অরাজ
আর্টওয়ার্ক: বার্ড অফ ওয়ার শিল্পী: মোহসেন জারিফিয়ান সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট
প্রচ্ছদ » টিমোথি স্নাইডার ।। স্বৈরতন্ত্র : বিশ শতক থেকে বিশটি শিক্ষা

টিমোথি স্নাইডার ।। স্বৈরতন্ত্র : বিশ শতক থেকে বিশটি শিক্ষা

  • অনুবাদ: ইরফানুর রহমান রাফিন

সম্পাদকীয় নোট: টিমোথি স্নাইডার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসশাস্ত্রের লেভিন অধ্যাপক। তিনি ব্লাডল্যান্ডস: ইওরোপ বিটউইন হিটলার অ্যান্ড স্ট্যালিন এবং ব্ল্যাক আর্থ: দ্য হলোকাস্ট অ্যাজ হিস্টোরি অ্যান্ড ওয়ার্নিং গ্রন্থের রচয়িতা। স্নাইডার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হলোকাস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়ামের দ্য কমিটি অন কনসায়েন্সের একজন সদস্য এবং ভিয়েনার দি ইন্সটিটিউট অফ হিউম্যান সায়েন্সেসের একজন স্থায়ী ফেলো।

এই রচনাটি  On Tyranny গ্রন্থের প্রক্ষেপন মাত্র।  টিমোথি স্নাইডার বিশ শতকে নানা স্বৈরতান্ত্রিক রেজিমের শাসন প্রণালী পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন যে, এর বিরুদ্ধে কী করণীয়। এই করণীয়গুলোর অনেক কিছুই নৈরাজ্যবাদী চিন্তনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিশেষত রাষ্ট্র, নির্বাচন, দেশবাদিতার মত বিষয়গুলোকে তিনি ধারণ করেছেন। আবার কতক ‘করণীয়’ বেশ আগ্রহ সৃষ্টি করে। তাই তাঁর অালোচনা অরাজের পাঠকরা পর্যালোচনা করতে পারে।

আর্টওয়ার্ক: দ্য টিরান্ট
শিল্পী: ম্্যাত্তেো বার্তেলি
সূত্র কার্টুন মুভমেন্ট

মূল আলোচনা
আগ বাড়িয়ে অনুগত হবেন না

কর্তৃত্ববাদে অধিকাংশ ক্ষমতাই এমনভাবে প্রদত্ত যে, তা একবারেই লাগামছাড়া। এই বিশেষ   মুহুর্তগুলোতে লোকজন আগে থেকেই বুঝে ফেলে, একটা  নিপীড়ক সরকার কি চায়। আর এরপর সেই সরকার কিছু চাইবার আগেই এরা নিজেদেরকে সঁপে দেয়। একজন নাগরিক, যিনি এভাবে খাপ খাইয়ে চলেন, তিনি আসলে  শিখিয়ে দেন ক্ষমতার পক্ষে আর কী কী করা সম্ভব।

প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষা করুন
প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের সুকুমারবৃত্তি রক্ষায় সহায়তা করে। আবার তাদেরও আসলে আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন। কিন্তু যতোক্ষণ না আপনি এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজের করে না নিচ্ছেন এবং তার জন্য কাজ করছেন, এগুলোকে  ‘আমাদের প্রতিষ্ঠান’ বলে আখ্যা দেবেন না। প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা নিজেদেরকে রক্ষা করে না। শুরু থেকেই তাদেরকে রক্ষা না করলে একটার পর একটা প্রতিষ্ঠানের পতন ঘটে। তাই এমন প্রতিষ্ঠান বেছে নিন, যাকে আপনি তোয়াক্কা করেন—  হতে পারে তা আদালত, সংবাদপত্র, আইন, শ্রমিক ইউনিয়ন— আর তার পক্ষে দাঁড়ান।

একদলীয় রাষ্ট্রের ব্যাপারে সাবধান
যে পার্টিগুলো রাষ্ট্রকে পুনর্গঠন করেছে এবং প্রতিপক্ষকে দমন করেছে তারা শুরু থেকেই সর্বশক্তিমান ছিলো না। তারা একটা ঐতিহাসিক মুহূর্তের সুযোগ নিয়েছে নিজেদের প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক জীবনকে অসম্ভব করে তোলার জন্য। তাই বহুদলীয় ব্যবস্থাকে সমর্থন করুন এবং গণতান্ত্রিক নির্বাচনের নিয়মকানুনকে রক্ষা করুন। স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিন, যতোদিন সেই অধিকার আপনার হাতে থাকে। ভোটে দাঁড়ানোর অপশনটাও বিবেচনা করুন।

দুনিয়ার জন্য দায়িত্ব নিন
আজকের প্রতীক আগামির বাস্তবতা নির্মাণ করে। স্বস্তিকা এবং ঘৃণা ছড়ানোর অন্যান্য চিহ্ন লক্ষ্য করুন। এড়িয়ে যাবেন না,এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বেন না। এ প্রতীকগুলো বর্জন করুন এবং  অন্যদের জন্য  দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন।

পেশাগত নৈতিকতা মনে রাখুন
রাজনীতিবিদরা যখন একটা নেতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, ন্যায়ানুগ চর্চার প্রতি পেশাগতভাবে অটল থাকা আরো বেশি জরুরি হয়ে পড়ে। আইনজীবী ছাড়া আইনের শাসনের বারোটা বাজানো কঠিন, অথবা বিচারক ছাড়া লোকদেখানো বিচারের আয়োজন করা। কর্তৃত্ববাদীদের প্রয়োজন হয় বশ মানা সিভিল সার্ভেন্ট, আর কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের পরিচালকরা খুঁজতে থাকে সস্তা শ্রমে আগ্রহ থাকা ব্যবসায়ীদের।

আধাসামরিক বাহিনীগুলোর ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হোন
যখন নিজেদেরকে সবসময় ব্যবস্থার বিরোধী দাবি করা বন্দুকবাজ লোকদের গায়ে উর্দি চাপতে এবং মশাল ও কোনো নেতার ছবি নিয়ে মিছিল করতে দেখবেন, বুঝবেন কেয়ামতের বেশিদিন বাকি নেই। আর যখন নেতাপন্থী আধাসামরিক বাহিনী আর আনুষ্ঠানিক পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে দেখবেন, বুঝবেন কেয়ামত এসে গেছে।

যদি অস্ত্র ধারণ করতে হয়, চিন্তাশীল হোন
আপনি যদি সরকারি চাকরির জন্য অস্ত্র ধারণ করেন, খোদা আপনার মঙ্গল করুন এবং আপনাকে রক্ষা করুন। কিন্তু জেনে রাখবেন, অতীতে দুষ্টচক্র পুলিশ ও সৈন্যদের ব্যবহার করেছিল খোদ তাদেরকেই খুঁজে বের করতে, অতীতের অনিয়মের জন্য। অতএব না বলার জন্য প্রস্তুত থাকুন।

রুখে দাঁড়ান
কাউকে না কাউকে তো এটা করতেই হবে। গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়া সহজ। ভিন্ন কিছু বলতে বা করতে গেলে অদ্ভূত লাগতে পারে। কিন্তু ঐ অস্বস্তিবোধটুকু ছাড়া কোনো স্বাধীনতা নাই। রোজা পার্কসের কথা স্মরণ করুন। যেই মুহূর্তে আপনি একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন, রাষ্ট্রীয় বিধি-বন্দোবস্তর ঘোর কেটে যাবে এবং অন্যরাও রুখে দাঁড়াতে শুরু করবে।

আমাদের ভাষার প্রতি সদয় হোন
সবাই যেসব প্রত্যয় ব্যবহার করে সেগুলো তোতার মতো আউড়ানো থেকে বিরত থাকুন। কথা বলার নিজস্ব একটা ভঙ্গি দাঁড় করান, এমনকি সেটা যদি সবাই যা বলছে তা প্রকাশ করার জন্যেও হয়। নিজেকে ইন্টারনেট থেকে আলাদা করার একটা প্রয়াস নিন। বই পড়ুন।

সত্যে বিশ্বাস করুন
সংঘটিত সত্যকে বিসর্জন দেয়ার অর্থ স্বাধীনতা বিসর্জন দেয়া। যদি কিছুই সত্য না হয়, তাহলে কেউই ক্ষমতার সমালোচনা করতে পারে না, কারণ সেটা করার কোনো ভিত্তিই আর থাকে না। যদি কিছুই সত্য না হয়, তাহলে সবই দৃশ্য। সবচে মোটা মানিব্যাগটা সবচে বেশি চোখ ধাঁধানো আলোর মূল্য পরিশোধ করে।

অনুসন্ধান করুন
কী ঘটেছে সেটা নিজেই খুঁজে বের করুন। দীর্ঘ প্রবন্ধ পাঠে বেশি সময় দিন। প্রিন্ট মিডিয়া সাবস্ক্রাইব করার মাধ্যমে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে ভর্তুকি দিন। এটা অনুধারবন করতে শিখুন যে, ইন্টারনেটে যা কিছু আছে তার একটা অংশ আপনার ক্ষতি করার জন্য আছে। প্রচারণা ক্যাম্পেইন (যার একাংশ দেশের বাইরে থেকে আসে) খতিয়ে দেখে এমন সাইটগুলো সম্পর্কে জানুন। অন্যদের সাথে যা শেয়ার করছেন তার ব্যাপারে দায়িত্ব নিন।

দৃষ্টি বিনিময় করুন এবং সামান্য বাতচিত করুন
এটা শুধু ভদ্রতার বিষয় না। এটা একজন নাগরিক ও সমাজের একজন দায়িত্বশীল সদস্য হওয়ার অংশ। এটা আপনার পরিপার্শ্বের সংস্পর্শে থাকার, সামাজিক বাধাগুলো ভেঙে ফেলার, এবং কাকে বিশ্বাস করতে হবে ও কাকে বিশ্বাস করা যাবে না সেটা অনুধাবন করার একটা পদ্ধতিও বটে। আমরা যদি প্রত্যাখ্যানের একটা সংস্কৃতিতে প্রবেশ করি, আপনি আপনার দৈনন্দিন জীবনের মনস্তাত্ত্বিক ভূচিত্রটা জানতে চাইবেন।

দৈহিক রাজনীতির চর্চা করুন
ক্ষমতা চায় আপনার শরীর  চেয়ারে আরাম প্রিয় হয়ে উঠুক এবং আপনার সব আবেগ স্ক্রিনেই উবে যাক। ঘরের বাইরে বের হোন। আপনার শরীরটাকে অপরিচিত জায়গায় অপরিচিত লোকজনের কাছে নিয়ে যান। নতুন বন্ধু বানান এবং তাদের সাথে পা মেলান।

একটা ব্যক্তিগত জীবন গড়ে তুলুন
নোংরা শাসকরা আপনার ব্যাপার যা জানে তা আপনাকে কোনঠাসা করার জন্য ব্যবহার করবে । আপনার কম্পিউটার থেকে নিয়মিত ভিত্তিতে ম্যালওয়ার সরান। মনে রাখবেন ইমেইল হচ্ছে আকাশলিখন। ইন্টারনেটের বিকল্প ধরন ব্যবহার করার কথা বিবেচনা করুন, অথবা স্রেফ এটা কম ব্যবহার করুন। ব্যক্তিগত বিনিময়গুলো হাতে হাতে করুন। একই কারণে, আইনি যে-কোনো ধরনের ঝামেলা থাকলে তা নিরসন করুন। স্বৈরতন্ত্রীরা দড়ি খোঁজে আপনাকে ঝুলিয়ে দেয়ার জন্য। চেষ্টা করুন যাতে দড়িতে ঝুলতে না হয়।

ভালো কর্মে অবদান রাখুন
রাজনৈতিক হোক বা না হোক, জীবন সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে, এমন সংগঠনে সক্রিয় হোন। একটা বা দুইটা চ্যারিটি বেছে নিন এবং অটোপে চালু করুন। তাহলে আপনি নিজেকে একটি স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, যা কিনা নাগরিক সমাজকে সাহায্য করে এবং অন্যদেরকে ভালো কাজে সহায়তা করে।

ভিনদেশি বন্ধুদের কাছ থেকে শিখুন
বন্ধুত্বগুলোকে দেশের সীমানার বাইরেও টিকিয়ে রাখুন, অথবা বিদেশে নতুন বন্ধু বানান। বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেসব সংকট দেখা দিচ্ছে তা বৃহত্তর একটা প্রবণতার উপাদান। আর দুনিয়ার কোনো দেশই নিজে নিজে কোনো সমস্যার সমাধান বের করতে পারবে না। নিশ্চিত করুন আপনার ও আপনার পরিবারের সদস্যদের পাসপোর্ট করা আছে কিনা।

আর্টওয়ার্ক: ফ্রিডম
শিল্পী: এন্টনিও রডরিগেজ
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

ভয়ঙ্কর শব্দগুলোর জন্য কান পেতে রাখুন
উগ্রপন্থা এবং সন্ত্রাসবাদ জাতীয় শব্দ ব্যবহারে সতর্ক হোন। জরুরি অবস্থা আর ব্যতিক্রমী অবস্থা জাতীয় মারাত্মক শব্দের ব্যাপারে সজাগ থাকুন। দেশপ্রেমের অভিধানের বেইমানিমূলক ব্যবহার দেখলে ক্ষিপ্ত হোন।

যখন অচিন্তনীয়ের আগমন ঘটে, শান্ত থাকুন
আধুনিক স্বৈরতন্ত্র হচ্ছে সন্ত্রাস-ব্যবস্থাপনা। যখন সন্ত্রাসবাদী হামলা ঘটে, মনে রাখুন স্বৈরতন্ত্রীরা এই ধরনের ঘটনাকে ক্ষমতা সংহত করার কাজে ব্যবহার করে। আকস্মিক বিপর্যয় যার জন্য ক্ষমতার ভারসাম্যে ইতি টেনে দিতে হয়, বিরোধী দলগুলোকে বিলুপ্ত করে দিতে হয়, চিন্তা প্রকাশের ও সুষ্ঠু বিচারের অধিকার কেড়ে নিতে হয় এবং ইত্যাদি ইত্যাদি… এগুলো হচ্ছে হিটলারি কেতাবের পুরনোতম কূটকৌশল। এসবে মজবেন না।

দেশপ্রেমিক হোন
আসন্ন প্রজন্মগুলোর জন্য আমেরিকার অর্থটা কী হবে তাঁর একটা ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। তাদের এটার প্রয়োজন হবে।

যতোটা সাহসী হওয়া আপনার পক্ষে সম্ভব, ততোটাই হোন
যদি আমাদের কেউই স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত না থাকে, তাহলে আমরা সকলেই স্বৈরতন্ত্রের হাতে মারা পড়বো।

ইরফানুর রহমান রাফিন

ইরফানুর রহমান রাফিনের জন্ম ১৯৯২এ, ঢাকার শাহবাগে। হোম টাউন কুমিল্লা। বিদ্যাশিক্ষা শহিদ বাবুল একাডেমী, সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ, এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পেশাগত জীবনের শুরু বাংলাদেশ অধ্যয়ন কেন্দ্র (সিবিএস) গবেষণা সহকারী হিসেবে, পরবর্তীতে মানব উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্রে (এইচডিআরসি) গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন, বর্তমানে তাসফিয়া তানজিম আহমেদ প্রমার সাথে ব্রেড অ্যান্ড রোজেস নামক একটি অনুবাদমূলক লেখালিখির উদ্যোগে প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে আছেন। ধর্ম থেকে ইতিহাস আর রাজনীতি থেকে সংস্কৃতি বহু বিষয়ে অপার আগ্রহ আছে তার, এসব বিষয়ে নিজের ওয়েবসাইটে লেখেন, এছাড়াও পত্রপত্রিকায় ও ওয়েব পোর্টালে তার লেখা ছাপা হয়েছে। প্রকাশিত বইঃ চলে যাওয়া সময় (কবিতা, আনন্দম: ২০১৯) এবং এক অসাধারণ অন্ধ সময়ের স্মৃতি (উপন্যাস, [কলকাতা] কাউন্টার এরাঃ২০২০ [ঢাকা] আফসার ব্রাদার্স: ২০২১)। ইমেইল যোগাযোগ: irrafin2020@gmail.com।