অরাজ
শিল্পী : মিতা মেহেদী সূত্র: ফেসবুক
প্রচ্ছদ » ইতিহাস-কর্তৃত্ব-মুক্তি ।। প্রথম পর্ব

ইতিহাস-কর্তৃত্ব-মুক্তি ।। প্রথম পর্ব

  • আরিফ রেজা মাহমুদ

ইতিহাসের লক্ষণ হচ্ছে পরিপ্রেক্ষিত বিচার। তার শুরু বর্তমান থেকেই। বর্তমানে উত্থাপিত প্রশ্নের মীমাংসার সূত্র ধরেই। বর্তমান থেকে অতীতে যাওয়া তখনই, যখন অতীত সম্পর্ক —অতীত পরিপ্রেক্ষিত,বর্তমান সম্পর্ক —বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতকে ব্যাখ্যা করে। ধারাবাহিকতা নির্মাণ করে। নির্দেশ করে ভবিষ্যতের। তাই ইতিহাস হল পরিপ্রেক্ষিতায়ন।

ইতিহাস চেতনা ক্ষমতা নিরপেক্ষ কোন বিষয় নয়। জ্ঞানকাণ্ডে ক্ষমতা-ক্ষমতার বিন্যাসে অসমতার বাড়বাড়ন্ত যেমন প্রবাহমান, ইতিহাস চেতনার নির্মাণেও তেমনি তার নড়চড় হয়নি এতটুকু। এ পর্যন্ত বিদ্যাজীবীর জবানে লিখিত পৃথিবীর ইতিহাস কর্তৃত্বের ইতিহাস। ক্ষমতাধর এলিট আধিপত্যের ইতিহাস। রাজশক্তির উত্থান-পতন, রাজশাসনের ভাবদর্শিক বৈধতা উৎপাদন তার প্রসঙ্গ। ইতিহাস রচনা থেকে তাই বাদ পড়ে প্রান্তজনের কথা। নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের অস্তিত্ব, তার চেতনা-তার প্রতিরোধ, দৈনন্দিন জীবনে তার টানাপোড়েন সবকিছুই তাই মুছে  যায় বিদ্বৎসমাজের বয়ানে। এমন ঘটনা আমাদের সামনে উদ্রেক করে বেশ কিছু প্রশ্নের। জ্ঞান কী? কে বা কারা জ্ঞান উৎপাদন করে? জ্ঞানের ভোক্তা কারা? ভোক্ত সম্পর্কে জ্ঞান উৎপাদকের নজর-আন্দাজ কী? ভোক্তা কি সক্রিয় নাকি নিস্ক্রিয়? পশ্চিমে একাডেমিতে এ নিয়ে মুল ধারার ইতিহাসকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে দেখা গেলেও আমাদের দেশের হকিকত সম্পূর্ণ ভিন্ন। এসব কিছুরই দুর্দান্ত ইশারা পাচ্ছি রেহনুমা আহমেদের কাছে।

শাস্ত্রীয় জ্ঞান হিসেবে চর্চিত এ যাবৎকাল অবধি এদেশের ইতিহাস চর্চায় ইতিহাসের কোন সংঙ্গা ব্যবহার করা হয়েছে–ইতিহাস কি ‘অতীত’ নাকি ইতিহাস হচ্ছে ‘বর্তমান’ ? ইতিহাসের ভিন্ন সংঙ্গা ব্যবহার করলে  ইতিহাসবিদরা কি একই বিষয়ে গবেষণা করে ভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারেন?  এদেশের ইতিহাস-রচনা মুলত কোন পক্ষের স্বার্থ অবলম্বন করছে, শাসকের নাকি শোষিতের? বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের ইতিহাস রচনা বাঙ্গালিদের মঞ্চের প্রধান নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করতে গিয়ে অন্যান্য জাতিদের কী উপায়ে- কোন ধরনের যুক্তি তর্ক কোন ধরনের ঐতিহাসিক নজিরের সাহায্যে- ইতিহাসের পাতা থেকে বাদ দিয়েছে? দু:খজনক হলেও সত্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত ইতিহাসবিদরা এ ধরনের জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হননি।

আমাদের দেশের ইতিহাস চর্চার সংকটের একবারে মোদ্দা জায়গাটাকে চি‎হ্নিত করেছেন রেহনুমা। প্রশ্ন তুলেছেন আমাদের ইতিহাস চর্চার অধিপতি ধারা জাতীয়তাবাদের সংকট নিয়ে। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধে প্রান্তজনের চেতনা, প্রান্তজনের অংশীদারিত্বকে গায়েব করে, যে জাতীয়তাবাদ শাসক-শোষক-নিপীড়ক-নিপীড়িত-প্রবল-প্রান্তিক সবাইকে এক ছাঁচে তৈয়ার করে —আধিপত্য-শোষণ-বঞ্চনাকে আড়াল করে ইতিহাস চর্চায় তৎপর, তার গোড়ার গলদটা কোথায় ? এই প্রবন্ধের  মূলসুত্র বা কেন্দ্রীয় প্রশ্ন সেটাই। জাতীয়তাবাদী ইতিহাস চর্চায় মৌলবাদ তথা ঘুরপাকের যে সংকট তা থেকে উত্তরণে কী কী নতুন টোপ হাজির হয়েছে তা তদন্ত করা এই প্রবন্ধের আরেকটি উদ্দেশ্য।

আর্টওয়ার্ক: প্রিজন আর্ট সিরিজ
শিল্পী: কামরুল হাসান
সূত্র: মিউচুয়াল আর্ট

ভারতবর্ষে ইতিহাস-বিদ্যার আদিকল্প: উচ্চকোটির ইতিহাসের আঁতুড়ঘর নিরীক্ষণ

ভারতবর্ষে ইতহাস চর্চাকে নতুন প্রশ্ন তথা তত্ত্বের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন নিম্নবর্গের ইতিহাস রচয়িতারা। রনজিৎ গুহ-গৌতম ভদ্র-পার্থ চট্টপাধ্যায় প্রমুখের হাত ধরে উন্মোচিত হয়েছে ভারতবর্ষের কর্তৃত্বপরায়ন ইতহাস চর্চার আকর। ঐতিহাসিকভাবে কেমন করে ভারতের ইতিহাস চর্চা স্রেফ জাতীয়তাবাদের ঘেরাটপে আটকে পড়েছে তা পষ্ট করেছেন তাঁরা। নিম্নবর্গের ইতিহাস  প্রবন্ধে রনজিৎ গুহ দেখিয়েছেন, ভারতবর্ষে আধুনিক ইতিহাস চর্চার শুরুয়াদ ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন থেকে নয়, ইংরেজ শাসন ব্যবস্থা থেকে। রনজিতের অভিমত, ইংরেজরা পাশ্চাত্য শিক্ষার আদলে আমাদের দীক্ষিত করতে ইতিহাস বিদ্যার আমদানি ঘটায়নি, ভারতবর্ষে ইতিহাস ইংরেজ শাসনের হাতিয়ার হয়েছে আরও আগে। ১৭৬৫ তে যখন কোম্পানি দেওয়ানি পেল কিম্বা তারও কিছু আগে নবাব যখন তাদের তিনটা জেলা দিয়ে দিলেন তখন থেকে। রনজিৎ গুহের মতে:

এদেশে পাশ্চাত্য ইতিহাস চেতনাকে প্রথম ব্যবহার করা হযেছিল লিবারেল আদর্শের উৎসাহে নয়, রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে ও তাগিদে। দেওয়ানি হাতে নিয়েই ইংরেজ টের পায় যে  এদেশের কৃষি ব্যবস্থা অতিপ্রাচীন, জমির সঙ্গে রাজা-প্রজার সম্পর্ক এখানে নানা সনাতন প্রথায় নিয়ন্ত্রিত এবং জমির মালিকানা ফসল বোনার কায়দা ইত্যাদি সবকিছুই এক সাবেক সংস্কারের অঙ্গ। অতীতকে উপেক্ষা করে এখানে রাজস্ব সংগ্রহ সম্ভব নয়। তাই সে যুগের সরকারি কাগজপত্রে ঐতিহাসিক বিবৃতির অভাব নেই… প্রাকবৃটিশ, বিশেষ করে মোঘল আমলের রাজ্যশাসন, ভূসম্পত্তির অধিকার, কৃষি ব্যবস্থা, বাণিজ্য ব্যাপার ইত্যাদি, সংক্ষেপে বলতে গেলে রাজনৈতিক অর্থিৈনতক জীবনের বহু প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা এইসব কাগজপত্রে হামেশায় পাওয়া যায়।… এইসব রচনায় তথ্য ও যুক্তির সমন্বয় এবং কার্যকরণ সূত্রে সাজানোর বিশ্লেষণ পদ্ধতির মধ্যে আধুনিক ইতিহাস বিদ্যার প্রধান গুনগুলি সবই বর্তমান।

আধিপত্যশীল চেতনা থেকেই যে ভারতবর্ষে ইতহাস বিদ্যার শুরুয়াদ তা  রণজিৎ গুহের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট।  ইতিহাস চর্চার এই আদিকল্পটির আদল বিশ্লেষণ করে রনজিৎ গুহ দেখিয়েছেন জন্মলগ্ন থেকে কেমন করে  ভারতবর্ষের  ইতিহাস রচনায় ঔপনিবেশিক উচ্চবর্গ এবং বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী উচ্চবর্গেরই আধিপত্য প্রবাহমান।

প্রথমত এই ইতিহাস বিদ্যার আদিকল্পের দুটো জন্মলক্ষন চি‎হ্নিত করেছেন রনজিৎ। রনজিতের বক্তব্যই সংক্ষেপে তুলে ধরছি:

১. এই ইতিহাসবিদ্যার জন্ম ইংরেজ রাজশক্তির ঔরসে এবং ভূমিষ্ট হবার পর থেকেই তা উপনিবেসিক শাসনদণ্ডকে আশ্রয় করে বেড়ে ওঠে। যারা এ ধারায় প্রথম ইতিহাস লেখেন তারা সরকরি কর্মচারি কিংবা সরকারের প্রসাদপুষ্ট। তারা যে ইতিহাস লেখেন, তার উদ্দেশ্য হয় সরকারি শাসনব্যবস্থাকে সিদ্ধ করা কিংবা বেসরকারি রচনা হলেও তার সাহায্যে ব্রিটিশ প্রভুশক্তি ও প্রভু সংস্কৃতিকে আরও জোরদার করা।

২. এই ইতিহাসবিদ্যার আরেকটি জন্মলক্ষণ হচ্ছে উচ্চবর্গের প্রতি পক্ষপাতিত্ব। এই পক্ষপাতিত্ব শাসকদের মনোভাবেরই প্রতিফলন। ১৮ শতকের ব্রিটিশ সমাজের আদর্শ অনুযায়ী, কোম্পানি কর্তৃপক্ষের ধারণা হয় যে, এদেশেও সমাজের প্রধান স্তম্ভ সেইসব সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যারা বেশ বড় বড় ভূসম্পত্তির মালিক, এবং তাদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া হলেই রাজস্ব আদায় ও প্রশাসনের সমস্যা মিটে যায়। এরই ফলে এদেশীয় উচ্চবর্গের স্বার্থ ও সুবিধা একই সঙ্গে স্বীকৃতি পায় উপনিবেশিক রাষ্ট্রনীতিতে ও ঔপনিবেশিক ইতিহাসবিদ্যায়।

ইংরেজ আমলের রাজনৈতিক জীবন বিশেষ করে জাতীয় আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদের সমস্যা নিয়ে যে বিরাট সাহিত্য গড়ে উঠেছে তা দুটো প্রতিকল্পকে আশ্রয় করে লেখা। দুটিই উচ্চবর্গের দৃষ্টিভঙ্গির বাহন। উভয়ের প্রতিপাদ্য এই যে, সে যুগের রাজনীতি বলতে প্রধানত এমনকি কেবলমাত্র উচ্চবর্গের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা, আদর্শ ও কর্মকাণ্ডকেই বুঝায়। এবং জাতীয়তাবাদ সেই রাজনীতিরই মূখ্য প্রকাশ।

১. প্রথম ধারাটির বৈশিষ্ট্য ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রশক্তি এবং তারই সহায় ও ফলগত ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির আলোকে ভারতবর্ষের ইতিহাস বিচার করা। এর মূল কথা হচ্ছে, ভারতবাসীর এক জাতীয়তা বলতে যা বোঝায়, তার বাস্তব সংগঠন ও চৈতন্যরূপ ইংরেজ শাসন, তৎসংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক আদর্শ এবং ব্যক্তিগতভাবে কোন কোন শাসকের ও সমষ্টিগতভাবে শাসকগোষ্ঠীর প্রতিভার ফল।

২. অপরপক্ষে দ্বিতীয় প্রতিকল্পটির ছাঁচে সাজানো ইতিহাসবিদ্যায় জাতীয় আন্দোলনকে উচ্চবর্গের নেতৃত্ব-উদ্বুদ্ধ ও চালিত নির্ভেজাল আদর্শবাদী সংগ্রামের চেহারা দেওয়া হয়। এই ধরনের ব্যাখ্যা প্রধানত ভাতীয় ঐতিহাসিকদেরই কাজ। তবে বিদেশে লিবারল চিন্তাধারায়ও এর প্রকাশ বিরল নয়। জাতীয় সংগ্রামের নায়ক রূপে উচ্চবর্গের অবদান সর্বস্বীকৃত। এমনকি জাতীয় সংগ্রাম উচ্চবর্গের মাহাত্ম ও আদর্শনিষ্ঠার কাহিনীমাত্র। এবং এই প্রতিপাদ্যটিকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য ইংরেজদের সঙ্গে তাদের সহযোগিতার চেয়ে বিরোধিতার দিকটাই বাড়িয়ে দেখা হয়। শোষক ও উৎপীড়ক হিসেবে তাদের সামাজিক ভূমিকা প্রায় অস্বীকার করেই জনসেবায় তাদের অগ্রণী ভূমিকার কথা বলা হয়। জাতীয় আন্দোলনের রাজনীতি ব্যবহার করে তারা যে রাজদত্তক ক্ষমতা ও সুযোগ সুবিধা গৌন ভাগ নিয়ে কাড়াকাড়ি মারামারিতে লিপ্ত ছিলো সে কথা চেপে গিয়ে শোনানো হয় স্বার্থলেসহীন আত্মত্যাগের অলীক রূপকথা। এভাবেই বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের জনগণের বিশাল আন্দোলনগুলো পরিণত হয়েছে উচ্চবর্গের সংকীর্ণ জীবনবৃত্তান্তে।

ভারতবর্ষে ইতিহাস চর্চার এই আধিপত্যশীল চেতনা আজও প্রবল প্রতাপে টিকে আছে। খোলনলচে এতটুকু বদলায় নি। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের বহুত্ববাদী চরিত্র সবকিছুই জাতয়িতাবাদী আধিপত্যের দাপটে উচ্চকোটির সম্পদে পরিণত হয়েছে। প্রান্তজনের স্বর,প্রান্তজনের চেতনা এই ঐতিহাসিক বয়ানে তাই একবারেই অনুপস্থিত।

একাত্তুর-পাবলিক-রিপাবলিক : জাতীয়তাবাদী আধিপত্যের সাতকাহন কিংবা ইতিহাস কারকানায় প্রান্তজনের বিতাড়ন

একাত্তুর রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের প্রশ্ন নয়— ঔপনিবেশিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যায্য অগণতান্ত্রিক শাসনের স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙ্গে একটি স্বাধীন রিপাবলিক গঠনের সোচ্চার উচ্চারণ। দীর্ঘ রাজনৈতিক গণসংগ্রামের মধ্য দিয়ে  বাংলাদেশ নামের  যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হল, তা কীকরে ক্ষমতার দিক থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্রেরই প্রেতাত্মা হয়ে দেখা দিল,তা একটি বড় প্রশ্ন। এই প্রশ্ন মোকাবেলা না করলে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের বহুত্ববাদী চরিত্রটি কীকরে লোপাট হয়ে গেল তা টের পাব না। তবে তার আগে কীসের ভিত্তিতে কীভাবে একটি রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা হয় সেই আলোচনাই ঢুকব আমরা।

রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে রিপাবলিক ধারনাটিকে দাসত্ব মুক্তির হাতিহারে রূপান্তর করেছেন ফরাসি চিন্তাবিদ রুশো (১৭৭২-১৭৭৮)। রাজশাসনের হাত থেকে ক্ষমতাকে জনগনের হাতে ন্যাস্ত করার তাত্বিক ভিত্তি নির্মাণ করেছেন তিনি। রুশোর কাছে রাষ্ট্র হচ্ছে একটা সামাজিক চুক্তি, যে সামাজিক চুক্তির ভিত্তি হচ্ছে জনগনের সাধারণ সংকল্প।

আমাদের এমন একটা সংস্থা তৈরি করতে হবে যার মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রত্যেকের অস্তিত্ব ও সম্পদকে রক্ষার জন্য সমগ্র সংস্থার শক্তিকে এমনভাবে বিন্যস্ত করতে পারি যাতে আমরা যখন সমগ্রর সাথে মিলিত হই তখন আমার নিজেদের সম্মতিতে নিজেদের ইচ্ছারই মাত্র অনুগত হই এবং স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আমাদের স্বাধীনতা এবং শক্তি পূর্বের মতোই অক্ষত থাকে। … সম্মতির ভিত্তিতে সমাজ সংস্থা যখনই বাস্তব রূপ লাভ করে তখনই এই সংস্থা প্রত্যেকটি সদস্যের জন্য সমগ্র সংস্থার নৈতিক এবং যৌথ শক্তি সহকারে প্রতিটি সদস্যের পাশে এসে বিত্রস্ত শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে উপস্থিত হয়। এবং এরই পরিণামে সমাজসংস্থার নবতর অস্তিত্ব এবং ইচ্ছার শক্তিপ্রাপ্ত হয়। নাগরিকদের সমবায়ে গঠিত এমন সমাজ সংস্থাকে প্রাচীনকালে একটা নগর বা নগররাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করা হতো। পুরাতন সেই অভিধার স্থলে আজ আমরা তাকে একটা রিপাবলিক বা রাজনৈতিক সংস্থা হিসেবে অভিহিত করে থাকি। এবং এই সংস্থাকে মানুষ তার নিস্ক্রিয় অবস্থায় ‘রাষ্ট্র’ বলে অভিহিত করে; ক্রিয়াশীল অবস্থায় এই সংস্থাই সার্বভৌম জনশক্তিতে পরিণত হয়।

সুতরাং রিপাবলিক গঠনে, আগে জনগনের সাধারন ইচ্ছাটা সঙ্গায়িত হওয়া দরকার। এই সংগায়নের  উপরই নির্ভর করে রাষ্ট্র বিশেষের ইচ্ছা থেকে কত দূরে বা সকলের ইচ্ছার কতটা কাছাকাছি। ১৯৭১ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রিপাবলিক হিসেবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জনগনের এই সাধারণ ইচ্ছাটি সঙ্গায়িত হয় কেমন করে?

আর্টওয়ার্ক: মুক্তিযুদ্ধ
শিল্পী: জয়নুল আবেদীন
সূত্র: উইকিপিডিয়া

বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একেবারে গোড়ার গলদটাই হল সাধারণ সংকল্পকে ব্যতিরেকে বিশেষের ইচ্ছায় রাজনৈতিক সংস্থা গঠন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনপ্রতিনিধি হিসেবে ম্যানডেটপ্রাপ্তরাই এই রিপাবলিকের  সাধারণ সংকল্প সংঙ্গায়িত করেছে। একটি গণবিপ্লবের পর সমাজে ত্রিয়াশীল সামাজিক জনসংগঠন ও গণসংগঠনগুলোকে বাদ দিয়েই রচিত হয়েছে জনগনের সামাজিক সংকল্পের দলিল —বাংলাদেশের সংবিধান। এমনকি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অংশীদারিত্বও পোক্ত হয়নি এই সংবিধান রচনায়। গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতা-জাতীয়তাবাদের লেবেল এঁটে কেমন করে একটি সর্বস্বৈরতন্ত্রী সংবিধান রচনা করা যায় তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ বাংলাদেশের সংবিধান।  কিন্তু এই সংকটের জড় কোথায় ?

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি লিপিবদ্ধ করেছেন তৎকালীন বামপন্থী রাজনৈতিক চিন্তক রণেশ দাশ গুপ্ত। রনেশ দাশ গুপ্তের মতে যে বেপÍবিক ঘটনার ধারায় পুর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রাম সশস্ত্র মুক্তি যুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করেছে , তা পুর্ব বাংলার সর্বস্তরের নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমেই ঘটেছে।

এই মুক্তি সংগ্রামে ক্রিয়াশীল সামাজিক বর্গগুলোকে চিহ্নিত করেছেন রণেশ।

১. কৃষক
২. জাতীয় বুর্জোয়া বা উদীয়মান শিল্প উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী
৩.শ্রমিক
৪. মধ্যবিত্ত

একাত্তুরে স্বাধীন রিপালিক প্রতিষ্ঠায় এই প্রধান চারটি সামাজিক বর্গের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক চেতনাকে বিসর্জন দিয়ে, অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্থলে হাজির হয় সমন্বয়বাদের কুইনিন —যার প্রধান ভারকেন্দ্র জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদী কর্তৃত্ব আর  ইতিহাসচেতনা হেঁটেছে হাতে হাত ধরে। মূলত স্বাধীন দেশের শাসক-শোষকগোষ্ঠীকে আশ্রয় করে।

একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধোত্তর রিপাবলিক গঠনের গলদগুলো ধরা পড়ে খোদ ৭২’এর সংবিধানেই। ৭২’এর সংবিধানের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গনতন্ত্র-সমাজতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের তকমা থাকলেও সংবিধানের পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিল স্বৈরতান্ত্রিক সব উপাদান। ৭২-এ একটি সত্যিকারের গণ-অংশগ্রহনমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্থলে গড়ে তোলায় হয় স্বৈরতান্ত্রিক পার্টিস্টেট বা দলরাষ্ট্র, যার সমস্ত ক্ষমতা প্রায় ন্যাস্ত প্রধানমন্ত্রীর হাতে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়-

কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন অথবা সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন তা হইলে সংসদে তাহার আসন শুন্য হইবে।

ব্যাখ্যা।-যদি কোন সংসদ সদস্য যে দল তাহাকে প্রার্থীরুপে মনোনীত করিয়াছেন,  সেই দলের নির্দেশ অম্যান্য করিয়া-

ক. সংসদে উপস্থিত থাকিয়া ভোটদানে বিরত থাকেন; অথবা

খ.সংসদের কোন বৈঠকে অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে তিনি উক্ত দলের বিপরীতে ভোটদানে করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।

এমনিতেই রাজনৈতিক জনপ্রতিনিধিত্ব একটি স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা। (পরে বিস্তারিত আলোচনা আছে)  বাহাত্তরের সংবিধান সেই ব্যাবস্থাকে শুধু আত্তীকৃতই করেনি একই সঙ্গে তার সবচেয়ে স্বৈরতন্ত্রী রূপটিকে হাজির করেছে জনগনকে শাসনের জন্য। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ রাজনৈতিক জনপ্রতিনিধিত্বকে পুরোপুরি পর্যবসিত করেছে পার্টি প্রতিনিধিত্বে। একজন জনপ্রতিনিধি চাইলেও তার নিজ আসনের নির্বচকগণের মতমাফিক চলতে বাধ্য নন-তার সমস্ত বাধ্যবাধকতা পার্টির কাছে। এ ধরনের দলতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বৈরতন্ত্র আরও তীব্র হয় যখন প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীসভার সর্বেসর্বা। সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী :

 ৫৫।(১) প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি মন্ত্রসিভা থাকিবে। এবং প্রধানমন্ত্রী ্ও সময়ে সমযে তিনি যেরুপ স্থির করিবেন সেরূপ অন্যন্যমন্ত্রী লইয়া এই মন্ত্রীসভা গঠিত হইবে।

(২) প্রধানমন্ত্রী কতৃক বা তাহার কতৃত্বে এই সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হইবে।

(৩) মন্ত্রীসভা যৌথভাবে সংসদের কাছে দাযী থাকবেন।

তাহলে কী দাঁড়াল? প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার কাছে দায়বদ্ধ নন। এমনকী মন্ত্রিসভা পরিচালিত হবে তার হুকুমেই। কোন যৌথতার দাবি অবান্তর। তাহলে প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহিতা কার কাছে ? সংসদের কাছে। কিন্তু সংসদ সদস্যরাতো পার্টির সিদ্ধান্তের বাইরে গেলেই লক্ষণরেখা পার করবেন! সুতরাং সাংবিধানিকভাবে এখানে প্রধানমন্ত্রী একনায়ক। তিনি যেমন করে ক্ষমতা চালাবেন তেমন করেই চলবে। একই সঙ্গে সাংবিধানিকভাবে জনবিচ্ছিন্ন এই রাজনৈতিক জনপ্রতিনিধিত্ব যদি সংসদে তার নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রুতির বাইরে বা বিরুদ্ধে কোন আইন পাশ করেন বা কোন পলিশি সমর্থন করেন তবে তা অসাংবিধানিক হবে না। আদালতে চ্যালেঞ্জ করেও তাই কোন লাভ নাই। তাহলে একবারে মৌলিক প্রশ্নটা দাঁড়িয়ে যায় এই রিপাবলিকের সামাজিক চুক্তির  ভিত্তি নিয়ে, যেখানে শাসনের কোন দায় জনগনের কাছে নেই — —এমন চুক্তি হয় কেমন করে? হ্যাঁ, আর ঠিক এই জন্যই লাগে সাইনবোর্ড। সংবিধানে গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতা-জাতীয়তাবাদের তকমা। মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহনকারী সামাজিক বর্গের চেতনার বাইরে রাজনৈতিক দলগুলোর দর্শনের খিচুড়ি পাকিয়ে রচিত হয়েছে এই রিপাবলিকের ভিত্তি। কিন্তু রাজনৈতিক উচ্চকোটি তথা পলিটিক্যাল এলিটের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতেই দরকার ছিল এমন একটি স্বৈরতন্ত্রী ক্ষমতা। আর এমন একটি স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নিরঙ্কুশ করতে দরকার ছিল ভিন্নমত ও অন্য রাজনৈতিক দলদের সাইজ করা। জনগনকে একটা ইমাজিনড দীক্ষিত রাজনৈতিক কমিউনিটি হিসেবে নির্মাণ করা। আর তাই হাজির হয়েছে  জাতীয় সংস্কৃতি, জাতীয় ঐতিহ্য, জাতীয় মহত্বের বুলি। বাংলাদেশ পরিণত হযেছে একটি নিপীড়ক জাতিরাষ্ট্রে।

একটি মুক্ত স্বাধীন রিপাবলিকের বদলে বাংলাদেশকে একটি নিপীড়ক জাতিরাষ্ট্রে রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি খুব জটিল কিছু নয়। এই রূপান্তর প্রক্রিয়া আর ইতিহাসচেতনার সংযোগ একই সূত্রে গাঁথা।

পূর্ব বাংলার মুক্তি আন্দোলনে  বৈপ্লবিক গতিবেগ সৃষ্টির ব্যাপারে কৃষক — মুলত দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকই ছিল গ্রামাঞ্চলের মূল রাজনৈতিক শক্তি। পুর্ব বাংলার প্রধান অর্থকরী ফসল পাটের রপ্তানি-ব্যবসা এমনকি শিল্পোদ্যোগের সমস্তটাই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রনে। এর ন্যূনতম সুবিধা কখনো পায় নি উৎপাদক কৃষক। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর গণবিরোধী ভূমিনীতি ও কৃষিনীতি তাদের অসন্তুষ্ট করে তোলে। কৃষকের চেতনা তার রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও মুক্তির প্রশ্ন কখনোই উচ্চারিত হয়নি এই জাতীয়তাবাদী ইতিহাস চর্চায়। তার গায়ে স্রেফ হাজার বছরের বাঙ্গালিত্বের তকমা এঁটে সাঙ্গ হয়েছে জাতীয়তাবাদী ইতিহাস চর্চার কুলজি।

পূর্ব বাংলার উঠতি জাতীয় বুর্জোয়া বা স্থানীয় শিল্পপতি ব্যবসায়ী অথবা সম্ভাব্য শিল্পপতি ব্যবসায়ীরা মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে কমবেশি উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছে। পূর্ব বাংলার তথা বাংলাদেশের শিল্পায়নকে স্তব্ধ করে রাওয়ালপিন্ডি, করাচি, লাহোরের ঔপনিবেশিক শোষক ও শাসক চক্র পশ্চিম পাকিস্তানে গড়ে তোলে আধুনিক শিল্পব্যবস্থা। শিল্পনীতির বৈষম্য তাকে অসন্তুষ্ট করে তোলে। শিল্পের রাষ্ট্রীয়করনের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে পাল্টে যায় ‘জাতীয় বুর্জোয়ার’ চরিত্র। রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র আর ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ছত্রছাযায় সীমাহীন লুটপাটের সংস্কৃতিতে গা ভাসানোই ছিল তার সামনে একমাত্র পথ। লুটপাটের মধ্য দিয়েই জোটে ক্ষমতা আর শাসনের অংশীদারিত্ব। জাতীয়তাবাদী ইতিহাসচেতনা গড়ে উঠেছে মুলত এই শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থকে আশ্রয় করে।

আর্টওয়ার্ক: দুনিয়ার মজদুর এক হও
শিল্পী : মিতা মেহেদী
সূত্র: ফেসবুক

পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রামে অন্যতম মূলশক্তি  শ্রমিক । উদ্বৃত্ত শোষণের বিরুদ্ধে শুধু ঔপনিবেশিক শাসককের বিরুদ্ধে সংগ্রাম নয়; একই সঙ্গে স্বাধীন দেশে ন্যুনতম অর্থনেতিক সামাজিক ন্যায়বিচার ছিল তার আন্দোলনের মুখ্য প্রশ্ন। শ্রমিকের এই চেতনা থেকে আমাদের রাষ্ট্র-আমাদের সংবিধান যোজন যোজন দূরে।

মধ্যবিত্তর মধ্যে ফেলা যেতে পারে কৃষক শ্রমিক এবং জাতীয় বুর্জোয় ছাড়া সমাজের বাকী অংশের মধ্যকার শহর ও গ্রামাঞ্চলের নিম্নবিত্ত ও মাঝারি ধরনের বিভিন্ন বৃত্তিজীবীদের এবং প্রধানত বুদ্ধিজীবীদের। ঐতিহাসিকভাবেই এই মধ্যবিত্তের জন্ম ইংরেজ শাসনের গহ্ববরেÑঔপনিবেশিক শাসকের অনুকম্পা তার অস্তিত্বের ভিত্তি। তবে একাত্তুরে নতুন একটা সম্ভবনাকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহ করলেও তার চরিত্র পাল্টায় নি। শাসকের অনুকম্পার কাছেই নতি স্বীকার ছিল তার জন্মচরিত্র। তাই নতুন শাসকের কাছে সবচেয়ে আস্থাভাজন এবং সবচেয়ে কম বিপজ্জনক সামাজিক বর্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই মধ্যবিত্ত।

জাতীয়তাবাদী ইতিহাস চেতনার প্রধান লক্ষণ:
১   পাকিস্তান বনাম পূর্ব বাংলা বৈষম্যের প্রশ্নটিকে হাজির করা কিন্তু একই সঙ্গে পুর্ব বাঙলার প্রবাহমান সামাজিক বৈষম্যে ধরনটিকে আড়াল করা।
২   পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর শ্রেণী চরিত্র বিচার করা কিন্তু একই সঙ্গে পুর্ববাংলার সামাজিক উচ্চবর্গর চরিত্র বিশ্লেষণ না করা।
৩   পাকিস্তান রাষ্ট্রের অগনতান্ত্রিক শাসনের সমালোচনা করা কিন্তু একটি দীর্ঘ রাজনেতিক সগ্রামের মধ্য দিয়ে নতুন রিপাবলিক গঠনের প্রশ্নে ক্রিয়াশীল শ্রেনী গোষ্ঠী-দলের সাধারণ ইচ্ছাটিকে কখনোই সঙ্গায়িত না করা।
৪   পাকিস্তানী শাসনের অভিঘাতে বিপন্ন বাঙলা ভাষা  ও সংস্কৃতিকে রক্ষার তাগিদ বোধ করা কিন্তু একই সঙ্গে এই জনপদের অন্যান্য জাতিসত্তার ভাষা সংস্কৃতির উপর পাকিস্তানী কায়দার আক্রমন।
৫   ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে জাতীয়তার নিরুপণ এবং শাসন যন্ত্রে তার কর্তৃত্ব দাবি।

ভাষা-জাতি-জাতিরাষ্ট্র : ভাষাভিত্তিক ঐক্য নাকি সর্বস্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্রের মুখোশ ?

জাতিরাষ্ট্রের ওকালতির মূলভিত্তি হচ্ছে ভাষা-ভাষা ভিত্তিক জাতি। জাতি গঠনের মূল উপাদান হিসেবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সেই অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই ভাষাকে সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদান হিসেবে চি‎হ্নিত করা হয়েছে। Wilhelm von Humboldt, Karl Julius Weber  এর মত সমাজবিজ্ঞানীরাও এর থেকে বাদ পড়েন নি। Wilhelm von Humboldt উচ্ছ্বসিত উক্তি  The true homeland is really the language. আর  Karl Julius Weber  ভাষার মধ্যেই খুঁজেছেন জাতীয়তার মূল শক্তি: In nothing does the national character, the imprint of the mental and spiritual power of a people, express itself so clearly as in its language. ১০

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভাষা কেন্দ্রিক জাতীয়তা-চিন্তার এই বিপজ্জনক প্রবণতার শুরুয়াদ খোদ বাহান্নর ভাষা আন্দোলনেই। তবে ভাষা আন্দোলনের কর্মী-চিন্তকরা যে তা টের পাননি তেমন কিন্তু নয়। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের মাত্রিক বিভাজনেই বিয়য়টি স্পষ্ট হবে। ভাষা আন্দোরনের পর প্রকাশিত একুশে প্রথম সংকলন, একুশে ফেব্রয়ারিতেই এই বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন তৎকালীন বামপন্থী রাজনৈতিক চিন্তক খোকা রায়। আলী অশারাফ ছদ্মনামে লেখা সকল ভাষার মর্যাদা সমান প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন:

ভাষা আন্দোলনের মূল আওয়াজ উঠেছে  ‘অন্যতম রাষ্ট্রবাষা বাঙলা চাই’। গত ভাষা আন্দোলনের সময় সর্বদলীয় রাস্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কোন কোন নেতা এ-মত প্রকাশ করেছিলেন যে ’আন্দোলনের মূল আওয়াজ হবে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ সংগ্রাম পরিসদের অন্যান্য কযেকজন সব্র সে আওয়াজের বিরোধিতা করে বলেছিলেন, ওরূপ আওয়াজে লোকে ভুল বুজবে যে আমরা ‘শুধু’ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে চাই। তাঁরা বলেছিলেন যে,‌‘রাষ্ট্রে জনগনের সকল বাষার সমান মর্যাদা চাই’-এই নীতির অনুসারে আন্দোলন চলুক। তাঁদের সে বক্তব্য গ্রাহ্য হয় নি। অপর দিকে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই এই বক্তব্যও গ্রাহ্য হল না। ‘অন্যতম’ শব্দটি জুড়ে দিয়ে একটা আপোষরফা হল। সে থেকে আন্দোলনের আওয়াজ দাঁড়িয়ে গেছে ‘অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।১১

পাকিস্তানী শাসকদের একজাতি-এক তমুদ্দীন-এক ভাষার বর্ণবাদী নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যে একই চিন্তা পদ্ধতির লোকরাও ছিল তা স্পষ্ট। উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার মাধ্যমে যেমন বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থে আঘাত করা হয় ঠিক একই কাযদায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার মধ্য দিয়ে অন্য জাতিগোষ্ঠীর ভাষা সংস্কৃতির উপর একই ধরনের বর্ণবাদী আধিপত্য করা হয়। বলাই বাহুল্য পাকিস্তানে তখন বাঙালি ছাড়াও সিন্ধি-পাঞ্জাবি-পাঠান-বালুচিসহ আরও অনেক ভাষিক জনগোষ্ঠী ছিল। এই বর্ণবাদীবাদী প্রবণতা পাকিস্তানি বর্ণবাদী ডিসকোর্সের মধ্যেই নির্মিত হযেছে। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের পর এ নিয়ে পরিস্কার মীমাংসা টানা হলেও ভুত ছাড়েনি। পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলা নির্মাণের লড়াইয়ের সমস্ত উপাদানকে গাঁথা হয়েছে একসূত্রে—ভাষার ভিত্তিতে ঐক্য নির্মাণ। মুক্তি সংগ্রামের বহুত্ববাদী চরিত্রকে গ্রাস করে  রাজনৈতিক উচ্চকোটির পোষণে বর্ণবাদী এই জাতীয়তাবাদের গ্যাজ একটু একটু করে গজিয়েছে আর শক্ত হয়েছে। একাত্তুরে জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার ষোল কলা পুর্ণ হয়েছে। কিন্তু এই বর্ণবাদী ডিসকোর্সকে মোকাবেলা করা দরকার। নইলে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি মুক্ত স্বাধীন রিপাবলিক গঠনের কাজটি কখনোই করা সম্ভব নয়।

আর্টওয়ার্ক: আমার মুক্তি
শিল্পী : মিতা মেহেদী
সূত্র: ফেসবুক

ভাষা যে মানবীয় যুথবদ্ধতার প্রধান লক্ষণগুলোর একটি তাতে কোন সন্দেহ নাই। এমন কী মানুষের মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার ঐতিহাসিক বিকাশে ভাষা যে প্রধান অনুসঙ্গ তাতেও কোন সন্দেহ পোষণের কোন কারণ নাই। তবে ভাষা আর জাতীয়তা পুরোপুরি দুটো আলাদা পপঞ্চ- দুটো ভিন্ন প্রপঞ্চের ঐতিহাসিক পরিণতি।  বিংশ শতাব্দীর মুক্তশ্রম আন্দোলনের অন্যতম চিন্তক রুডলফ রকার তার Nationalism and Culture গ্রন্থে খুব চমৎকার ভাবে বিষয়টির অবতারণা করেছেন। রকারের অভিমত, ভাষা কোন ব্যাক্তি মানুষের সৃষ্টি নয়। যুগযুগ ধরে একটি  জনগোষ্ঠীর বিকাশের প্রাকৃতিক শর্তের মধ্য থেকেই ভাষার উৎপত্তি। রকারের মতে, It is very probable that there were once homogeneous languages, but that time is long past, lost in the greyest antiquity of history. অপরদিকে জাতীয়তা পুরোপুরি একটি রাজনৈতিক সংশ্লেষ। রাষ্ট্র ক্ষমতাকে আশ্রয় করে বেড়ে ওঠা ধ্যান ধারনারই উৎপাদ।

তবে ভাষাকে আশ্রয় করে জাতীয়তা নির্মাণের প্রচেষ্টার মূলে মোক্ষম আঘাত করেছেন রকার।  রকারের যুক্তি:

…No language is the purely national product of a particular people, nor even of a particular nation. Towards the development of every one of our cultural languages peoples of the most various origins have contributed. This was inevitable, because a language as long as it is spoken at all continually absorbs foreign elements in spite of all the noise of the purification fanatics. For every language is an organism in constant flux; it obeys no fixed rules, and flies in the face of all the dictates of logic. Not only does it make the most diversified borrowings from other languages, a phenomenon due to the countless influences and points of contact in cultural life, but it also possesses a stock of words that is continually changing. Quite gradually and unnoticeably the shadings and gradations of the concepts which find their expression in words alter, so that it often happens that a word means today exactly the opposite of what men originally expressed by it… ১২

ভাষা-সংস্কৃতি জোর করে চাপিয়ে দেয়া কোন বিষয় নয়। একেবারে প্রকৃতি-প্রতিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিযার মাধ্যমেই মানুষ গড়ে তুলেছে তার ভাষা। ভাষার রূপায়ণে একদিকে যেমন আছে মানুষের স্বতস্ফূর্ত যুথবদ্ধ সৃজনের ইতিহাস, অন্যদিকে ভাষা নিজ্ইে হয়ে উঠেছে এক একটি ভাষিক জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বন্ধনের মূল সূত্র। এই বন্ধন কোন জাতীয়তাবোধের ফল নয়। খোদ জাতীয়তাবোধের ধারণাই গড়ে উঠেছে ইউরোপে, রাষ্ট্র ধারণার পরিপূরক হিসেবে। ইউরোপে চার্চ এবং সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং রেনেসাঁ মধ্যে দিয়ে জনতার যে গনতান্ত্রিক ঐক্য ও আকাক্সক্ষার স্পূরন ঘটে তারই এক তদ্ভব রুপান্তর জাতিরাষ্ট্রের ধারনা। রকারের মতে, The nation is not the cause, but the result, of the state. It is the state which creates the nation, not the nation the state. Indeed; from this point of view there exists between people and nation the same distinction as between society and the state.

জনতা হচ্ছে সামাজিক ঐক্যের প্রতিরূপ। পারস্পারিক সহযোগিতার ভিত্তিতে গঠিত সমবায়। জীবন-যাপন প্রনালী পদ্ধতির সাদৃশ্য যার ভিত্তি। একই ভাষা-একই বাতাবরণ-একই প্রতিবেশ  নিসন্দেহে এই ঐক্যর অন্যতম নিয়ামক। তাই এ ধরনের  ঐক্যের মধ্যে গড়ে ওঠে একটি সাধারণ সম্পর্কÑএকটি সাধারণ চিন্তা। আর এই সাধারন চিন্তা-সম্পর্কই হচ্ছে মানুষের সামাজিক অস্তিেেত্বর মূলভিত্তি। তাই মানুষের সামাজিক অস্তিত্ব নিখাঁদ। অন্যদিকে জাতি ধারণার পুরোটাই নির্মিত-কৃত্রিম।  রকার জাতীয়তার গুমোর ফাঁস করেছেন এভাবে-

The nation… is the artificial result of the struggle for political power, just as nationalism has never been anything but the political religion of the modern state. Belonging to a nation is never determined, as is belonging to a people, by profound natural causes; it is always subject to political considerations and based on those reasons of state behind which the interests of privileged minorities always hide. ১৩

জাতিরাষ্ট্রের ভাঁওতা হল জনগনের নামে উচ্চকোটির স্বার্থবাহী বিশেষের রাজনৈতিক ক্ষমতা সংস্থাপন। জনগনের সংকল্পের নামে বিশেষের সংকল্প ও আজ্ঞা বাস্তবায়ন তার মূলমন্ত্র। কিন্তু এই ইচ্ছা ও আজ্ঞা উৎপাদন করতে হয়। রকার এর কারণ ব্যাখ্যা করেছেন খুব চমৎকারভাবে : The will of the few may become the will of all – for only thus can it develop its full effectiveness – every form of intellectual and moral drill must be employed to anchor it in the (modern) religious consciousness of the masses and make it a matter of faith. আসলে রাজনৈতিক ক্ষমতা সবসময়ই বিশেষের—রাজনৈতিক রাষ্ট্রও তাই। রাজনৈতিক জনপ্রতিনিধিত্বের নামে যতই জনগনের শাসনের কথা বলা হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে তা জনগনকেই শাসন। জনগনের উপর কর্তৃত্ব।

আর্টওয়ার্ক: জয় বাংলা
শিল্পী : মিতা মেহেদী
সূত্র: ফেসবুক

মুক্তি সংগ্রামের মূল স্লোগান জয় বাংলা র মধ্য দিয়ে  মুক্ত-স্বাধীন রিপাবরিকের জন্য যে সোচ্চার আকাঙ্ক্ষা-সমর্থন ফুটে ওঠে তার সবটাই ছিনতাই হয়েছে জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চর্চার আধিপত্যে। ভাষাকে আশ্রয় করে একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং সেই রাষ্ট্রের ক্ষমতার পরতে পরতে স্বৈরতন্ত্রের বীজ —দুয়ে মিলেই এই জাতীয়তাবাদ পরিণত হয়েছে সর্বগ্রাসী-টোটালিটারিয়ান মতবাদে।

সূত্র:

১. আহমেদ, রেহনুমা (২০১২) অবতারনিকা, বিক্ষোভ সংকলন: জরুরি অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় ২০০৭, সম্পাদনা, উদিসা ইসলাম, শ্রাবণ প্রকাশনী, ঢাকা  পৃ-১২
২. গুহ, রনজিৎ (১৯৯৮) নিম্নবর্গের ইতিহাস, নিম্নবর্গের ইতিহাস, সম্পাদনা: গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টপ্যাধায়, আনন্দ পাবলিশার্স , কোলকাতা, পৃ- ২৩-২৪
৩. প্রাগুক্ত
৪. প্রাগুক্ত
৫. করিম, সরদার ফজলুল (২০০০ ) রুশোর সোশ্যাল কনট্রাক্ট,  মাওালা ব্রাদার্স পৃ: ৩৬-৩৮
৬. দাশগুপ্ত, রণেশ (১৯৭১) মুক্তি সংগ্রামের গতিপ্রকৃতি, বেহাত বিপ্লব: ১৯৭১, সম্পাদনা: সলিমুল্লাহ খান, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা
৭. মাহমুদ, আরিফ রেজা ( ২০১২) একাত্তুর পাবলিক রিপাবলিক, প্রকাশিতব্য
৮. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, ১৯৭২
৯. প্রাগুক্ত
১০. Weber, Karl Julius
১১. আশরাফ, আলী (১৯৫৩) সকল ভাষার মর্যাদা সমান, একুশে ফেব্র“য়ারি, সম্পাদনা: হাসান হাফিজুর রহমান, সময় প্রকাশন, ঢাকা, পৃ-১৭
১২. Rocker, Rudolf (1936 )The nation as community of language, Nationalism and culture
http://www.anarchosyndicalism.net

১৩.  Rocker, Rudolf (1936 ) Democracy and national state, Nationalism and culture
http://www.anarchosyndicalism.net

 

আরিফ রেজা মাহমুদ

লেখক