অরাজ
আর্টওয়ার্ক: ম্যানুয়েল শিল্পী: মেনডিভ মিয়েল সূত্র: পিনটারেস্ট
প্রচ্ছদ » ভিত্তোরিও বুফাচ্চি।। করোনা ভাইরাস: বিশৃঙ্খলা ও আশা জাগানিয়া রাজনৈতিক দর্শন

ভিত্তোরিও বুফাচ্চি।। করোনা ভাইরাস: বিশৃঙ্খলা ও আশা জাগানিয়া রাজনৈতিক দর্শন

  • অনুবাদ : রাগিব শাহরিয়ার

কোনোকিছুই আগেরমত হবে না, এবং সম্ভবত এটা একটা ভালো বিষয়। বিশ্ব অর্থনীতির ওপর কোভিড-১৯ এর সম্ভাব্য বিধ্বংসী প্রভাব আদতে পরিমাপ-সুযোগের বাইরে। জাতিসংঘের মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেস উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে বিশ্বজুড়ে এই মহামারী দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছড়াতে পারে।

করোনা-সঙ্কটের শুরুতে ইতালিয়ানদের বাড়ির ব্যালকনি থেকে গাওয়া হৃদয়গ্রাহী গানের দৃশ্যপটে পরবর্তীতে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক অস্থিরতা । একইসাথে খাবারের দোকানে লাইন বেড়েই চলেছে। যদি অর্থনীতি ভেঙে পড়ে, তবে তা নাগরিক সমাজকেও ভাঙবে। ঝুঁকিটা এখানেই। রাজনৈতিক দার্শনিকদের মতে, আমরা ‘প্রকৃতিরাজ্যে’র দিকে চালিত হচ্ছি।

থমাস হবস

‘দি লেভিয়াথান’ বইতে থমাস হবস ‘স্টেট অফ নেচার’ বা প্রকৃতিরাজ্যের ধারণা প্রদান করেন। তিনি স্পষ্টই বলেছেন যে, প্রকৃতিরাজ্য- সময়ের দুর্গম অঞ্চলে ঘটে যাওয়া প্রাচীন কোনো বিষয় নয়, কিন্তু এমনকিছু- যা যেকোনো সময়েই ঘটতে পারে।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ভেঙে পড়লে তার জায়গা দখল করে বিশৃঙ্খলা। হবসের কাছে অবশ্যই এই ‘স্টেট অফ নেচার’ কোনো আকর্ষণীয় জায়গা ছিল না।

উক্ত অবস্থায়- শ্রমশিল্পের জন্য কোনো জায়গা নেই, কারণ এটা থেকে ফলাফল অনিশ্চিত; অতএব পৃথিবীতে কোনো সংস্কৃতি নেই; কোনো নৌচালনা বা সমুদ্রপথে পণ্যের আমদানি নেই, ব্যবহার উপযোগী কোনো স্থাপনা নেই; গতিশীলতার জন্যেও নেই কোনো উপাদান।

হবসের এরূপ ‘স্টেট অফ নেচারে’ আমরা এখনো আসিনি। তাঁর ভাষায় যাকে বলে ‘সময়ের কোনো হিসেব নেই; শিল্প নেই; চিঠিপত্র নেই; কোনো সমাজ নেই’- এরূপ অবস্থা এখনও আমরা অনুমান কিংবা আশা করি না। যদিও বর্তমানে এখন কোনো কনসার্ট, থিয়েটার, ভ্রমণ কিংবা খেলাধুলার আয়োজন নেই। হবস যাকে বলছেন “সবার বিরুদ্ধে সবার যুদ্ধ”, ঠিক তা-ই আমরা দেখতে শুরু করেছি; যেমন- বিশ্বমার্কেটে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ সামগ্রীর জন্য এক দেশ আরেক দেশের বিরুদ্ধে মারমুখী নিলামে অংশ নিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এন্টি-লকডাউন বিরোধী আন্দোলন চলছে, একইসাথে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সমর্থিত ভারী-অস্ত্রে সজ্জিত র‍্যালিও অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

হবস কতিপয় শীতল ও স্মরণীয় শব্দে ‘স্টেট অফ নেচারের’ সারমর্ম তুলে ধরেছেন: ‘ক্রমাগত ভয় এবং ভয়ংকর মৃত্যুই সবচাইতে ভয়াবহ; মানুষের জীবন নির্জন, দরিদ্র, কদর্য, বর্বর এবং সংক্ষিপ্ত।’ কোভিড-১৯ আমাদের সকলের ভেতর সঞ্চার করেছে- ক্রমাগত ভয়।

সবকিছু হারিয়ে যায়নি

সৌভাগ্যক্রমে, হবস আমাদের শেখায় যে আমরা উচ্ছন্নে যাইনি, ‘স্টেট অফ নেচার’ অতিক্রম করা সম্ভব। কিন্তু টিকে থাকার একমাত্র রাস্তা হচ্ছে পারস্পরিক সামাজিক সহযোগিতা।

সকল দুর্ভাগ্য এবং হীনাবস্থা সত্ত্বেও এই ‘স্টেট অফ নেচার’ একটি ‘স্টেট অফ ইকুয়ালিটি’ কিংবা সাম্যাবস্থাও। আমরা সবাই মরণশীল এবং সমানভাবে দুর্বল। কোভিড-১৯ এর অধীনে এটাই এখন জীবনের সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ভাইরাস প্রকৃতপক্ষেই একটা মহৎ সমতাসাধক, কারণ তা জাতীয়তা অথবা জাতিগত, লিঙ্গ কিংবা সামাজিক শ্রেণি, ধর্ম বা ভাষাভেদে পার্থক্য করে না। আজ আমরা সবাই সমানভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। এই মৌলিক সাম্যাবস্থা থেকে আরেক ধরনের বাস্তবতা উঠে আসে: কেবল একতা, দলগত কাজ এবং সংহতিই উক্ত অদৃশ্য শত্রুকে রুখতে পারে।

হবসের ‘স্টেট অফ নেচার’ অতিক্রম করতে হলে আমাদের একটি নতুন সামাজিক চুক্তি জারি করতে হবে। একটি পারস্পরিক-লাভের চুক্তি যেখানে প্রত্যেকে একটি দীর্ঘমেয়াদী লাভের স্বার্থে অল্প সময়ের জন্য বিসর্জন দিতে সম্মত হবে। অথবা, এই বোঝাপড়াটুকু তাদের ভেতর কাজ করবে।

একইভাবে, কোভিড-১৯ কাটিয়ে উঠবার লক্ষ্যে আমাদের একটি অভূতপূর্ব মাত্রার বিসর্জন, বিশ্বাস এবং পারস্পরিক সামাজিক সহযোগিতার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। অস্থায়ী লকডাউনে জীবনযাপন করা এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা অনেক মানুষের জন্য একটি বড় বিসর্জন, বিশেষত যেহেতু বেকারত্ব বাড়ছে এবং অনেক ব্যবসায়ে ধ্বস নেমেছে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ওপর আমাদের আস্থা রাখাটা জরুরি, যেহেতু (ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে) সবার মেনে চলার ভেতর দিয়েই জরুরি অবস্থাগুলো কার্যকর হবে।

আর্টওয়ার্ক: টুগেদার
শিল্পী: আমাদ রাহমা
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

কিন্তু পারস্পরিক সামাজিক সহযোগিতা ভঙ্গুর এবং অনিশ্চিত, বিশেষত একটি পুঁজিবাদী বিশ্বে, যেখানে স্বার্থপরতা একটি গুন এবং লোভীরা পুরষ্কৃত হয়। এই সংকট আমাদেরকে দৃঢ়ভাবে ধরে নেয়া অনেক অনুমান নতুন করে পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছে। যেমন: ব্যক্তিগত স্বার্থের সাধনা এই মুহুর্তে অকার্যকর এবং কোনো ট্রিকল-ডাউন প্রভাব থাকবে না (ট্রিকল ডাউন তত্ত্বানুযায়ী- বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলিকে দেয়া অর্থনৈতিক সুবিধা একপর্যায়ে ছোট ব্যবসায়ী এবং ভোক্তাদের নিকট অর্পিত হবে)। একইসাথে অর্থহীন এবং অপব্যয়ী বস্তুবাদী মনোভাব আর টেকসই নয়।

নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেবেন না

পারস্পরিক সামাজিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি বড় হুমকি হচ্ছে বিনা পরিশ্রমে সুবিধা অর্জনকারী ব্যক্তিত্বরা। এরা জনমানুষের কষ্টার্জিত অর্জনে বিন্দুমাত্র অবদান না রেখে তাদের সহযোগিতা থেকে উপকৃত হতে চায়। এই প্রকৃতির ব্যক্তিত্বকে হবস ‘নির্বোধ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

হবস ব্যাখ্যা করেন, নির্বোধেরা বিশ্বাস করে ন্যায় বলতে কোনোকিছু নেই এবং ব্যক্তি-স্বার্থের খাতিরে যেকোনো চুক্তি ভাঙা বৈধ। এই পৃথিবী নির্বোধে ভর্তি, কেবল সংকটের সময়েই তাদের ভেতরকার চরিত্র প্রকাশ পায়। লকডাউনের নিয়ম-নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এরা স্বার্থপরের মত পণ্যদ্রব্য মজুদ করে যাচ্ছে। এদের মধ্যে ব্যবসায়ীরাও পড়ে যারা মানুষের ভয়কে কাজে লাগিয়ে খাদ্যদ্রব্য, ফেসমাস্ক অথবা হ্যান্ড স্যানিটাইজারের মূল্যবৃদ্ধি করে যাচ্ছে। নির্বুদ্ধিতার পরিচয় এড়ানোর জন্য ব্যক্তি-স্বার্থ অথবা ব্যক্তিগত লাভের ঊর্ধ্বে গিয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার উপর গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন।

হবসের ‘স্টেট অফ নেচার’ অনুযায়ী, কোভিড-১৯ এর সাথে বসবাস আসলে পারস্পরিক সামাজিক সহযোগিতার রাজনীতির মুক্তিপরায়ণতার কথা মনে করিয়ে দেয়। কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে আমরা এমন সামাজিক বন্দোবস্তে প্রবেশ করতে যাচ্ছি যা একটি নতুন নাগরিক সমাজের ভিত্তিপ্রস্তর গড়ে তুলবে।

সম্পাদকীয় নোট: ভিত্তোরিও বুফাচ্চি, ইউনিভার্সিটি কলেজ কর্ক এর দর্শন বিভাগের সিনিয়র লেকচারার। তার এই লেখাটি প্রকাশিত হয় The conversation পত্রিকায়।

অরাজ