেখক