অনুবাদ: অনিক সন্ধি
নতুন করোনাভাইরাস পুরো পৃথিবীকে সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী এই মহামারীর কাঠামোগত কারণগুলোকে ট্যাকেল না করে ইমারজেন্সি কর্মতৎপরতার উপর বেশি মনোযোগ দিচ্ছে।
নতুন ভাইরাস, শিল্পভিত্তিক কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন, বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর মুনাফা অর্জনের পারস্পরিক সম্পর্ক ব্যাখা করেছেন সমাজবাদী জীববিজ্ঞানী রব ওয়ালেস।
সম্প্রতি জার্মান সমাজবাদী ম্যাগাজিন মার্ক্স-২১ কে সাক্ষাতকার দেন তিনি। মার্ক্স ২১ এর হয়ে ইয়াক পাবস্ত সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করেন। রব ওয়ালেশ একজন বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী। ২০১৬ সালে তার বই মহাখামার ছড়ায় মহারোগ প্রকাশিত হয় এবং সাড়া ফেলে।
কোভিড-১৯ এর ঝুঁকি, এগ্রিব্যাবসার সৃষ্ট সংকট ও করণীয় এবং মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টেকসই সমাধানের পথ নিয়ে কথা বলেছেন ওয়ালেস।
সাক্ষাতকারটি ৩০ মার্চ প্রকাশের জন্য নির্ধারিত ছিল। তবে মার্ক্স ২১ তা আগেই প্রকাশ করে।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2020/03/11-56-17-29381976.jpg)
মার্ক্স ২১ : নতুন করোনাভাইরাসটি ঠিক কতটুকু ঝুঁকিপূর্ণ?
এটি নির্ভর করে মহামারীর ঠিক কোন সময়ে আপনি এ প্রশ্ন করছেন। খুব আগে, পিক লেভেলের সময়ে নাকি তার পরে? আপনার অঞ্চলে গণস্বাস্থ্য প্রতিক্রিয়া কেমন? সে অঞ্চলের জনতত্ত্ব কেমন? আপনার বয়স কত? আপনার শরীরের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা কি আপসকামী ? আপনার গড় স্বাস্থ্য কেমন? অথবা উত্তর দেয়া যায় না এমন কিছু প্রশ্ন, যেমন আপনার ইমিউনোজেনেটিক্স অর্থাৎ আপনার রোগ প্রতিরোধী প্রতিক্রিয়ার জন্য দায়ী জেনেটিক্স এই ভাইরাস প্রতিরোধ করতে পারবে কিনা।
মার্ক্স ২১: তাহলে এর সম্পর্কে সব হৈচৈ কি শুধু ভয় দেখানোর কৌশল?
না মোটেও না। উহানে মহামারি আকার ধারণ করার শুরুতে ভাইরাসে মৃত্যুহার অথবা সি.এফ.আর ছিল ২ থেকে ৪ শতাংশ। উহানের বাইরে সি.এফ.আর যদিও কোথাও কোথাও এক শতাংশের নিচে চলে আসে তবুও আমেরিকা ও ইতালির মতো জায়গায়ও তা খুবই উঁচু। হ্যাঁ, এটা মানতেই হবে যে,এর মৃত্যুর হার– সার্স এর ১০%, ১৯১৮ এর ইনফ্লুয়েঞ্জার ২০%, বায়বীয় ইনফ্লুয়েঞ্জা H5N1 এর ৬০% ও ইবোলার ৯০% এর সাথে তুলনীয় নয়। তবুও এটি অবশ্যই সিজনাল ইনফ্লুয়েঞ্জা এর মৃত্যুর হার ০.১% থেকে অনেক বেশি। তবে ক্ষতিকর দিকটি শুধু মৃত্যুর হার নয়। আমাদের যেটিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে সেটি হল ভেদন ক্ষমতা অথবা কমিউনিটি অ্যাটাক হার অর্থাৎ বৈশ্বিক জনসংখ্যা এই মহামারি দ্বারা ঠিক কতটুকু ভেদিত হয়েছে।
মার্ক্স ২১: অনুগ্রহ করে আরেকটু নির্দিষ্টভাবে বলবেন…
বৈশ্বিক যাতায়াত নেটওয়ার্ক এখন রেকর্ড কানেক্টিভিটির সমতুল্য। কোন ভাইরাসের কোন ভ্যাকসিন অথবা কোন অ্যান্টিভাইরাল অথবা কোন হার্ড বা পাল ইমিউনিটি ঠিক এই মুহূর্তে না থাকার কারণে ১% মৃত্যুর হারও সামনে খুবই ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে। সুপ্ত অবস্থা় দুই সপ্তাহ থাকায় ও হাতে পাওয়া অন্যান্য প্রমাণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে রোগাক্রান্ত হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করবে যেখানে মনে হবে যেন কিছু অঞ্চল রোগমুক্ত। কিন্তু কোভিড-১৯ যদি ৪০০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে এক শতাংশ মৃত্যুর হারও বয়ে আনে তাহলে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় চার কোটি। একটা বড় সংখ্যার মধ্যে ছোট শতাংশ কিন্তু এক বিশাল সংখ্যা দাঁড় করায়।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2020/03/08-01-25-dangerous_approach_covid_19__alex_falc_chang.jpeg)
শিল্পী: অ্যালেক্স ফ্যাল্ক চ্যাং
মার্ক্স ২১: আপাতদৃষ্টিতে কম ক্ষতিকারক মনে হওয়া একটি ভাইরাসের জন্য এ তো খুব সাংঘাতিক এক সংখ্যা…
অবশ্যই। আর আমরা তো মহামারীর মাত্র শুরুতে আছি। এটা বুঝা খুবই জরুরি যে অনেক নতুন রোগ কিন্তু মহামারীর মাঝখানে বদলিয়ে যায়। সংক্রমণ-ক্ষমতা বা ক্ষতিক্ষমতা অথবা উভয়েই কিন্তু বদলাতে পারে। অন্যান্য রোগ কিন্তু ক্ষতিক্ষমতায় বৃদ্ধি পায়। ১৯১৮ এর বসন্তের ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রথম হামলায় রোগাক্রান্তের সংখ্যা মাঝারি আকারের ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় ১৯১৯ এর শীতকালীন সংক্রমণে লাখ লাখ মানুষ মারা যাওয়া শুরু করে।
মার্ক্স ২১: কিন্তু মহামারী নিয়ে উন্নাসিকরা বলছেন যে করোনায় আক্রান্ত মৃত রোগীর সংখ্যা সিজনাল ফ্লু এর আক্রান্ত মৃত রোগীর সংখ্যা থেকে অনেক কম। আপনার এ সম্পর্কে কী বলার আছে?
আসলে যদি তা হতো তাহলে আমিই প্রথমে তার উদযাপন করতাম। কিন্তু কোভিড-১৯ এর সাথে ইনফ্লুয়েঞ্জা এর তুলনা করে বিপদ কে ছোট করা আসলে একটি রেটোরিক কৌশল, যা একে ঘিরে তৈরি উদ্বেগ উৎকণ্ঠা থেকে মনোযোগ সরিয়ে ফেলে।
মার্ক্স ২১: তাহলে সিজনাল ফ্লু এর সাথে তার তুলনা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন?
দুটো ভিন্ন রোগকে তাদের এপিকার্ভ অর্থাৎ মহামারীবক্রের ভিন্ন সময়ে একে অপরের সাথে তুলনা করা যুক্তিহীন। হ্যাঁ, অবশ্যই সিজনাল ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতি বছরে লাখ লাখ মানুষের মাঝে ছড়ায়। হু এর মতে প্রতিবছর প্রায় ছয় লাখ পঞ্চাশ হাজার মানুষ সিজনাল ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। কোভিড-১৯ মাত্র তার এপিডোমলজিকাল যাত্রা শুরু করলো। আবার খেয়াল করুন, ইনফ্লুয়েঞ্জার মত তার সংক্রমণ বিলম্বিত করার জন্য অথবা সবচেয়ে দুর্বল জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করার জন্য আমাদের কাছে সেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে হার্ড বা পাল ইমিউনিটি অথবা ভ্যাকসিন– কিছুই নেই।
মার্ক্স ২১: যদিও উভয়কে তুলনা করাটা ভুল তবুও এটা বলা যায় যে, দুটো রোগই আরএনএ ভাইরাস আর উভয়ই মুখ ও গলা এবং কখনো কখনো ফুসফুস অঞ্চল সংক্রমণ করে এবং উভয়েই অত্যন্ত ছোঁয়াচে।
ওগুলো বহিঃস্থ মিল বৈকি কিছু না এবং এরকম ধারণা দুটো রোগের তুলনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ধরতে ব্যর্থ হয়। যেমন আমরা কিন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে অনেকটা জানি। কিন্তু কোভিড-১৯ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না। এদের সম্পর্কে অনেক কিছুই আমাদের অজানা। বিশেষত কোভিড-১৯ সম্পর্কে অনেক কিছু জানাই হয়তো সম্ভব নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত মহামারী পুরোটা ছড়িয়ে পড়ছে। একই সাথে এটি বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, ব্যাপারটা কিন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জা বনাম কোভি- ১৯ নয় বরং এটা কোভিড এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা। একই সাথে একের অধিক রোগ মহামারী আকার ধারণ করা এবং কম্বো গঠন করে জনগোষ্ঠী আক্রান্ত করা কিন্তু সম্পূর্ণ অসম্ভব কোন ব্যাপার নয়। আমাদের অবশ্যই এর বিরুদ্ধে সচেতন হতে হবে।
মার্ক্স ২১: আপনি বহু বছর ধরে মহামারী ও তার করণীয় সম্বন্ধে গবেষণা করে আসছেন। আপনার মহাখামার ছড়ায় মহারোগ বইটিতে শিল্পভিত্তিক কৃষি, জৈবিক কৃষি এবং সংক্রামক এপিডেমোলোজি’র পারস্পারিক সম্পর্ক নিয়ে লিখেছেন। আপনার এই সম্বন্ধে অর্ন্তদৃষ্টি কি?
মহামারীর সময় সবচেয়ে বিপদজনক জিনিসটা হল ব্যর্থতা– বা বলা বাহুল্য– এটি অস্বীকার করা যে প্রত্যেক নতুন কোভিড-১৯ আসলে অভিন্ন ঘটনা। ভাইরাসগুলোর ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ার কেন্দ্রে রয়েছে খাদ্য উৎপাদন ও বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর মুনফামুখিতা। যদি কেউ গবেষণা করতে চান যে ইদানিং সব ভাইরাস কেন আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে তাহলে তাকে অবশ্যই কৃষির শিল্প-মডেল ও পশুসম্পদের উৎপাদন সম্পর্কে গভীর ভাবে জানতে হবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে খুব কম সংখ্যক রাষ্ট্র ও কম সংখ্যক বিজ্ঞানীই এটি করতে ইচ্ছুক।
যখনই কোন নতুন মহামারীর খবর পাওয়া যায় তখনই আমাদের রাষ্ট্র ও মিডিয়া আর কিছুসংখ্যক মেডিকেল প্রফেশনাল মহামারীর কাঠামোগত দিকগুলোকে সম্পূর্ণভাবে অবজ্ঞা করে একেকটি আলাদা মহামারীকে তারকা খ্যাতির বিষয়ে পরিণত করেন ৷
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2020/03/dollar_sign__elihu_duayer.jpeg)
শিল্পী: এলিহু দুয়ায়ের
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট
মার্ক্স ২১: সব আসলে ঠিক কার দোষ?
আমি আগে বলেছিলাম শিল্পভিত্তিক কৃষি। কিন্তু ব্যাপারটি আরো বেশি প্রসারিত৷ দুনিয়জুড়ে পুঁজি প্রবল প্রতাপে, পৃথিবীতে টিকে থাকা শেষ কয়েক টুকরো প্রাথমিক বন অর্থাৎ মৌলিক অরণ্যের ভূমি আর ছোট ছোট কৃষি জমি গ্রাস করছে। এসব বিনিয়োগ তৈরি করছে অরণ্যবিনাশ ও এমন ধরনের উন্নয়ন যার ফলে এসব রোগবালাই খুব সহজেই মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। এই ভূমি-অঞ্চলগুলো যেখানে আগে বৈচিত্র্য ও জটিল সমারোহ সক্রিয় রাখত সেখানে তা এমন ভাবে সংকোচন করা হয়েছে যে, এতে সুপ্ত বীজাণু উন্মুক্ত হয়ে পশুসম্পদ ও মানব সম্প্রদায়ের় মাঝে খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ছে। আর সহজ ভাষায় বলতে গেলে বড় বড় সব রাজধানী যেমন নিউইয়র্ক, লন্ডন ও হংকংকে আমরা রোগের হটস্পট হিসেবে ধরে রাখতে পারি।
মার্ক্স ২১: ঠিক কোন সব রোগের জন্য এ কথাগুলো বলছেন?
আসলে কোনো রোগই বর্তমানে পুঁজিমুক্ত নয়। সবচেয়ে দূরবর্তী কিন্তু বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক রোগগুলো যেমন ইবোলা, জিকা, করোনাভাইরাস, পীতজ্বর ও আরো অন্যান্য বায়ুবাহিত রোগ এবং আফ্রিকান সোয়াইন ফ্লু খুবই দূরবর্তী অঞ্চল থেকে শহুরে অঞ্চলে ছড়াচ্ছে। আমাদের বৈশ্বিত ভ্রমণ নেটওয়ার্ক রোগগুলোকে এত দ্রুত ছড়াচ্ছে যে সপ্তাহের মধ্যেই তা কঙ্গোর কোন এক বাদুড় থেকে মায়ামির সূর্যস্নানকারীর দেহে ছড়াতে পারে।
মার্ক্স ২১: বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর এর মধ্যে ভূমিকা কী?
আসলে বায়োম্যাস ও আবাদি জমির দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে, পৃথিবী গ্রহ মোটামুটি খামার গ্রহে পরিণত হয়ে গেছে। এগ্রিব্যবসা খাদ্যবাজারকে সম্পূর্ণভাবে কোণঠাঁসা করার চেষ্টা করছে। সাম্প্রতিক নয়া-উদারবাদী ব্যবস্থা সংগঠিত হচ্ছে বড়বড় সব কোম্পানির মদদে যার ভিত্তি কিনা শিল্পোন্নত দেশগুলো কর্তৃক দুর্বল দেশগুলোর জমি ও কাঁচামাল লুণ্ঠন। এমন অবস্থায় ওইসব দেশের কোটি বছর ধরে বিবর্তিত যেসব অরণ্য-প্রতিবেশ দেয়ালের মত দুনিয়া থেকে রোগগুলোকে ঠেকিয়ে রাখতো তা আজ ধ্বংসের মুখে।
মার্ক্স ২১: এগ্রিব্যবসার উৎপাদন পদ্ধতি এর উপর কিরূপ প্রভাব ফেলে?
প্রাকৃতিক প্রতিবেশকে প্রতিস্থাপনকারী পুঁজির নেতৃত্বাধীন কৃষি এমন সব পদ্ধতিতে তার কাজকর্ম চালায় যা ভাইরাসগুলোকে মারাত্মক ক্ষতিকারক ও সংক্রামক ফিনোটাইপ এ বিবর্ধন করে। বলতে গেলে আপনি কোন মারাত্মক রোগ তৈরি করতে চাইলে এর চেয়ে ভালো সিস্টেম আশাই করতে পারবেন না।
মার্ক্স ২১: ঠিক কিভাবে এ জিনিসগুলো হয়?
খামারি পশুর শুধু জিনগত মনোকালচারের ফলে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা–যা সংক্রমণকে নিম্নমুখি করে তোলে– সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। বিশাল আকারের জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব এসব রোগ ছড়ানোকে ত্বরান্বিত করে আর এরকম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাও রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। আর এই ধরনের দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন পশু বংশ বৃদ্ধির ফলে ভাইরাস গুলোর ক্ষতিকারক ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ এগ্রিব্যবসা মুনাফাকে এমন ভাবে তার কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছে যে কোন এক ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোন প্রজাতির প্রাণী কে নির্বাচিতভাবে বংশবৃদ্ধি করানো তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2020/03/15-35-09-second_bird_flu_outbreak_found_on_dutch_farm__firuz_kutal.jpeg)
শিল্পী: ফিরোজ কোটাল
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট
মার্ক্স ২১: কী!?
হ্যাঁ। এই কোম্পানিগুলো আসলে মহামারী সৃষ্টিকারী বিপজ্জনক সব অপারেশনের মূল্য অন্য সবার মাঝে উন্মুক্ত করে দেয়। প্রাণী থেকে শুরু করে ভোক্তা, কৃষি শ্রমিক, আঞ্চলিক পরিবেশ ও ভৌগোলিক রাষ্ট্রগুলোর মাঝে তা চাপিয়ে দেয়। ওরা যে পরিমাণ ক্ষতি করে তা যদি আলাদা আলাদা ভাবে এগ্রি-কোম্পানিগুলোর হালখাতায় বসিয়ে দেয়া যায় তাহলে চিরদিনের জন্য এগ্রিবিজনেস নামক জিনিসটি ধ্বংস হয়ে যাবে। কোম্পানিগুলো যে পরিমাণ ধ্বংসাত্মক কাজ করে তার ক্ষতি তারা নিজেরাই কখনোই বহন করতে পারবে না।
মার্ক্স ২১: অনেক মিডিয়া দাবি করছে যে, করোনাভাইরাসের মহামারী শুরু উহানের এক্সোটিক খাদ্য মার্কেট থেকে। এটা কি সত্য?
হ্যাঁ এবং না। এই দাবির প্রমাণগুলোর মাঝে অনেক ফাঁক রয়েছে। ভাইরাস ট্রেসিং হুনানের সামুদ্রিক খাবারের পাইকারি মার্কেটের ইঙ্গিত করে, যেখানে বন্য প্রাণীও বিক্রি করা হত। কিন্তু ইনভায়রমেন্টাল স্যাম্পলিং গুলো মার্কেটের পশ্চিমপ্রান্ত যেখানে বন্য প্রাণী থাকে সেদিকে ইঙ্গিত করে না৷
কিন্তু আমরা ঠিক কত পেছনে এবং কতটা বৃহৎ পরিসরে গবেষণাটি করবো? এই জরুরি পরিস্থিতি ঠিক কখন শুরু হয়েছিল? ওই বাজারটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত যে জিনিসটা অবজ্ঞা করে সেটা হল বুনো কৃষির উৎপত্তি ও তাকে অজ্ঞাত চরাচরে নির্বাসন এবং তা থেকে পুঁজিরস্ফীতি।
চীন ও পুরা বিশ্বেই বর্তমানে বন্য-খাদ্যর অর্থনীতি ক্রমশই বিধিবদ্ধ হচ্ছে। এর সাথে শিল্পভিত্তিক কৃষির সম্পর্ক কিন্তু টাকার থলিতেই সীমিত নয়। শিল্পভিত্তিক কৃষির শূকর ও হাঁস-মুরগীর চাহিদা পূরণের জন্য প্রাথমিক বনের দিকে যেতে হয়। যার ফলে বন্য-খাদ্য কর্মকর্তারা সেই অরণ্যের আরো গভীর থেকে পশুপাখি আনতে বাধ্য হয়। এর ফলে যা হয় তা হল নতুন নতুন বীজাণু যেমন কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2020/03/corona_lab___shahid_atiqullah.jpeg)
শিল্পী: শহিদ আতিকুল্লাহ
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট
মার্ক্স ২১: কোভিড ১৯ কিন্তু চীন থেকে উৎপত্তি হওয়া প্রথম ভাইরাস নয় যা তার সরকার প্রথম প্রথম সবার থেকে লুকানোর চেষ্টা করেছিল।
হ্যা, কিন্তু এরূপ আচরণ শুধু চীনের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ কিন্তু H5N2 ও H5Nx ভাইরাসের মহামারী ছড়ানোর উৎপত্তিস্থল ছিল। মার্কিন সরকার ২০০৯ এর H5N1 ও H5N2 মহামারী ঢাকতে সেই দেশের এগ্রিব্যবসাকে সাহায্য করেছিল।
মার্ক্স ২১: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু মহামারীটিকে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংকট হিসেবে ঘোষণা করেছে। এটা কি সঠিক?
হ্যাঁ, এ ধরনের বীজানুর বিপদ হলো যে স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের হাতে ঝুঁকি বিতরণের কোনো ক্ষমতা নেই। বীজাণু কিভাবে প্রতিক্রিয়া করবে সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই নেই। একটা ক্ষুদ্র বাজারের থেকে এখন আমরা আন্তর্জাতিকভাবে মহামারী আকারে সংক্রমণে পৌঁছে গেছি। বীজাণুটি আপনাআপনি নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে, তাহলে ব্যাপারটি ভালই হবে। কিন্তু কি হবে না হবে তা আমরা কিন্তু আসলে জানি না। কিন্তু যত ভালো প্রস্তুতি নেয়া যাবে ততো ভালোভাবে ভাইরাসটির ক্ষতিক্ষমতা ও সংক্রমণী শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে।
আসলে হু এর ঘোষণাটিকে আমার ভাষ্যমতে ‘প্যানডেমিক থিয়েটার’৷ অতীতে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো নিষ্ক্রিয়তার মুখে ক্ষয়ে গেছে৷ যেমন ধরুন লীগ অব নেশনস। এরই প্রেক্ষিতে জাতিসংঘ সারাক্ষণ তার প্রাসঙ্গিকতা, ক্ষমতা ও অর্থায়ন এর চিন্তায় ব্যস্ত। কিন্তু এরকম কাজকর্ম কোভিড-১৯ মোকাবেলায় প্রস্তুতি ও প্রতিরোধের সমন্বয়ের মাধ্যমে সংক্রমণ শৃঙ্খলটিকে ভেঙ্গে ফেলার জন্য ভালো হতে পারে।
মার্ক্স ২১: নব্য-উদারবাদের ফলে স্বাস্থ্যসেবার পুনর্গঠন, গবেষণা ও রোগীদের জন্য মন্দই বয়ে এনেছে; যেমন ধরুন আমাদের হাসপাতালগুলো। একটা ভাল স্বাস্থ্য সেবা নীতি কিভাবে ভাইরাসটির মোকাবিলা কাজে আসতে পারে?
কয়দিন আগে মিয়ামির একজন স্বাস্থ্যসেবা কর্মী, যিনি সম্প্রতি চীন থেকে ফিরেছিলেন হালকা ঠান্ডা জ্বর নিয়ে, তার এলাকার হাসপাতালের কাছে দাবি জানান কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য। তিনি দুশ্চিন্তায় ছিলেন যে, তার সামান্যতম স্বাস্থ্যবীমার অপশন এর জন্য যথেষ্ট হবে না। তিনি ঠিকই ধারণা করেছিলেন। সেই টেস্টের জন্য তার বিল আসে ৩২৭০ মার্কিন ডলার।
আমেরিকানদের অবিলম্বে দাবি করতে হবে যে, সকল কোভিড-১৯ সম্পর্কিত টেস্ট ও ট্রিটমেন্ট এর খরচ যাতে ফেডারেল সরকার বহন করে। আমরা কোনভাবেই চাই না যে অতিরিক্ত উঁচু খরচের ভয়ে মানুষ টেস্ট সম্পন্ন না করে। আমরা চাই যে, তারা না লুকিয়ে অবিলম্বে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়। কিন্তু তার জন্য অবশ্যই সরকারকে কোভিড-১৯ সম্পর্কিত সকল চিকিৎসা এর ভার বহন করতে হবে।
মার্ক্স ২১: যখনই কোন দেশে ভাইরাসটি ধরা পড়ে তখনই সে দেশগুলোর সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী কাজকর্ম করে যেমন সম্পূর্ণ শহর অঞ্চলের জোরপূর্বক কোয়ারান্টিন। এসকল
পরিমাপগুলো কি সমর্থনযোগ্য?
মহামারীর নাম ধরে স্বৈরাচারী নিয়ন্ত্রণ শুধুমাত্র পুঁজিবাদের অকার্যকারিতাই প্রমাণ করে। জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে আমি বলব যে, পরস্পরের প্রতি আস্থা ও সমবেদনা সব সময়ের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এসব কিছু থেকে বাঁচতে হলে আমাদের সংহতি ও পারস্পরিক সম্মান মর্যাদা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংহতি মূলক কর্মের বাস্তবায়ন ঘটতে পারে স্ব-কোয়ারেন্টিন, সবার সকল প্রয়োজনীয়তা পূরণ হচ্ছে কিনা তার জন্য ট্রেনিং প্রাপ্ত মহল্লা- ব্রিগেড এর দ্বারা নিয়মিত দেখাশোনা, প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে খাদ্য ট্রাক দ্বারা খাদ্য বিতরণ, পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি ও বেকারত্ব বীমা ব্যবস্থা।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2020/03/03-11-37-dooms_day__nasreen_mitu.jpeg)
শিল্পী: নাসরিন মিতু
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট
মার্ক্স ২১: আপনি হয়তো আগে থেকে জেনে থাকবেন যে, আমাদের জার্মানিতে এএফডি নামক মোটামুটি নাৎসি ধারণার একটি পার্টি রয়েছে যাদের পার্লামেন্টে ৯৪ টি আসন রয়েছে। এসকল ডানপন্থি দল করোনা ভাইরাসের নাম ধরে তাদের ঘৃণামূলক কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তারা করোনা সম্পর্কে ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে সরকার দ্বারা কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা হাসিল করছে ও অভিবাসীদের দেশে আসা বন্ধ, জোরপূর্বক কোয়ারেন্টিন এবং সকল ফ্লাইট বন্ধের ব্যবস্থা করাচ্ছে…
এগুলো সব অবশ্যই ভিত্তিহীন। বর্ডার বন্ধ করা হোক বা না হোক হোক একটা বিশ্ব-মহামারীকে দেশে আসা থেকে বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব। যৌক্তিক কাজটি হলো আমাদের স্বাস্থ্যসেবা নীতিকে ভালো ভাবে বিকশিত করা যাতে ভাইরাস দেশে ঢুকলেও তার সংক্রমণ ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় ও রোগী যেই হোক না কেন তাদের ভালোভাবে চিকিৎসা ও রোগ সারানোর ব্যবস্থা করা যায়। আর অবশ্যই এসব কিছুর মূল অর্থাৎ অন্য দেশের মানুষের ভূমি দখল প্রকল্প ও প্রতিবেশ ধ্বংস কর্মসূচি বন্ধ করার মাধ্যমেই মহামারীর উৎপত্তিকে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা সম্ভব।
মার্ক্স ২১: টেকসই পরিবর্তন কী কী হতে পারে?
নতুন মহামারীর আশঙ্কা বন্ধ করতে চাইলে আমাদের খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। কৃষকদের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য এবং একটি শক্তিশালী পাবলিক সেক্টর পরিবেশের ধ্বংস ও রোগ সংক্রমণ কমাতে পারবে। ফসল ও ভান্ডারে বৈচিত্র্য আনতে হবে এবং কৌশলগতভাবে খামারে ও আঞ্চলিক ভাবে পুনঃঅরণ্যকরণ ব্যবস্থা করতে হবে। খামার-পশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ভিত্তিতে অন-সাইট বংশবৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে। ন্যায় ভিত্তিক উৎপাদনের সাথে ন্যায় ভিত্তিক বণ্টনের ব্যবস্থা করতে হবে। মূল্য ও ভোক্তা সমর্থন কর্মসূচির সাথে এগ্রো-ইকোলজিকাল উৎপাদনকে সমর্থন করতে হবে৷ আর অবশ্যই এসকল পরীক্ষাগুলোকে নব্য-উদারবাদী চাপ ও পুঁজি-নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রের শাসন থেকে রক্ষা করতে হবে।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2020/03/08-02-07-together___ali_rastroo.jpeg)
শিল্পী: আলি রাস্তু
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট
মার্ক্স ২১: মহামারীর মুখে সমাজবাদীরা কী কী করতে পারে?
অন্তত জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে এগ্রিব্যবসা সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করতে হবে। খাদ্য উৎপাদনের এরকম উচ্চ পুঁজিকরণ অবশ্যই এমন সব চর্চা বাস্তবায়ন করে যা মানব জাতির জন্য ধ্বংস নিয়ে আসে ও এরকম মারাত্মক রোগ উন্মুক্ত করে।
খাদ্য সিস্টেমগুলোর সামাজিকীকরণের জন্য আমাদের কাজ করতে হবে যাতে এরকম মারাত্মক মহামারীর সূচনাই না ঘটে। তার জন্য আমাদের যা করতে হবে তা হল খাদ্য উৎপাদনকে গ্রামীণ মহল্লার প্রয়োজনীয়তার সাথে আত্নীকরণ করা আর তার জন্য দরকার এগ্রো-ইকোলজিকাল চর্চা যা আমাদের পরিবেশ ও কৃষকদের রক্ষা করবে। আমাদের অর্থনীতি ও পরিবেশনীতির মধ্যকার পার্থক্য ঘুচিয়ে ফেলতে হবে। অর্থাৎ বলাই যায় আমাদের এ পৃথিবী জয় করতে হবে।
মার্ক্স ২১: এই ইন্টারভিউয়ের জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।