অরাজ
আর্টওয়ার্ক: করোনা শাসকতা-২ শিল্পী: সারশু সূত্র: অরাজ
প্রচ্ছদ » নোম চমস্কি।। নিওলিবারাল মহামারী

নোম চমস্কি।। নিওলিবারাল মহামারী

অনুবাদ: নুরে আলম দুর্জয়

বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস এবং  একে মোকাবেলায় শাসকগোষ্ঠীর নীতি ও সমগ্র রাজনৈতিক ব্যবস্থার সক্ষমতা ব্যাখ্যা করে  ডেমোক্রাসি ইন ইউরোপ মুভমেন্ট– ডিয়েম ২৫ কে একটি সাক্ষাতকার দেন নোম চমস্কি। গত ২৮ মার্চ, ২০২০ তা ইউটিউবে প্রচারিত হয়। ডিয়েমের হয়ে সাক্ষাতকার নেন স্রােয়েকো হোরবেট। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গৃহীত সাক্ষাতকারটি শ্রুতি লিখনের সময় কতক জায়াগার অডিও অস্পষ্ট ছিল। স্থানগুলো চিহ্নিত করা আছে। অরাজের হয়ে শ্রুতিলিখন ও অনুবাদ করেছেন নূরে আলম দুর্জয়। পরে টেক্সট মিলিয়ে দেখা ও সম্পাদনার কাজটি করেছেন তানভীর আকন্দ।

নোম চমস্কি

স্রােয়েকো হোরবেট: ‘করোনা ভাইরাস পরবর্তী বিশ্ব’-এর আরেকটি এপিসোডে  আপনাদের স্বাগতম। এই বিশেষ পর্বের জন্য আমি সত্যিকার অর্থে আনন্দিত এবং সম্মানিত বোধ করছি। কেননা আমাদের সঙ্গে আজ একজন বিশেষ অতিথি রয়েছেন। সেই বিশেষ অতিথি শুধু আমারই নয়, আমাদের আনেক প্রজন্মেরই নায়ক তিনি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমরা উভয়ই এখন সেল্ফ-আইসোলেশনে রয়েছি, ফলে এটি একটি বিশেষ উপলক্ষও বটে। তবে বাড়তি পরিচয় না দিলেও, যারা দেখছেন তাদের অধিকাংশই আমার ধারণা নোম চমস্কিকে চেনেন এবং আমার খুব ভালো লাগছে যে নোম আজকে আমাদের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছেন।

হ্যালো নোম, আপনি কি আমাদের একটু জানাতে পারেন বর্তমানে আপনি কোথায় রয়েছেন? এর মধ্যেই কি সেল্ফ-আইসোলেশানে চলে গেছেন? গেলে কতদিনের জন্য?

নোম চমস্কি: আচ্ছা, আমি অ্যারিজোনার তুসন শহরে সেল্ফ-আইসোলেশনে আছি।

স্রােয়েকো হোরবেট: আপনার জন্ম ১৯২৮ সালে। যতদূর জানি আপনি আপনার প্রথম প্রবন্ধটি লিখেন মাত্র দশ বছর বয়সে, যেটি ছিল স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ নিয়ে। কার্যত, ঠিক বার্সেলোনার পতনের পরপরই, ১৯৩৮ সালে, আমার প্রজন্মের কাছে যা সুদূর অতীত। আপনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বেঁচে ছিলেন, দেখেছেন হিরোশিমা। ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে শুরু করে তেল সংকট, বার্লিন ওয়ালের পতন পর্যন্ত আপনি অনেক বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ করেছেন। তার আগে, আপনি চেরোনোবিলের একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। এরপরে, ৯০ এর দশকে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন যেটি ৯/১১ পর্যন্ত গড়ায়, যেটি সাম্প্রতিক সময়ের একটি বৈশ্বিক ঘটনাও বটে। এবং খুব সম্প্রতি— আপনার মতো একজন ব্যক্তির জীবনব্যাপী দীর্ঘ ইতিহাসের সার-সংক্ষেপ টানার চেষ্টা করছি আমি— একেবারে সাম্প্রতিক ঘটনার কথা যদি বলি, তবে ২০০৭ ও ২০০৮ এর অর্থনৈতিক মন্দার কথা উল্লেখ করতে হয়। এই প্রেক্ষিতে, এমন একটি সমৃদ্ধ জীবনে, একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে এবং এই প্রধান প্রধান ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার একজন অনুঘটক হয়ে, আপনি বর্তমান করোনাভাইরাস সংকটকে কীভাবে দেখছেন? এটি কি একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা, এটি কি এমন কিছু যেটি আপনাকে অবাক করে দিয়েছে? বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন? এসবই আমার প্রশ্ন। 

নোম চমস্কি: আমার বলা উচিত, আগেকার দিনের যেসব স্মৃতি এখন আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, সেসব ১৯৩০ এর দশকের। বার্সেলোনার পতনের উপর যে নিবন্ধটির কথা আপনি উল্লেখ করেছেন সেটি মূলত, আপাতদৃষ্টিতে, সারা ইউরোপ জুড়ে মহামারি আকারে ফ্যাসিবাদের নির্দয় বিস্তার এবং কীভাবে এটির সমাপ্তি ঘটবে সেই সম্পর্কে। পরে, অনেক পরে আমি আবিষ্কার করি, যখন অভ্যন্তরীণ তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ পেতে শুরু করল, সেই সময়ে এবং পরের বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিশ্লেষক আশা করেছিল যে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটবে সারাপৃথিবীকে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মান আধিপত্যের অধীন দুটি অঞ্চলে বিভাজিত করার মাধ্যমে । সুতরাং, আমার শৈশবকালীন ভয় একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক ছিল না। এইসব স্মৃতি এখন ফিরে আসছে। আমার মনে আছে, ছোটবেলায়, বাচ্চা একটা ছেলে রেডিওতে হিটলারের নুরেমবার্গ জনসভা শুনছে। একটা বর্ণও আমি তখন বুঝতাম না কিন্তু এর হাবভাব, হুমকি এবং আরও অনেক কিছু ঠিকই বুঝা যেত। বলেতই হয় যে আজকে যখন আমি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমাবেশ শুনছি, ঠিক যেন সেটারই প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এমন নয় যে তিনি একজন ফ্যাসিস্ট, ঐরকম আদর্শও তিনি ধারণ করেন না। তিনি একজন সোসিওপ্যাথ মাত্র, এমন একটা লোক যে শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। কিন্তু এই হাবভাব, এই আতঙ্ক ঠিক আগের মতোই। একজন সোসিওপ্যাথিক ভাঁড়ের হাতে দেশের এবং সারা বিশ্বের ভাগ্য নির্ভর করছে এই চিন্তাটাই হতবুদ্ধিকর। করোনাভাইরাস নিজেই যথেষ্ট গুরুতর একটি বিষয়, তবে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন, আরও বড় ভয়ের ঘটনা এগিয়ে আসছে। ধ্বংসের দোরগোড়ায় এগিয়ে চলেছি আমরা, মানব ইতিহাসের এখনপর্যন্ত সবচাইতে জঘন্যতম পরিণতির দিকে। আর এই অতল গহ্বরে ছুটে চলায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডোনাল্ট ট্রাম্প আর তার চামচারা। প্রকৃতপক্ষে, দুটি বৃহত্তর হুমকির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি আমরা বর্তমানে। একটি হচ্ছে পারমাণবিক যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান হুমকি, আর্মস কনট্রোল রেজিমের অবশিষ্ট যা ছিল সেটাও ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ায় এই হুমকি আরও প্রবল হয়েছে। এবং অবশ্যই দ্বিতীয় হুমকিটি হচ্ছে ক্রমবর্ধমান বৈষ্ণিক উষ্ণতা। এ দুটি হুমকিরই মোকাবিলা করা সম্ভব, তবে এর জন্য খুব বেশি সময় হাতে নেই। করোনা ভাইরাস অবশ্যই ভয়ঙ্কর এবং এর ভয়াবহ পরিণতিও হতে পারে। কিন্তু এর থেকেও উদ্ধারলাভ সম্ভব, কিন্তু অন্যগুলো থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায় নেই, সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। আমরা যদি এসবের মোকাবিলা না করি তাহলে মরতে হবে আমাদের। এ কারণেই শৈশবের স্মৃতিগুলো ভিন্ন এক মাত্রায় ফিরে এসে তাড়া করছে আমাকে। পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি আঁচ পায়নি পৃথিবীর অবস্থান আসলে কোথায়। গোড়ার দিকে তাকালে, এই জানুয়ারির কথাই ভাবুন, প্রতিবছরই আপনি জানেন হয়তো কেয়ামতের দিনক্ষণ এগিয়ে আসছে, একেবারে মিনিটের কাঁটা ধরে। যেকোনো মাঝরাতেই সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু যখন থেকে ট্রাম্প নির্বাচিত হয়েছেন, ঘড়ির কাঁটা আরও দ্রুত এগিয়ে আসছে সেই মাঝরাতের দিকে। গত বছর, দুই মিনিটের ব্যবধানে চলে এসেছিল তা। এ যাবতকাল সবচেয়ে কাছাকাছি ছিল এটাই । এই বছর বিশ্লেষকেরা মিনিটের হিসাব ছেড়ে সেকেন্ডের হিসাবে চলে এসেছেন, সেই মাঝরাত থেকে ১০০ সেকেন্ড দূরে, এটাই সবচেয়ে কাছাকাছি।

আর্টওয়ার্ক: ডিপার্চর অব কালার
শিল্পী:
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

তিনটি বিষয় দেখা যাচ্ছে: পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের হুমকি এবং গণতন্ত্রের অধপতন। যদিও এই তালিকায় গণতন্ত্র ঠিক পড়ে না, কিন্তু সেটা আনতে হচ্ছে, কেননা সংকট মোকাবিলার এই একটা আশাই আমাদের আছে। [এ জায়গাটি স্পষ্ট শোনা যায়নি] জনগণ তার নিজের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিচ্ছে, আর যদি না নেয়তো আমাদের ধ্বংস অনিবার্য। আমাদের ভাগ্য যদি আমরা কোনো সোসিওপ্যাথিক ভাঁড়ের হাতে ছেড়ে দেই, তাহলেই গেছি। এবং এই পরিণতি ঘনিয়ে আসছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার কারণেই ট্রাম্প সবচেয়ে ভয়াবহ।

যুক্তরাষ্ট্রের পতন নিয়ে আমরা কথা বলছি, কিন্তু বিশ্বের দিকে তাকান। আপনার চোখে পড়বে না, যুক্তরাষ্ট্র যখন তার নির্দেশনা চাপিয়ে দেয়— খুনে, বিধ্বংসী সব নির্দেশনা (এই একটা দেশই এটা করতে পারে) তখন সবাইকেই সেটা মানতে হয়। ইউরোপের সেটা পছন্দ নাও হতে পারে, প্রকৃতপক্ষে ইরানের প্রতি বিষেদাগার, কিন্তু তাদেরকে সেটা মেনে চলতে হয়। প্রভুর কথায় উঠতে বসতে হবে, নাহলে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হবে। এটা কোনো প্রাকৃতিক আইন নয়, এটা ইউরোপের ওয়াশিংটনের প্রভুদের আজ্ঞাবাহী হয়ে চলার সিদ্ধান্ত, আর এমনকি অন্যান্য দেশগুলোর মতামতের তো কোনো দামই নেই এখানে।

করোনাভাইরাসের আলাপে ফিরে আসি। এর সবচেয়ে দুঃখজনক ও রূঢ় দিকটি হলো, সম্পূর্ণ সচেতনভাবে এই কষ্টের মাত্রা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে নির্দেশনার ব্যবহার। ইরান এমন একটি এলাকায় অবস্থিত যেখানে এমনিতেই অসংখ্য অভ্যন্তরীণ সমস্যা রয়েছে। সচেতনভাবে তৈরি করা নির্দেশনগুলোর কড়াকড়ির মাধ্যমে, বেশ খোলাখুলিভাবেই নির্মম ভোগান্তি তৈরি করা হয়েছে। স্বাধীনতার সময় থেকেই কিউবা এতে ভুগছে। বিস্ময়করভাবে কিউবা টিকে আছে, এবং বেশ স্থিতিশীল অবস্থায়। আজকের ভাইরাস সমস্যার একটা বড় কৌতুককর দিক হচ্ছে, কিউবা ইউরোপের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি বলতে চাচ্ছি আরকি, এটা আমাদের এতটাই হতবুদ্ধি করে দেয় যে ব্যাপারটিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায় তাও আমরা জানি না। জার্মানি পারছে না গ্রিসকে সাহায্য করতে, কিন্তু কিউবা পারছে ইউরোপীয় দেশগুলোকে সাহয্য করতে। এর মানে কী সেটা যদি ভাবতে বসেন তাহলে ভাষা খুঁজে পাবেন না। ঠিক যখন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে, শত শত বছর ধরে বিধ্বস্ত অঞ্চল থেকে মানুষজন পালিয়ে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে গিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে, তখন শব্দ খুঁজে পাবেন না আপনি। এই সংকট, সভ্যতার এই সংকট এই পর্যায়ে এসে বেশ বিধ্বংসী চেহারা লাভ করেছে, এ ব্যাপারে ভাবতে গেলে শৈশবে রেডিওতে উত্তাল জনস্রোতের উদ্দেশ্যে হিটলারের প্রলাপ শোনার স্মৃতি মনে পড়ে যায়। এবং ভাবতে বাধ্য হই এই প্রজাতির পক্ষে কি আসলেই টিকে থাকা সম্ভব?

স্রােয়েকো হোরবেট: আপনি গণতন্ত্রের সংকটের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। এই মুহূর্তে আমি মনে করি, ঐতিহাসিকভাবে একটি অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মধ্যে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করেছি, এই অর্থে যে প্রায় ২ বিলিয়ন মানুষ কোনো না কোনোভাবে গৃহবন্দি রয়েছেন, এই পরিসংখ্যানটা আজকে পেয়েছি আমি। এটি আইসোলেশন হোক, সেল্ফ-আইসোলেশনই হোক আর কোয়ারেন্টিনই হোক। বিশ্বের প্রায় ২ বিলিয়ন মানুষ ঘরের মধ্যে, যদি একটি ঘরের মালিক হওয়ার জন্য তারা যথেষ্ট ভাগ্যবান হয়ে থাকেন আরকি। একই সঙ্গে যা আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি তা হলো ইউরোপ এবং অন্যান্য দেশগুলোও তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে, শুধু অভ্যন্তরীণ সীমান্তগুলোই নয়, বাইরের সীমান্তও। সম্ভাব্য সব দেশেই একটি ব্যতিক্রম অবস্থা বিরাজ করছে, যার মানে হলো অনেক দেশেি কারফিউ জারি করা হয়েছে। যেমন ফ্রান্স, সার্বিয়া, স্পেন, ইতালি এবং অন্যান্য দেশে রাস্তায় সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে। একজন ভাষাতত্ত্ববিদ হিসেবে আপনাকে আমি যা জিজ্ঞেস করতে চাই তা হলো যে ভাষা এখন চারপাশে প্রচার করে বেড়ানো হচ্ছে। শুধু ডোনাল্ড ট্রাম্প নয়, আপনি যদি ম্যাক্রোঁর কথা শোনেন, অন্যান্য ইউরোপীয় রাজনৈতিকদের কথা শোনেন, আপনি ক্রমাগত শুনতে থাকবেন যে তারা যুদ্ধের ব্যাপারে বলছে। এমনকি মিডিয়া চিকিৎসকদের সম্পর্কে বলছে যারা প্রথম “ফ্রন্ট লাইনে” রয়েছেন এবং ভাইরাসকে ডাকা হচ্ছে শত্রু বলে। যা আমাকে মনে করিয়ে দেয় ভাগ্যক্রমে শৈশবের কোনো স্মৃতি নয় বরং একটি বইয়ের কথা, যেটি ওই সময়ে লেখা হয়েছিল— ভিক্টর ক্লেমপেরার Lingua tertii imperii যেটি ছিল  Third Reich এর ভাষাব্যবহার সম্পর্কে এবং ভাষার মাধ্যমে কীভাব ঐ ভাবাদর্শ চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল সে সম্পর্কে একটি বই। সুতরাং, আপনার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, যুদ্ধ সম্পর্কিত এই ডিসকোর্স আমাদের কী বলে এবং কেন তারা একটি ভাইরাসকে শত্রু হিসেবে উপস্থাপন করছে, এটি কি কেবল নতুন ব্যতিক্রমী দশার বৈধতাপ্রদানের জন্য নাকি এই ডিসকোর্সে আরও গভীরতর কিছু আছে?

নোম চমস্কি: [এখানে কিছু অংশ শোনা যায়নি] এই বাগাড়ম্বর, কিন্তু আমি মনে করি এটি অতিরঞ্জিত নয়। তবে এর কিছু গুরুত্ব রয়েছে। মানে হলো, আমরা যদি সংকটকে মোকাবিলা করতে চাই, তাহলে আমাদেরকে যুদ্ধকালীন মোবিলাইজেশনের মতো কিছু একটার দিকে এগুতে হবে। কাজেই আপনি যদি যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি ধনী দেশের কথা চিন্তা করেন, তাহলে দেখবেন আশু অর্থনৈতিক [সংকটাবস্থা] উৎরানোর মতো সম্পদ এর রয়েছে। বর্তমানের তুলনায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোবিলাইজেশানের কথা যদি বলেন তাহলে সেটা আরও অনেক বেশি ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিল দেশটির উপরে, কিন্তু একটা ব্যাপক সফল একটি মোবিলাইজেশান ছিল, কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদনশীলতাকে চারগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল, মন্দাবস্থা কটিয়ে তুলে দেশটিকে বিপুল ঋণের দিকে ঠেলে দিলেও প্রবৃদ্ধির সক্ষমতা প্রদান করেছিল। সম্ভবত এর থেকেও আমাদের কম কিছুর প্রয়োজন, অন্তত ঐ মাত্রায় না, এটি কোনো বিশ্বযুদ্ধের মতো নয়, কিন্তু স্বল্পকালীন মারাত্মক সংকট অতিক্রম করার জন্য আমাদের একটি সামাজিক আন্দোলনের মানসিকতা গঠন করা জরুরি। এখানে আমরা ২০০৯ সালের সোয়াইন ফ্লু মহামারির কথাও স্মরণ করতে পারি, যুক্তরাষ্ট্রে হাজার হাজার মানুষ প্রথম দফায় আশংকাজনক অবস্থা থেকে আরাগ্য লাভ করেছিলেন। তবে একে মোকাবিলা করতে হয়েছিল। এই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি ধনী দেশের অবস্থা। এখন এখানে দুই বিলিয়ন মানুষ, যার একটি বড় আংশই ভারতে। ভারতীয়দের ক্ষেত্রে কী ঘটছে? তারা দিনে আনে দিন খায়, যাদের আলাদা করে রাখা হবে তারা না খেতে পেয়েই মারা যাবে । কী ঘটবে তাহলে? একটি সভ্য পৃথিবীতে ধনী দেশগুলোর অসহায়দের সাহায্য করার কথা ছিল, তাদেরকে শ্বাসরোধ করার বদলে, ঠিক যা আমরা করছি, বিশেষ করে ভারতে, এবং বিশ্বের বহু জায়গায়ও।

আর্টওয়ার্ক: করোনা এন্ড হিউম্যান এচিভমেন্ট
শিল্পী: মোহাম্মদ সাবানেহ
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

এধরনের সংকট, তা ধরুন সেটা ভারতের মতো দেশেই হোক, আমি ঠিক জানি না,  তবে চলমান এ অবস্থা যদি দক্ষিণ এশিয়াতে স্থায়ী হয় তাহলে মনে রাখবেন যে কয়েক দশকের মধ্যে তা বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে। এই গ্রীষ্মে রাজস্থানে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রিতে পৌঁছেছিল এবং তা বেড়ে চলেছে। বর্তমানের পানি সংকট আরও করুণ অবস্থায় পৌঁছাবে। সেখানে দুটি পারমাণবিক শক্তি রয়েছে, তারা হ্রাসকৃত পানি সরবরাহকে কেন্দ্র করে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাকবে। আমি বলছি করোনাভাইরাস খুবই সিরিয়াস, আমরা এটাকে অবজ্ঞা করতে পারি না, কিন্তু আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে এটা হচ্ছে একটি ভগ্নাংশ মাত্র, অনেক বড় সংকটের সামান্য একটা অংশ, যা ক্রমাগত এগিয়ে আসছে। তারা হয়তো সেভাবে জীবনকে বিপর্যস্ত করবে না, যেমনটা করোনাভাইরাস আজকে করছে, কিন্তু তারা জীবনকে বিপর্যস্ত করবে এমন একটি মাত্রায় যাতে প্রজাতির টিকে থাকার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলবে এবং সেটি খুব দূরে নয়। কাজেই মোকাবিলা করার জন্য আমাদের অনেক সমস্যা রয়েছে। এটা ঠিক, নগদ সমস্যা যেটা—করোনাভাইরাস, সেটা বেশ মারাত্মক। একে মোকাবিলা করতে হবে,  কিন্তু আরও বড় সমস্যা, অনেক বড় সমস্যা এগিয়ে আসছে। বর্তমানে সভ্যতাগত সংকট বিদ্যমান। করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য ভালো দিকগুলো আমলে নিতে হবে আমাদের। এই যেমন, মানুষকে ভাবাতে পারে, কেমন পৃথিবী আমরা চাই? আমরাকি এমন পৃথিবী চাই যা আমাদের এরকম পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে? আমাদের চিন্তা করা উচিত সংকটের উৎপত্তি নিয়ে, কেন এই করোনা ভাইরাস সংকট দেখা দিল? এটা এক বিরাট বাজার ধ্বস, বাজারের একেবারে মূলে ফিরে গিয়ে, এই বর্বর, নয়া-উদারনৈতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে গভীরতর সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর তীব্রতাবৃদ্ধি করে এই ধ্বসের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। অনেকদিন থেকেই আমরা জানি যে সম্ভাব্য মহামারিগুলো খুবই সন্নিকটে, এটা জানা ছিল, খুব ভালোভাবেই এটা বুঝা গিয়েছিল যে সার্সের মহামারির সামান্য রূপান্তর হিসেবে করোনা ভাইরাসের মহামারি আসন্ন। ১৫ বছর আগে এর মোকাবিলা আমরা করেছি, ভাইরাসগুলো চিহ্নিত হয়েছে, অনুক্রম তৈরি করা হয়েছে, ভ্যাকসিনও পাওয়া যাচ্ছে, সম্ভাব্য করোনা ভাইরাসের মহামারি থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সারা দুনিয়াজুড়েই গবেষণাগারগুলোর এতদিনে এ নিয়ে কাজে নেমে পড়ার কথা ছিল, কিন্তু কেন সেটা হলো না?

বাজারের আভাসগুলো ভুল ছিল। ওষুধ কোম্পানিগুলো, প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর দৌরাত্মের হাতে আমরা আমাদের ভাগ্য সপে দিয়েছি। মালিক করপোরেশানগুলো যাদেরকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না, এইক্ষেত্রে যেমন-  বড় ঔষধ কোম্পানিগুলো, তারা নতুন বডি ক্রিম বানায়, কারণ মানুষকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য নতুন ভ্যাকসিন খুঁজে বের করার চেয়ে সেটা বেশি লাভজনক। সরকারের এক্ষেত্রে এগিয়ে আসা অসম্ভব। যুদ্ধকালীন মোবিলাইজেশানের সময় যা ঘটেছিল, আমার বেশ স্পষ্ট মনে আছে সে সময় পোলিও আতঙ্কজনক একটি হুমকি ছিল। যার অবসান ঘটে সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের সল্ক ভ্যাকসিন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে, রোজভেল্ট প্রশাসন যার শুরু করেছিল। কোনো প্যাটেন্ট ছিল না, সবার জন্যই তা উন্মুক্ত ছিল। এবারও সেটা করা যেত, কিন্তু নয়া-উদারনৈতিক মহামারির সে পথ বন্ধ করে রেখেছে। আমরা এমন একটি ভাবাদর্শের অধীনে বাস করছি, যার জন্য অর্থনীতিবিদরা যথেষ্টই দায়ী, করপোরেট সেক্টর থেকেই মূলত যার আবির্ভাব। এই ভাবাদর্শ, রোনাল্ড রিগ্যান যার দৃষ্টান্ত খাড়া করেছিল, হাস্যোজ্জ্বল চেহরায় তার করপোরেট প্রভুদের ধরিয়ে দেয়া স্ক্রিপ্ট পড়ার মাধ্যমে- সরকারই হচ্ছে সমস্যা। সরকারের হাত থেকে পরিত্রাণ দরকার, মানে বেসরকারি স্বৈরতন্ত্রের হাতে সিদ্ধান্তের ক্ষমতা দিয়ে দেই, যাদের মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। আটলান্টিকের অপরপ্রান্তে, থ্যাচার আমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যে, সমাজ বলে কিছুই নেই, শুধুমাত্র বাজারে ছেড়ে দেয়া মানুষের কোনো না কোনোভাবে টিকে থাকা, এছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।   

আর্টওয়ার্ক: সন অব ম্যান করোনা
শিল্পী: রাবাত আল খাতিব
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

ধনীদের পদতলে বছরের পর বছর ধরে পৃথিবী ভুগছে। এখন এটি এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছেছে যে, সরাসরি সরকারি হস্তক্ষেপের মতো ঘটনা যার ফলে সল্ক ভ্যাকসিন আবিষ্কারের মতো সুযোগ তৈরি হতে পারত, নয়া-উদারনৈতিক মহামারির থেকে উদ্ভূত ভাবাদর্শিক কারণে সে পথও বন্ধ হয়ে গেছে। মূল কথা হচ্ছে যে, করোনা ভাইরাসের এই বৈশ্বিক মহামারি প্রতিরোধ করা যেত, তথ্যউপাত্ত হাতের কাছেই ছিল, এমনকি মহামারি ছড়িয়ে পড়ার আগেই ২০১৯-এর অক্টোরবরেও এটা বেশ পরিচিত ছিল। এধরনের সম্ভাব্য বৈশ্বিক মহামারির দুনিয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্টে লেভেল সিমুলেশানের মাধ্যমে করা একটি বড় মাত্রার সিমুলেশান আমাদের হাতে ছিল। কিন্তু কিছুই করা হয়নি, এখন এই সংকট চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার বিশ্বাসঘাতকতার কারণে। যে সমস্ত তথ্যউপাত্ত নিয়ে তারা সচেতন ছিলেন সেগুলোর দিকে আমরা মনোযোগ দেইনি, ৩১শে ডিসেম্বর চীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে অজানা কারণে ঘটা নিউমোনিয়ার মতো লক্ষণগুলো নিয়ে সচেতন করে। এক সপ্তাহ পরে, কিছু চাইনিজ বিজ্ঞানী একে করোনা ভাইরাস বলে শনাক্ত করেন, এছাড়াও তারা এর অণুক্রম তৈরি করে সারা দুনিয়াকেই জানান, ততক্ষণে ভাইরোলজিস্ট ও অন্যান্যরা যারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টটি পড়েছে, তারা জেনে গেছে যে এটা করোনা ভাইরাস এবং একে মোকাবিলা করতে হবে কীভাবে।

তারা কি কিছু করেছেন, হ্যা, কেউ কেউ করেছেন। ঐ অঞ্চলের দেশগুলো— চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর— কিছু কিছু পদক্ষেপ নেয়া শুরু করেছিল এবং অন্তত প্রথম ধাক্কায় কোনো একভাবে একে নিয়্ন্ত্রণেও রাখতে পেরেছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইউরোপেই তা ঘটেছিল। জার্মানি সময়মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি, তাদের হাসাপাতাল ব্যবস্থা রয়েছে উদারনীতিবাদের আওতায়, তাদের বাড়তি পরীক্ষা করানোর সক্ষমতাও ছিল, এবং তারা স্বার্থপর কায়দায় অন্যদের সাহায্য না করে শুধুমাত্র নিজেদের জন্য হলেও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারত যাতে করে রোগ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অন্যান্য দেশগুলো শ্রেফ এড়িয়ে গেছে ব্যাপারটা, এদের মধ্যে যুক্তরাজ্যের অবস্থা খুবই খারাপ। আর সবথেকে করুণ অবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের, যেই দেশটা কিনা একজন সোসিওপ্যাথ চালায়। তার কথামতো, একদিন আপনি দেখবেন কোনো বিপদ নেই, শ্রেফ ফ্লু এর মতোই একটি ব্যাপার, তার পরের দিন সেটা ভয়াবহ সংকট হয়ে গেল, এইসব আমার জানা আছে, পরের দিন আমাদের একে তুলে দিতে হবে ব্যবসার জন্য, কারণ আমাকে নির্বাচনে জিততে হবে। এইসব মানুষদের হাতে দুনিয়া চলছে এই চিন্তাটাই আতঙ্কজনক। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে যে, বিরাট বাজার ধ্বসের হাত ধরেই এর শুরু, যা মৌলিক সমস্যাগুলো অর্থাৎ সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে। নয়া-উদারনীতিবাদের মহামারি যেগুলোকে আরও অনেক বেশি দুরবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে, আর এই দুরবস্থা বাড়তেই থাকবে, কারণ এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারেন এমন প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি যদি আমাদের কার্যকর থেকেও থাকে সেগুলো বিকল হয়ে পড়ছে। এই বিষয়গুলো নিয়েই আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে, এবং আরও গভীরররভাবে ভাবতে হবে যেমনটা আমি আগেই বলেছি, কোন ধরনের পৃথিবীতে আমরা বাস করতে চাই? সেটা নিয়ে। 

আর্টওয়ার্ক: ফাইটিং দ্য ভাইরাস
শিল্পী: মুজাফফর ইয়েলচি
সূত্র: আর্টওয়ার্ক

আমরা যদি কোনোভাবে জয়লাভ করি, তাহলে সেখানে বিকল্প থাকবে। প্রচণ্ড কর্তৃত্ববাদী পাশবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার থেকে ব্যক্তিগত মুনাফার মানবিক চাহিদা মাথায় রেখে, আরও মানবিক অর্থে সমাজের বৈপ্লবিক পুনর্গঠন পর্যন্ত যেই বিকল্পের সীমানা। আমাদের মাথায় রাখা উচিত যে নয়া-উদারনীতিবাদের সাথে প্রচণ্ড কর্তৃত্ববাদী ব্যাধিযুক্ত রাষ্ট্র পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। বস্তুত, নয়া-উদারনীতিবাদের লক্ষ্য হচ্ছে, [এ জয়গাটা স্পষ্ট শোনা যায়নি] থেকে  হায়েক পর্যন্ত। বাকিরা ব্যাপক আকারে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা নিয়েই সন্তুষ্ট, যতক্ষণ পর্যন্ত এটা তাদের ভাষায় সমৃদ্ধ অর্থনীতির জন্য কাজ করে যাবে। নয়া-উদারনীতিবাদের উৎস ১৯২০ এর দশকের ভিয়েনা [এ জয়গায় কিছু কথা স্পষ্ট শোনা যায়নি] অস্ট্রিয়ান রাষ্ট্রের প্রোটো-ফ্যাসিস্ট, এবং শ্রমিক ইউনিয়নগুলো ও অস্ট্রিয়ার সোসাল-ডেমোক্রেটিক সরকারকে গুড়িয়ে দিয়ে, প্রোটো-ফ্যাসিস্ট সরকারের দলে যোগ দেয়। ফ্যাসিবাদের জয় ঘোষণা করে, তার সমৃদ্ধ অর্থনীতিকে রক্ষা করার জন্য। পিনোশে যখন চিলেতে একটা খুনে, নৃশংস একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে, তারা সবাই একে সমর্থন দিয়েছিল, তারা সবাই এর জন্য লড়াই করেছিল  [এ জয়গায় কিছু কথা স্পষ্ট শোনা যায়নি] এই অবিশ্বাস্য অলৌকিক ঘটনাকে সহায়তা করেছে, যা তাদেরকে সমৃদ্ধ অর্থনীতির এনে দিয়েছিল, জনগণের একটা ছোট অংশকে শোষণের মাধ্যমে বড় মুনাফা এনে দিচ্ছিল। সুতরাং এটা ভাবা বেশি হয়ে যাবে না যে, শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় সহিংসতার মাধ্যমে স্বঘোষিত উদারনীতিবাদীদের হাতে একটি হিংস্র নয়া-উদারনীতিবাদী ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটতে পারে। এটি একটি দিক, একটি দুঃস্বপ্ন, যা ঘটে যেতে পারে। কিন্তু এটা অবিসম্ভাবী নয়, একটা সম্ভাবনা রয়েছে মানুষের সংগঠিত হওয়ার, সংযুক্ত হওয়ার, যেমনটা অনেকেই করছে। আরও ভালো একটা পৃথিবী প্রতিষ্ঠা করার সম্ভাবনা রয়েছে, তাতেও অবশ্য অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।  ইতোমধ্যেই যেসব পথ আগলে আছে, পারমাণবিক যুদ্ধের সমস্যা, অতীতের অনেক বেশি কাছে চলে এসেছে যা এবং রয়েছে পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকি, একবার ঐ পর্যায়ে চলে গেলে যার থেকে নিস্তার পাওয়ার কোনো উপায় নেই। আমরা যদি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ না করি তাহলে এই বিপদ খুব বেশি দূরে নয় আমাদের। সুতরাং, এটি হচ্ছে মানব ইতিহাসের একটি সংকটপূর্ণ মুহূর্ত, শুধু করোনাভাইরাসের কারণে নয়, বরং আমাদের উচিত হবে পৃথিবীর গভীর ত্রুটিগুলো সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা যেটি যথেষ্ট শক্তিশালী নয়, পুরো আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার অথর্ব বৈশিষ্ট্য, যেটি গভীরতর তা ভেঙে ফেলা, যদি একটি বাসযোগ্য ভবিষ্যৎ পেতে চাই। সুতরাং এটি একটি সতর্কতামূলক সঙ্কেত, একে মোকাবিলার জন্য বা বিষ্ফোরিত হওয়া একে রক্ষা করতে আজকের দিনে এটা একটা শিক্ষা হতে পারে। আবার এর উৎস নিয়ে ভাবা এবং এর উৎসস্থল কীভাবে আরও সংকট তৈরি করতে পারে সে সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা বাড়তি পাওনা হতে পারে।

স্রােয়েকো হোরবেট: আমাদের হাতে যেহেতু সময় কম, আমি শুধু শেষ একটি প্রশ্ন রাখতে চাই। হ্যা, আমি মনে করি অনেক মানুষ আগ্রহী এবং আমরাও, যারা দশকের পর দশক ধরে সামাজিক আন্দোলনে সক্রিয় রয়েছি, মোবিলাইজড ও সংগঠিত  হচ্ছি, মানুষে মানুষে শারীরিক এবং সামাজিক ঘনিষ্ঠতার মাধ্যমে। তবে এখন হঠাৎ করে আমরা সবাই এমন একটা বিষয়ে অভ্যস্ত হতে চলেছি যাকে বর্তমানে ‘সামাজিক দূরত্ব’ বলা হচ্ছে। সুতরাং, আমার প্রশ্ন হলো, সোসাল ডিসট্যান্সের সময়ে সামাজিক প্রতিরোধের ভবিষ্যতকে আপনি কীভাবে দেখছেন? এবং এটি যদি আরও কয়েক মাস সময় নেয়, বলার অপেক্ষা রাখে না, এক বছর বা দুই বছর যদি হয় এবং আমরা প্রধানত বাসায় সেল্ফ আইসোলেশনে থাকি, সারাবিশ্বের প্রগতির পক্ষের এক্টিভিস্ট, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষার্থী, শ্রমিকদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী হবে? এই নতুন পরিস্থিতিতে তারা কীভাবে সংগঠিত হবেন? এবং আপনি কোনো আশা দেখেন কিনা সম্ভবত সে সম্পর্কেও আমাদের বলতে পারেন যে একটি বৈশ্বিক কর্তৃত্ববাদে পতিত হওয়ার বিপরীতে, এই উন্মুক্ত ঐতিহাসিক পরিস্থিতি একটি বৈপ্লবিক রূপান্তরের দিকে যাবে কিনা, যেটি হবে সবুজ, সমান, ন্যায় এবং সংহতিপূর্ণ?

নোম চমস্কি: সর্বপ্রথম, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বিগত কয়েক বছর ধরেই সামাজিক বিচ্ছিন্নতার একটি রূপ চালু রয়েছে, যা খুবই ক্ষতিকর। এখন আপনি ম্যাকডোনাল্ডের একটি শপে যান এবং একগুচ্ছ তরুণদের দিকে তাকিয়ে দেখুন, টেবিলের চারিপাশে তারা বসে আছে, হ্যামবার্গার খাচ্ছে, আপনার চোখে যা পড়বে তা হলো সেখানে দুটি কথোপকথন চলছে। তাদের মধ্যে এক ধরনের হালকা আলাপ চলছে, আরেকটি হলো সেলফোনে দূরের কোনো এক ব্যক্তির সাথে চলানো কথোপকথন। এটা বেশ অস্বাভাবিক মাত্রায় মানুষকে ক্ষুদ্রতর ও বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। সমাজ বলতে কিছু নেই থ্যাচারের এই নীতিটি আরও দূর বর্ধিত হয়েছে, সামাজিক মাধ্যমগুলোর অপব্যবহার যা মানুষকে বিশেষ করে তরুণদের মারাত্মক বিচ্ছিন্ন প্রাণী হিসেবে গড়ে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রে সত্য সত্যই এমন বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেগুলোর ফুটপাতে “দেখে চলুন“ লেখা ফলক টাঙানো থাকে, কারণ হেঁটে চলা প্রতিটি ছেলেপেলেই নিজের মধ্যে সেঁটে থাকে। এটা স্ব-প্রণোদিত সামাজিক বিচ্ছিন্নতারই একটা রূপমাত্র, এটা চরম ক্ষতিকর। আমরা এখন সত্যিকারের সামাজিক বিচ্ছিন্নতার পরিস্থিতিতে এসে পড়েছি। যেকোনো উপায়েই হোক সামাজিক বন্ধন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে আমাদের এটা উৎরাতে হবে, যাদের সাহায্য দরকার তা সে যে কোনো উপায়েই হোক না কেন, সাহায্য করতে হবে। তাদের সাথে যোগাযোগ রেখে, সংগঠন দাঁড় করিয়ে, বিশ্লেষণের মাত্রা বাড়িয়ে, এবং পূর্বের মতোই আমি সেগুলোকে কার্যকর ও সক্রিয় করে তুলতে বলছি, ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা তৈরি করে, মানুষকে একসাথে নিয়ে আসতে হবে, ইন্টারনেটের যুগে সেটা খুবই সম্ভব, সবাইকে এক করে সামনে আসা সমস্যাগুলোর সমাধান বের করতে সুচিন্তিতভাবে আলোচনা করতে হবে, এসব সম্ভব, যদিও এই প্রক্রিয়া সামনা-সামনি  যোগাযোগের মতো নয়, মানুষের জন্য যা অপরিহার্য। তবে কিছুদিনের জন্য তা ব্যহত হবে, এটা কিছুদিনের জন্য থামিয়ে রেখে ভিন্ন উপায় খুঁজতে হবে, এবং কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে, আরও গভীর ও বিস্তৃতভাবে হয়তো চালিয়ে নেয়া যাবে। সহজ হবে না, তবে মানুষ আগেও সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। (কুকুরের ডাকে কথা থেমে যায়)

স্রােয়েকো হোরবেট: আমি কি একটি প্রশ্ন রাখতে পারি যেহেতু আমরা দুজনই সেল্ফ-আইসোলেশনে রয়েছি?

নোম চমস্কি: আমরা কুকুর আলাপচারিতায় অংশ নিতে চাচ্ছে। 

স্রােয়েকো হোরবেট: এর আগে কি ওটা তোতাপাখি ছিল? সেখানে একটি পাখির শব্দের মতো শুনতে পেয়েছিলাম, সেটি কি তোতাপাখি ছিল?

নোম চমস্কি: হ্যা, তোতাপাখি, এটি পর্তুগিজ ভাষায় বলতে পারে: সকল মানুষের প্রতি সার্বভৌমত্ব।

(উভয়ের মৃদু হাসি)

নুরে আলম দুর্জয়