অনুবাদ : মাজহার জীবন
পুর্বকথন : এমা গোল্ডম্যান (১৮৬৯-১৯৪০) এনার্কিস্ট আন্দোলনের একজন প্রধান ব্যক্তি। বিশ শতকের প্রথম দিকে আমেরিকা ও ইউরোপে এনার্কিস্ট আন্দোলনের রাজনৈতিক দর্শন বিনির্মাণে তাঁর অসাধারণ ভূমিকা রয়েছে। তিনি বিখ্যাত এনার্কিস্ট জার্নাল মাদার আর্থ এর সম্পাদক ছিলেন। লেখাটি এনার্কিস্টদের রাজনৈতিক প্রচারপত্র হিসেবে আমেরিকার ফ্রি সোসাইটি ফোরাম থেকে ১৯৪০ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2018/11/Emma-goldman.jpg)
(১৮৬৯-১৯৪০)
আর্টওয়ার্ক: এলিয়া-ইলাস্ট্রেশন
সূত্র: ডিভিয়ান্ট আর্ট
মানুষের মন এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এর কারণ মনে হচ্ছে, আমাদের সভ্যতার মূলভিত্তিই যেন নড়ে গেছে। বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর মানুষ আস্থা হারাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা অনুধাবন করছেন যে,শিল্প-পুঁজিবাদ যে লক্ষ্য অর্জন করবে বলে আশা করা হয়েছিল তা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে।
একটা সমাধান খুঁজে পেতে দুনিয়াজুড়ে সকলে হিমশিম খাচ্ছে। সংসদীয় ব্যবস্থা ও গণতন্ত্র ক্রমাবনতির দিকে। ফলে ফ্যাসিবাদ ও এ ধরনের ‘শক্তিশালী’ সরকারের মাঝে মুক্তি খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে।
দুনিয়াজুড়ে বিদ্যমান বিরোধী মতগুলোর মাঝে সংগ্রাম এখন দানা বাঁধছে, ফলে সৃষ্ট সামাজিক সমস্যা দ্রুত সমাধানের দাবি উঠছে। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে সংকট, বেকারত্ব, যুদ্ধ, নিরস্ত্রীকরণ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপের ওপর ব্যক্তির কল্যাণ ও মানবসমাজের ভাগ্য নির্ভর করছে।
রাষ্ট্র সরকারের মাধ্যমে কার্যকর ও ক্ষমতাশীল। রাষ্ট্র বর্তমানে সকল চিন্তাশীল মানুষের কাছে গভীর মনোযোগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সভ্য সকল দেশের রাজনৈতিক উন্নয়ন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আমাদের কি আরো শক্তিশালী সরকার দরকার? সমাজের বর্তমান দুষ্টক্ষত ও দুর্দশা নিরাময়ে আমাদের কি গণতন্ত্র ও সংসদীয় সরকার কাম্য, নাকি কোনো না কোনো ধরনের ফ্যাসিবাদ নাকি রাজতান্ত্রিক, বুর্জোয়া বা সর্বহারার একনায়কতন্ত্র কাম্য?
অন্যভাবে বলা যায়, আমরা কি গণতন্ত্রের দুষ্টক্ষত সারাতে অধিকতর গণতন্ত্র চাইব, নাকি একনায়কতন্ত্র দ্বারা জনপ্রিয় সরকারের জর্ডিয়ান গিঁট১ কাটব?
আমার উত্তর–এ দুটোর কোনোটাই এর সমাধান না। আমি যেমনভাবে ফ্যাসিবাদ ও একনায়কতন্ত্র বিরোধী, ঠিক একইভাবে সংসদীয় পদ্ধতি ও তথাকথিত রাজনৈতিক গণতন্ত্রেরও বিরোধী।
নাৎসিবাদকে সঠিকভাবেই বলা হয় সভ্যতার প্রতি আক্রমণ। এটি যে-কোনো প্রকারের একনায়কতন্ত্রের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। বস্তুত তা সব ধরনের নিপীড়ন ও দমনমূলক অথরিটির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সত্যিকার সভ্যতা বলতে কী বোঝায়? সকল ধরনের প্রগতির অর্থ হলো ব্যক্তির অবশ্যম্ভাবী স্বাধীনতার বিকাশ। পাশাপাশি বহিঃশক্তির দ্বারা তার উপর আরোপিত সংশ্লিষ্ট অথরিটির ক্রমহ্রাস। এটা বস্তুগত তথা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলের জন্যও মঙ্গলজনক। বস্তুজগতে মানুষ যে মাত্রায় উন্নতি লাভ করেছে তার মাধ্যমে সে প্রকৃতিকে বশে এনেছে এবং তার জন্য উপযোগী করে তুলেছে। আদিম যুগে প্রথম আগুন আবিষ্কার করে অন্ধকারকে জয় করা, বাতাসকে বশীভূত করা কিংবা পানিকে নিয়ন্ত্রণে আনার মাধ্যমে প্রগতির পথে মানুষ ধাপে ধাপে এগিয়েছে।
মানুষের ভালো কিছু করার, যেমন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবন প্রচেষ্টায়, অথরিটি বা সরকার কী ভূমিকা পালন করেছে? এখন পর্যন্ত এ রকম কোনো উদাহরণ দেখা যায় না। অন্তত আশাব্যঞ্জক কোনো কিছু দেখা যায় না। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটিয়েছে ব্যক্তি এবং তা সাধারণত ঘটেছে অথরিটি, মনুষ্য ও ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা, বাধা ও যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করেই।
একইভাবে, রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ট্রাইবাল কিংবা গোষ্ঠীপ্রধান, রাজা ও রাজন্য, সরকার ও রাষ্ট্রের অথরিটি হতে যতদূর সম্ভব দূরে থেকেই রাজনৈতিক অগ্রগতির পথ তৈরি হয়। অর্থনৈতিকভাবে অগ্রগতি বলতে বোঝায়, ব্যাপক সংখ্যক মানুষের সমৃদ্ধি। সাংস্কৃতিকভাবে, অন্যান্য সকল অর্জন, যেমন অধিকতর স্বাধীনতা, রাজনৈতিক,মানসিক ও আত্মিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে, লক্ষণীয় মাত্রায় অর্জনই হলো অগ্রগতি।
এ দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের সাথে মানুষের সম্পর্কের সমস্যা সম্পূর্ণ আলাদা গুরুত্ব বহন করে বলে মনে হয়। তখন আর গণতন্ত্র না একনায়কতন্ত্র কাম্য বা ইতালীয় ফ্যাসিবাদ না হিটলারবাদ ভালো–এ ধরনের প্রশ্নের অবকাশ থাকে না। তখন আরো বড় ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দাঁড়ায়: রাজনৈতিক সরকার কিংবা রাষ্ট্র কি মানব সমাজের জন্য কল্যাণকর এবং তার ফলে সামাজিক ক্রিয়াকলাপ কিভাবে ব্যক্তির উপর প্রভাব ফেলে?
ব্যক্তি হলো জীবনের সত্যিকার বাস্তবতা। এটা নিজেই একটা বিশ্বজগৎ (cosmos)। সে রাষ্ট্রের জন্য অবস্থান করে না। ‘সমাজ’ বা ‘জাতি’ নামের বিমূর্ত কিছুর জন্যও সে অবস্থান করে না। এগুলো একক সত্তার অনেক মানুষের সমন্বয়ে গঠিত। সব সময় ব্যক্তি বা একক ব্যক্তিই হলো অত্যাবশ্যকীয়ভাবে বিবর্তন ও অগ্রগতির একমাত্র উৎস ও প্রেরণা। সভ্যতা হলো রাষ্ট্র, এমনকি ‘সমাজের’ বিরুদ্ধে ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির নিরন্তর সংগ্রাম। অন্যভাবে বলা যায়,রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র-পূজার দ্বারা আচ্ছন্ন ও বশীভূত সংখ্যাগরিষ্ঠের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম। মানুষের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হলো তার উপর আরোপিত মানুষেরই সৃষ্ট বাধা ও কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ,যা তার উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধিকে পঙ্গু করে রাখে। মানুষের চিন্তাজগৎকে সব সময় ঐতিহ্য ও প্রথা দিয়ে অসত্যের আবরণে আচ্ছন্ন করে রাখা হয় এবং ক্ষমতাবান ও সুযোগ-সুবিধা ভোগকারীদের স্বার্থে ভুল পথে চালিত মিথ্যা শিক্ষা দেওয়া হয়। অন্যভাবে বলা যায়, এটা রাষ্ট্র ও শাসকশ্রেণী করে। এই সার্বক্ষণিক ও নিরন্তর দ্বন্দ্বই হলো মানব সভ্যতার ইতিহাস।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2018/10/u28jzmGzRW-L8NxFPZFAJw.jpg)
শিল্পী: কিয়ানোস রামিজানি
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট
ব্যক্তিকতা (Individuality) বলা যেতে পারে ব্যক্তির চৈতন্য, যার দ্বারা সে নিজে কী এবং কিভাবে বেঁচে থাকে তা নির্ধারিত হয়। এটা প্রত্যেক মানুষেরই সহজাত ও তা তার মধ্যে বিকাশমান। রাষ্ট্র ও অপরাপর সামাজিক প্রতিষ্ঠান আসে ও যায়, কিন্তু ব্যক্তিকতা টিকে থাকে। ব্যক্তিকতার মোদ্দা কথা হলো তার প্রকাশ; তার মর্যাদা ও স্বতন্ত্রতার ধারণা হলো তার ভিত্তি, যেটা সে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করে। ব্যক্তিকতা কোনো নৈর্ব্যক্তিক ও যান্ত্রিক বিষয় নয়, যা রাষ্ট্র ‘ব্যক্তি’কে বোঝাতে চায়। ব্যক্তি কেবল উত্তরাধিকার ও পরিবেশের ফসল নয় এবং নেহাত কার্যকারণও নয়। ব্যক্তি হলো উপরের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য ও তার থেকে অনেক বেশি কিছু এবং একই সাথে অন্য কিছু। জীবন্ত মানুষকে কখনও সংজ্ঞায়িত করা যায় না। সে সকল মূল্যবোধ এবং জীবনের মূল উৎস। সে এটা বা অন্যটার অংশ না বরং সে সম্পূর্ণ। একক ব্যক্তিই পরিপূর্ণ যা বর্ধনশীল ও পরিবর্তনশীল। কিন্তু সব সময়ই সে একক ধ্রুব সত্তা।
ব্যক্তিতন্ত্রবাদ (Individualism) বিভিন্ন ধারণা ও মতামতের সাথে ব্যক্তিকতাকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। বিশেষত ‘জীর্ণ ব্যক্তিতন্ত্রবাদ’২ (rugged individualism) সাথে মেলানো যাবে না,যার মুখোশের আড়ালের উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তি ও তার ব্যক্তিকতাকে দমন ও পরাজিত করা। তথাকথিত ব্যক্তিতন্ত্র হলো সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যক্তি-মালিকানার অবাধ নীতি (laissez faire) যা আদতে আইনি চতুরতার মাধ্যমে জনসাধারণের ওপর শ্রেণীশোষণ, আধ্যাত্মিক অধঃপতন ও দাসত্ববৃত্তি মনোভাবকে পদ্ধতিগতভাবে জিইয়ে রাখা, যে-প্রক্রিয়া ‘শিক্ষা’ নামে পরিচিত। এই বিকৃত ও নীতিবর্জিত ‘ব্যক্তিতন্ত্রবাদ’ হলো ব্যক্তিকতার বর্ম। এটা বাহ্যিক কারণের জন্য, সম্পদের জন্য এবং সামাজিক মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের জন্য জীবনকে অধঃপতিত করে। এর সর্বোচ্চ আপ্তবাক্য হলো ‘একবার পেছনে পড়লে আর রক্ষা নাই’।
এই ‘জীর্ণ ব্যক্তিতন্ত্রবাদ’-এর অনিবার্য পরিণতি হলো আধুনিক কালের বৃহত্তম দাসত্ব, স্থূল শ্রেণীস্বাতন্ত্র্য যা লক্ষ লক্ষ মানুষকে দয়ার ওপর বেঁচে থাকতে বাধ্য করে। ‘জীর্ণ ব্যক্তিতন্ত্রবাদ’ মানে হলো সকল ‘ব্যক্তিতন্ত্র’ মালিকের জন্য, যেখানে জনসাধারণ দাস সম্প্রদায় হিসেবে পর্যবসিত হয় এবং যারা কেবল তথাকথিত মুষ্টিমেয় স্বঘোষিত ‘সুপারম্যান’দের সেবা করে। এই ধরনের ব্যক্তিতন্ত্রর সবচেয়ে বড় উদাহরণ সম্ভবত আমেরিকা। এখানে রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচার ও সামাজিক নিপীড়ণকে সমর্থন করা হয় এবং তাকে শ্রেষ্ঠত্বের তকমা লাগানো হয়। যেখানে মানুষের স্বাধীনতা ও সামাজিক সুযোগ নিয়ে বাঁচার জন্য মানুষের প্রচেষ্টা ও আকাঙ্ক্ষাকে ‘অ-আমেরিকান’ ও খারাপ বলে তিরস্কার করা হয়, সেই একই ব্যক্তিতন্ত্রর দোহাই দিয়ে।
একটা সময় রাষ্ট্র ছিল অজানা বিষয়। মানুষ সেই প্রাকৃতিক বাস্তবতায় কোনো রাষ্ট্র বা সংগঠিত সরকার ছাড়াই টিকে ছিল। মানুষ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতে পরিবারের মতো বসবাস করতো। তারা চাষাবাদ করতো এবং চারু ও কারুশিল্পের চর্চা করতো। ব্যক্তি, পরে যা পরিবার, ছিল সামাজিক জীবনের একেকটি একক, যেখানে একে অপরের থেকে স্বাধীন এবং প্রতিবেশীর কাছে সমান। তখন মানুষের সমাজে কোনো রাষ্ট্র ছিল না, কিন্তু এক ধরনের সংঘ কিংবা স্বেচ্ছা সংঘ ছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল পারস্পরিক নিরাপত্তা ও সুবিধা। বয়স্ক ও বেশি অভিজ্ঞরা ছিল মানুষের পথপ্রদর্শক ও উপদেশদানকারী। তারা জীবনের নিত্যদিনের বিষয়-আশয় ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করতো কিন্তু ব্যক্তিকে শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করতো না।
রাজনৈতিক সরকার ও রাষ্ট্রের ধারণা আরো অনেক পরের ঘটনা, যার উদ্ভব হয়েছে দুর্বলের ওপর সবলের ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ওপর সংখ্যালঘিষ্ঠর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সংকল্প নিয়ে। রাষ্ট্র, তা হোক ধর্মীয় কিংবা সেক্যুলার, আইনগত অবস্থান তৈরি করে সংখ্যালঘিষ্ঠ দ্বারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ওপর অন্যায়ের বৈধতা দেয়। জনগণকে সহজে শাসন করতে রাষ্ট্রের এই অবস্থানগত অধিকার প্রয়োজন হয়,কেননা জনগণের সম্মতি ছাড়া কোনো সরকারেরই অস্তিত্ব থাকে না। এ সম্মতি সরাসরি, কৌশলগত কিংবা অনুমিত হতে পারে। সংবিধানতন্ত্র ও গণতন্ত্র হলো আধুনিককালের সেই বৈধ সম্মতি। এ সম্মতি বিশেষভাবে মানিয়ে (inoculate and indoctrinated) নেয়া হয় যা ‘শিক্ষা’ নামে পরিচিত–যে শিক্ষা বাড়িতে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ও জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয়।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2018/11/the_power_of_the_public__menekse_cam.jpeg)
শিল্পী: মেনেকসে কাম
সূত্র: কার্টন মুভমেন্ট
এই সম্মতিই হলো অথরিটিতে বিশ্বাস এবং এর প্রয়োজনীয়তায় বিশ্বাস আনা। এ মতাদর্শের ভিত্তি হলো: মানুষ ক্ষতিকারক ও দুষ্ট এবং কোনটা তার নিজের জন্য ভালো তা বুঝতে পারার অযোগ্য। এর ভিত্তিতে সকল সরকার এবং নিপীড়নের সৃষ্টি। এই অন্ধবিশ্বাস দ্বারা ঈশ্বর ও রাষ্ট্র সমর্থিত হয় এবং টিকে থাকে।
তারপরও রাষ্ট্র মূলত একটা নামবাচক শব্দ ছাড়া কিছু না। এটা বিমূর্তায়ন। মানবতা, জাতি, জনগোষ্ঠী ইত্যাদি ধারণার মতো এর কোনো বাস্তব অবস্থান নেই। রাষ্ট্রকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে দেখানো হলো অসুস্থ প্রবণতা যার মাধ্যমে শব্দের কৃত্রিম আবেশ তৈরি করা হয়।
রাষ্ট্র হলো আইনি ও প্রশাসনিক পদ্ধতি যার মাধ্যমে মানুষের নির্দিষ্ট কিছু বিষয় লেনদেন হয় এবং তা বড়ই খারাপভাবে। এর মাঝে কোনো পবিত্র, রহস্যজনক কিংবা ঐশ্বরিক বিষয়ের বালাই নেই। একটা কয়লাখনি কিংবা রেল কোম্পানি পরিচালনার জন্য এ ধরনের বাণিজ্যিক কোম্পানির উদ্দেশ্যের বেশি রাষ্ট্রের কোনো বিবেক বা নৈতিক মিশন নেই।
ঈশ্বর ও শয়তানের যতটুকু অস্তিত্ব আছে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব তার চেয়ে বেশি নয়। উভয়ই সমানভাবে মানুষের সৃষ্টি ও প্রতিফলন। ব্যক্তিই একমাত্র বাস্তবতা। রাষ্ট্র হলো ব্যক্তির প্রতিচ্ছায়া, তার জড়তা, তার ভয় ও তার অজ্ঞতার ছায়া।
ব্যক্তি-মানুষ দিয়েই জীবনের শুরু ও শেষ। সে ছাড়া কোনো জাতি,মানবতা ও রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নেই। এমনকি মানুষ ছাড়া ‘সমাজ’ সম্ভব নয়। ব্যক্তিই,যে জীবনযাপন করে,শ্বাস-প্রশ্বাস নেয় এবং দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে, তার উন্নয়ন, অগ্রগতির জন্য তাকে নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয়, তারই নিজের তৈরি কাল্পনিক প্রতিষ্ঠান এবং বিশেষভাবে ‘রাষ্ট্রের’ বিরুদ্ধে।
আগের জামানায় ধর্মীয় অথরিটি চার্চের ইমেজে তাদের রাজনৈতিক জীবন পরিচালিত করতো। রাষ্ট্রের অথরিটি, শাসকের ‘অধিকার’ আসতো উপর থেকে; বিশ্বাসের মতো ক্ষমতাও ছিল ঐশ্বরিক। দার্শনিকেরা মোটা মোটা গ্রন্থ প্রণয়ন করে রাষ্ট্রের পবিত্রতা প্রমাণের চেষ্টা চালিয়েছে। কেউ কেউ প্রমাণ করতে চেয়েছেন রাষ্ট্র অমোঘ এবং ঈশ্বরের সমতুল্য। কেউ কেউ প্রলাপ বকে এই মত দিয়েছেন যে, রাষ্ট্র হলো ‘অতিমানবীয়’, ‘সর্বোচ্চ বাস্তবতা’ এবং ‘নিরঙ্কুশ’।
অনুসন্ধিৎসুতাকে ধর্মদ্রোহ (blasphemy) হিসেবে নিন্দা করা হতো। দাসত্বই ছিল সবচেয়ে বড় গুণ। এই ধরনের ধারণা ও প্রশিক্ষণের কারণে কিছু নির্দিষ্ট বিষয় অকাট্য প্রমাণ এবং তাদের বাণী ঐশ্বরিক বলে বিবেচিত হতো, যার কারণ ছিল মূলত তাদের অব্যাহত ও ধারাবাহিক পুণরাবৃত্তিক প্রচারণা।
সকল ধরনের অগ্রগতি হলো বাস্তবিক অর্থে ‘রহস্য’ ও ‘দেবত্ব’ এবং তথাকথিত পবিত্র ও চরম ‘সত্যের’ খোলস উন্মোচন করা। এ অগ্রগতি হলো বিমূর্ত ও প্রতিকল্পনা ধীরে ধীরে অপসারিত করে বাস্তব ও সুনির্দিষ্ট করা এবং তা প্রতিস্থাপন করা। সংক্ষেপে বলা যায়,তা অলীক কল্পনার বিপরীতে প্রকৃত ঘটনা, অজ্ঞতার বিপরীতে জ্ঞান এবং অন্ধকারের বিপরীতে আলো।
ব্যক্তির এই ধীর ও কষ্টকর মুক্তি রাষ্ট্রের সহায়তায় সম্পন্ন হয়নি। বরং উল্টো, এটা সম্পন্ন হয়েছে রাষ্ট্রের সাথে নিরন্তর দ্বন্দ্ব, জীবন-মৃত্যুর সংগ্রামের মাধ্যমে। এমনকি সামান্যতম স্বাধীনতা ও মুক্তি অর্জনেও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জয়ী হতে হয়েছে। এই সামান্য অর্জনকে রক্ষা করতে মানুষকে রাজা, জার এবং সরকারের বিরুদ্ধে সময়ক্ষেপণ ও রক্ত ঝরাতে হয়েছে।
সেই মানুষই দীর্ঘ গোলগোথার৩ মহানায়ক ছিলেন। সর্বদাই এই যুদ্ধ করেছে ব্যক্তি; প্রায়শই একা, কখনো-বা তার মতো অন্যদের সাথে নিয়ে। এই ব্যক্তি দমন, নিপীড়ণের বিরুদ্ধে যুগ যুগ ধরে লড়ছে, রক্ত ঝরিয়েছে। ক্ষমতা তাকে কখনো শৃঙ্খলিত করেছে, কখনো করেছে অপমানিত।
এর থেকে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো: মানুষ— ব্যক্তির আত্মাই অন্যায় ও অবনমনের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ করেছিল; অসহ্য রকম দগ্ধ হয়ে ব্যক্তির মাঝেই প্রথম প্রতিরোধের ধারণা সৃষ্টি হয়। সংক্ষেপে বলা যায়, ব্যক্তিই হলো সব সময় চিন্তা ও কর্মের মুক্তির জন্মদাতা।
এটা দিয়ে কেবল তার রাজনৈতিক সংগ্রামকেই বোঝাচ্ছে না বরং তা সকল কাল ও ভূখণ্ডের মানুষের জীবন ও প্রচেষ্টার সার্বিক ফসল। শক্ত মনোবল ও মুক্তির স্পৃহা-সম্পন্ন ব্যক্তিই সব সময় মানবসভ্যতায় অগ্রগতির পথ দেখিয়েছে। সে মুক্ত ও সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়েছে। বিজ্ঞান, দর্শন ও শিল্পকলার এবং কলকারখানায় তার প্রতিভা সুউচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, অসম্ভবকে সম্ভব করার পথ দেখিয়েছে, উৎসাহের সাথে অন্যকে কাজ ও সংগ্রামের জন্য অনুপ্রাণিত করেছে। সামাজিকভাবে বলা যায়, অবতার, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা, আইডিয়ালিস্ট, যারা এমন একটি দুনিয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে যা তাদের মনের আকাঙ্ক্ষাকেও ছাড়িয়ে গেছে। বৃহত্তর অর্জনের পথে তারা আলোকবর্তিকা হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে।
রাষ্ট্র, তা যে কোনো ধরনের সরকার দ্বারা পরিচালিত হোক না কেন, কর্তৃত্ববাদী বা সাংবিধানিক, নাৎসি কিংবা বলশেভিক–রাষ্ট্রের চরিত্রের কারণেই তা রক্ষণশীল, স্থবির, পরিবর্তনের ব্যাপারে অসহিষ্ণু এবং তার বিরোধীতাকারী। যে কোনো ধরনের পরিবর্তনের ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের উপর শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। এমন শক্তি প্রয়োগ প্রয়োজন হয় তাতে রাষ্ট্রকে শান্তিপূর্ণভাবে অথবা যা সাধারণত ‘অন্যভাবে’ অর্থাৎ বিপ্লবের মাধ্যমে পরিবর্তন করতে বাধ্য করা হয়। সর্বোপরি সরকারের তথা যে কোনো রকমের অথরিটির অন্তর্নিহিত সংরক্ষণশীলতা যা অবশ্যম্ভাবীভাবে প্রতিক্রিয়াশীল। এর কারণ দুটো। প্রথমত সরকারের চরিত্র হলো কেবল তার বিদ্যমান ক্ষমতা টিকিয়ে রাখাই না, বরং তা জাতীয়, এমনকি আন্তর্জাতিকভাবে আরো শক্তিশালী ও বিস্তৃত করা এবং তার অপব্যবহার করা। অথরিটি যত শক্তিশালী হয় ততই রাষ্ট্র ও তার ক্ষমতা বেড়ে যায়। তখন সে তার সমকক্ষ অথরিটি বা রাজনৈতিক শক্তিকে কম সহ্য করতে পারে। সরকারের মনস্তত্ত্ব হলো, দেশে-বিদেশে তার প্রভাব ও সম্মান ক্রমাগত বাড়ানো এবং এই বৃদ্ধির সকল সুযোগ সে নিজ স্বার্থে, ব্যবহার করে। এই প্রবণতার জন্য দায়ী অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ যাকে সরকার পেছন থেকে সহায়তা করে, আর সরকারই এর প্রতিনিধিত্ব ও কার্যকর করতে ভূমিকা রাখে। ঘটনাচক্রে সকল সরকারের উদ্দেশ্য (raison d’etre) সম্বন্ধে আগের দিনের ইতিহাসবিদেরা ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের চোখ বন্ধ রেখেছিল, যা হাল আমলে আরো বেশি প্রযোজ্য, যেখানে অধ্যাপকেরাও বিষয়টি অবজ্ঞা করেন।
সরকারের অধিকতর রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল হতে বাধ্য হওয়ার আরেক কারণ হলো রাষ্ট্রের উত্তরাধিকার সূত্রে ব্যক্তিকে অবিশ্বাস করা এবং ব্যক্তিকতাকে ভয় পাওয়া। আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্কিম ব্যক্তিকে ও ব্যক্তির নিরন্তর উদ্ভাবনের প্রচেষ্টাকে ধারণ করতে পারে না। ফলে রাষ্ট্র তার ‘নিজস্ব প্রতিরক্ষার’ জন্য তাকে দমিয়ে রাখে, নির্যাতন চালায়, শাস্তি দেয় এবং ব্যক্তির জীবনকে বঞ্চিত করে। এভাবেই বিদ্যমান ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার সকল প্রতিনিধিই এতে সহায়তা করে। রাষ্ট্র সকল ধরনের সহিংসতা ও শক্তি প্রয়োগের আশ্রয় নেয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ‘নৈতিক রোষ’ দ্বারা তা সমর্থিত হয় যা ধর্মবিরোধী, সামাজিক ভিন্নমতাবলম্বী, এবং রাজনৈতিক বিদ্রোহীর বিরুদ্ধে। শতাব্দীর পর শতাব্দী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে রাষ্ট্রপূজার জন্য তৈরি করা হয়, নিয়মানুবর্তী ও আজ্ঞাবহ হতে প্রশিক্ষিত করা হয় এবং অথরিটির আতঙ্ক দিয়ে দাবিয়ে রাখা হয়–গৃহে, বিদ্যালয়ে,ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ও প্রেসে।
অথরিটির শক্তিশালী ভিত্তি হলো তার ইউনিফরমিটি; এর থেকে সামান্য বিচ্যুতিই হলো মারাত্মক অপরাধ। আধুনিক জীবনের সামগ্রিক যান্ত্রিকতা ইউনিফরমিটিকে হাজারোভাবে বৃদ্ধি করেছে। অভ্যাস,স্বাদ,পোশাকআশাক,চিন্তা,ধারণা– সকল ক্ষেত্রেই এর উপস্থিতি। এর সবচেয়ে ঘনীভূত নির্বুদ্ধিতার রূপ হলো ‘জনমত’। কম মানুষই এর বিপরীতে দাঁড়ানোর সাহস রাখে। যে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানায় সাথে সাথে তাকে ‘অস্বাভাবিক’, ‘ভিন্নমতাবলম্বী’ ইত্যাদির তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয় এবং আধুনিক জীবনের নিরবচ্ছিন্ন স্বাচ্ছন্দ্য ভঙ্গের জন্য বিরক্তিকর উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
সম্ভবত গেড়ে বসা অথরিটির থেকেও সামাজিক ইউনিফরমিটি এবং একদর্শিতা যা ব্যক্তিকে সবচেয়ে বেশি নাজেহাল করে। তার বিশেষ ‘অনন্যতা’ ও ‘পৃথকতা’ এবং ‘পার্থক্যকরণ’ তাকে কেবল তার নিজ এলাকাতেই নয়,এমনকি নিজ বাড়িতেই বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। প্রায়ই বিদেশে জন্ম গ্রহণকারী,যারা সাধারণত এর শিকার, তার থেকেও অনেক সময় বেশি হয়।
সত্যিকার অর্থে একজনের নিজ এলাকা (native land) একজন সংবেদনশীল মানুষের কাছে তার নিজ জায়গা বলে মনে হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়, যদিও এর সাথে জড়িয়ে থাকে তার ঐতিহ্য,বিগত দিনের স্মৃতি,অনুভূতি ও অন্যান্য সুখকর বিষয়াবলি। ‘স্বত্বাধীনতা’ (belonging) এক বিশেষ পরিবেশ ও মানুষের সাথে ‘একাত্ম’ বোধের ধারণা হলো কোনো মানুষের নিজের জায়গায় মনে করার জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এটা ধরে রাখে কারো পরিবার, তার স্থানীয় ছোট পরিমণ্ডল, পাশাপাশি জীবনের বৃহত্তর পরিবেশ ও কার্যক্রম, যা তার দেশ হিসেবে পরিচিত। যে ব্যক্তির ভিশন দুনিয়াজুড়ে সেও প্রায়ই অনুভব করে সে তার নিজ ভূমির মতো। আর কোনো পরিপার্শ্ব তাকে এত সীমাবদ্ধ আর আলগা করে রাখে না।
যুদ্ধ-পূর্ব [প্রথম বিশ্বযুদ্ধ] সময়ে ব্যক্তি কমপক্ষে জাতীয় ও পারিবারিক একঘেয়েমি এড়াতে পারত। অনুসন্ধান ও আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য তার সামনে সারা বিশ্ব ছিল উন্মুক্ত। এখন পৃথিবী একটা কারাগারে পরিণত হয়েছে এবং জীবন একাকীত্বের জালে বন্দী হয়ে গেছে। এটা বিশেষভাবে সত্য যখন থেকে ডানপন্থী কিংবা বামপন্থী একনায়কত্বের জন্ম হয়েছে।
ফ্রেডরিক নিৎসে রাষ্ট্রকে শীতল দৈত্য বলেছেন। আধুনিক একনায়কতন্ত্রের যুগের এই ভয়ঙ্কর পশুকে তাহলে তিনি কী বলতেন? সরকার ব্যক্তিকে কখনোই বেশি সুযোগ দেয়নি,কিন্তু নতুন রাষ্ট্র ধারণার চ্যাম্পিয়নরা সেটুকু সুযোগও দেয় না। ‘ব্যক্তি কিছুই না’ এই বলে তারা ঘোষণা দেয় ‘কেবল সমষ্টির অংশ হিসেবে তারা আমলে আসবে’। ব্যক্তির সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ ছাড়া নতুন এ দেবতার সীমাহীন ক্ষুধা মিটবে না।
অবাক করা বিষয় হলো, ব্রিটিশ ও আমেরিকান ইনটেলিজেন্সিয়ার মধ্যে এ ধরনের নতুন সুসমাচারের (gospel) পক্ষে শক্ত ও উচ্চকন্ঠ পক্ষাবলম্বন লক্ষ্য করা যায়। তারা এখন ‘সর্বহারার একনায়কতন্ত্র’-এর অনুরক্ত, ভক্ত। এটা নিশ্চিত যে তা কেবল তত্ত্বগতভাবে। আর বাস্তবে, তারা এখনও তাদের নিজ নিজ দেশের সামান্যই মুক্তি চায়। তারা রাশিয়ায় সংক্ষিপ্ত সফরে যায়, অথবা ‘বিপ্লব’-এর ফেরিওয়ালা হিসেবে কাজ করে কিন্তু নিজ দেশেই তারা অধিকতর নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
সম্ভবত কেবল সাহসের অভাবই নয়, অনাগত স্বর্ণযুগের জন্যও এই সুশীল ব্রিটিশ ও আমেরিকানরা তাদের নিজ নিজ দেশে রয়ে যায়। অবচেতনভাবে তারা হয়তো এটা লালন করে যে, ব্যক্তিকতা হলো মানুষের সকল ধরনের সংঘের সবচেয়ে মৌলিক বিষয়, যা দমন ও পীড়নেও পরাজিত হয় না বরং শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়।
‘মানুষের প্রতিভা’ এক অর্থে ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিকতার অপর নাম। তার পথ খুঁজে পেতে হয় গোঁড়ামির গহ্বর, ঐতিহ্য ও প্রথার পুরু দেয়াল, সকল ধরনের ট্যাবুকে পরাভূত করে, অথরিটিকে তোয়াক্কা না করে, দুর্ব্যবহার ও বধ্যভূমির যন্ত্রণা সহ্য করে–পরিশেষে সে অবতার ও শহীদ হিসেবে পরবর্তী প্রজন্মর কাছে মহিমান্বিত হয়। কিন্তু ‘মানুষের প্রতিভার’ জন্য, যা ব্যক্তিকতায় সহজাত ও নিরন্তর যোগ্যতা,তা পেতে আমাদেরকে এখন প্রাগৈতিহাসিক জঙ্গলে খুঁজতে হবে।
পিটার ক্রপোটকিন দেখিয়েছেন, অন্যান্য ব্যক্তিকতার সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে শক্তিশালী হলে কিভাবে মানুষের এই অনন্য ব্যক্তিকতা চমৎকার ফল অর্জন করতে পারে। ডারউইনের সারভাইভাল অব দি ফিটেস্ট যা একপেশে ও সম্পূর্ণ অপর্যাপ্ত, জৈবিক ও সমাজতাত্ত্বিক পূর্ণতা লাভ করেছে মহান এনার্কিস্ট বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদের কাছ থেকে। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা মিউচ্যুয়াল এইড গ্রন্থে ক্রপোটকিন দেখিয়েছেন, জীব জগতে, সাথে সাথে মানবসমাজে, অন্তর্কলহ ও বিবাদের বিপরীতে সহযোগিতা প্রজাতির টিকে থাকা ও বিবর্তনের জন্য কাজ করে। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, কেবল পারস্পরিক সাহায্য এবং স্বেচ্ছামূলক সহযোগিতা স্বাধীন ব্যক্তি ও সহযোগিতামূলক জীবনের ভিত্তি তৈরি করতে পারে,যা সর্ব ধ্বংসাত্মক ও সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র পারে না।
বর্তমানে ব্যক্তি একনায়কত্বের হাতের পুতুল ও তার অন্ধ সমর্থক এবং ঠিক একইভাবে তারা ‘জীর্ণ ব্যক্তিতন্ত্রের’ প্রতি অনুরক্ত। আগেরটার অজুহাত হলো নতুন উদ্দেশ্য অর্জন। আর পরেরটা নতুন কিছুর ভানও করে না। বস্তুত ‘জীর্ণ ব্যক্তিতন্ত্র’ কিছু শেখে না, তাই কিছু ভোলেও না। এর ছায়াতলে শারীরিক অস্তিত্বের জন্য বর্বর সংগ্রাম এখনও চলমান। এটা দেখতে অদ্ভুত ও বাহ্যিকভাবে অবাস্তব মনে হলেও, শারীরিক অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম আনন্দের সাথে অব্যাহত রয়েছে। যদিও তার প্রয়োজনীয়তা সম্পূর্ণরূপে দূর হয়েছে। বস্তুত এই সংগ্রাম স্পষ্টত অব্যাহত রয়েছে কারণ এর আর কোনো প্রয়োজন নেই। তথাকথিত অতি-উৎপাদন (over production) কি তা প্রমাণ করে না? দুনিয়া জুড়ে অর্থনৈতিক সংকট কি এক বড় প্রমাণ না যে অন্ধ ‘জীর্ণ ব্যক্তিতন্ত্র’ তার নিজ ধ্বংসের বিপদ সত্ত্বেও বেঁচে থাকার সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে?
এই সংগ্রামের একটা পাগলামো বৈশিষ্ট হলো,উৎপাদনকারীর সাথে যে পণ্য সে উৎপাদন করে তার সাথে সম্পর্ককে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা। গড়পড়তা কর্মরত শ্রমিক তার ভেতর থেকে কারখানার কোনো অন্তঃসম্পর্ক বোধ করে না বরং সে কেবল ঐ কারখানার উৎপাদন প্রক্রিয়ার একজন আগন্তুক এবং কেবল তার যান্ত্রিক অংশ। যন্ত্রের অন্যান্য অংশের মতো সেও যে কোনো সময় প্রতিস্থাপনযোগ্য, তার মতোই বিমানবিকৃত (depersonalized) অন্য কোনো মানুষ দ্বারা।
বুদ্ধিবৃত্তিক সর্বহারা যদিও সে বোকার মতো নিজেকে মুক্ত সত্তা মনে করে, তার অবস্থাও কোনো মতেই ভালো না। তারও খুব কমই পছন্দ কিংবা নিজে চলার ক্ষমতা বা বিশেষ কোনো পেশা বেছে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে যেমনটি শারীরিক শ্রম দেওয়া তার শ্রমিক ভাইয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বস্তুগত বিবেচনা ও অধিকতর সামাজিক সম্মানের আকাক্সক্ষা হলো সাধারণভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক পেশা গ্রহণের নিয়ামক ফ্যাক্টর। এর সাথে যোগ হয় পরিবারের ঐতিহ্য অনুসরণ এবং এভাবেই কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, শিক্ষক ইত্যাদি হয়। কোনো কিছুতে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য কম প্রচেষ্টা ও ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন হয়। এর ফলে প্রায় সকলেই আমাদের বর্তমান বিষয়ের বাইরে থেকে যায়। সর্বসাধারণ পরিশ্রান্ত হলেও তাকে সামনে এগিয়ে যেতে হয়, এর আংশিক কারণ নিত্যদিনের কঠিন রুটিন এবং বেঁচে থাকার সংগ্রাম দ্বারা তাদের চেতনা আচ্ছন্ন করে রাখা হয়। হাল আমলের বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এটা এখনও প্রযোজ্য। এই বুননের মধ্যে স্বাধীন কাজ ও চিন্তার জন্য নিজের পছন্দের সুযোগ নেই। ভোট ও কর দেওয়া পুতুল ছাড়া আর কারো এখানে জায়গা নেই।
রাষ্ট্র ও ব্যক্তির স্বার্থ মৌলিকভাবে আলাদা এবং পরস্পরবিরোধী। রাষ্ট্র, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান যা রাষ্ট্রকে সমর্থন করে তা টিকে থাকে কেবল ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে ব্যবহার করে; ‘আইন ও শৃঙ্খলা’কে শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যমে, আনুগত্যের শিক্ষা দিয়ে,
সরকারের জ্ঞান ও বিচারের প্রতি আনুগত্য ও প্রশ্নাতীত বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে; সর্বোপরি, রাষ্ট্রের নির্দেশনায় আনুগত্য সেবা ও সম্পূর্ণ আত্ম-উৎসর্গ করার মাধ্যমে যেমনটি যুদ্ধে করা হয়ে থাকে। রাষ্ট্র নিজেকে এবং নিজের স্বার্থকে এমনকি ধর্ম ও ঈশ্বরের ওপরে স্থান দেয়। ব্যক্তিকতা-সম্পন্ন ধর্মীয় অথবা বিবেকবুদ্ধির কারণে দ্বিধান্বিতদের রাষ্ট্র শাস্তি দেয়। কারণ স্বাধীনতা ব্যতিরেকে কোনো ব্যক্তিকতা হয় না, আর স্বাধীনতা হলো অথরিটির সবচেয়ে বড় শত্রু।
এ ধরনের ভয়াবহ প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে ব্যক্তির সংগ্রাম করা আরো কঠিন। অধিকাংশ সময় তা জীবন ও দেহের জন্য হুমকিস্বরূপ কারণ এটা সত্য বা মিথ্যার বিষয় নয়, এটা হলো যে বিরোধিতার সে মুখোমুখি হয় তার মানদণ্ডে। তার চিন্তা ও কাজের বৈধতা বা কার্যকারিতা রাষ্ট্র বা ‘গণমতের’ শক্তিকে তার বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলে–এমনটা নয়। উদ্ভাবক ও প্রতিবাদকারীর শাস্তি সব সময় অনুপ্রাণিত হয় ভয় দ্বারা। এই ভয়ের পেছনে রয়েছে অথরিটির অমোঘতাকে প্রশ্নবিদ্ধ ও তার ক্ষমতাকে ছোট করে দেখা।
মানুষের সত্যিকার একক ও সামষ্টিক মুক্তি নিহিত আছে অথরিটি থেকে তার মুক্তি এবং অথরিটি সংক্রান্ত বিশ্বাস থেকে মুক্ত হওয়ার মধ্যে। মানুষের সকল ধরনের বিবর্তন হলো এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং একে লক্ষ্য করেই সেই সংগ্রাম। উদ্ভাবন ও যন্ত্রায়ন মানে উন্নয়ন নয়। ঘণ্টায় ১০০ মাইল উড়তে পারা সভ্যতার কোনো নিয়ামক নয়। সত্যিকারের সভ্যতা মাপা যায় ব্যক্তিকে দিয়ে, যা সকল সামাজিক জীবনের ইউনিট, তার ব্যক্তিকতা দিয়ে এবং সর্বগ্রাসী ও দমনপীড়নমূলক অথরিটি দ্বারা বাধাগ্রস্ত না হয়ে সে কতটুকু মুক্তভাবে বেড়ে উঠছে এবং বিস্তৃত হচ্ছে তার ওপর।
সামাজিকভাবে বলা যায়, সভ্যতা ও সংস্কৃতির মানদণ্ড হলো ব্যক্তি তার জীবনে কতটুকু স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক সুযোগ গ্রহণ করতে পারছে; কতটুকু সামাজিক ও আন্তর্জাতিক ঐক্য ও সহযোগিতা তৈরি হচ্ছে, যা মানুষ সৃষ্ট আইন ও অন্যান্য কৃত্রিম বাধা দ্বারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না; সুবিধাভোগী জাতিবর্গের অনুপস্থিতি এবং স্বাধীনতা ও মর্যাদার বাস্তবতা দ্বারা; সংক্ষেপে বলা যায় ব্যক্তির সত্যিকারের মুক্তির মাধ্যমে।
রাজনৈতিক নিরঙ্কুশবাদিতা বিলুপ্ত হয়েছে কারণ সময়ের সাথে সাথে মানুষ বুঝতে পেরেছে যে,নিরঙ্কুশ ক্ষমতা হলো ধ্বংসাত্মক ও ক্ষতিকর। আর তা সকল ক্ষমতার জন্যই প্রযোজ্য, হোক তা সুযোগের, অর্থের, ধর্মীয় পদের, রাজনৈতিক কিংবা তথাকথিত গণতন্ত্রের ক্ষমতা। দমন-পীড়ণের বিশেষ চরিত্র–ফ্যাসিবাদের মতো কালো, নাৎসিবাদের হলুদ কিংবা ভান করা বলশেভিকবাদের মতো লাল, ইত্যাদি যাই হোক ব্যক্তিকতায় প্রভাব পড়ে কম। ক্ষমতা প্রভু-ভৃত্য উভয়কেই দুর্নীতিগ্রস্ত ও অবদমিত করে এবং তা একনায়ক, পার্লামেন্ট বা সোভিয়েত যার কাছ থেকেই প্রযুক্ত হোক না কেন। একজন একনায়কের ক্ষমতার চেয়ে কোনো শ্রেণীর ক্ষমতা অধিকতর ভয়ঙ্কর; সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের জুলুম।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2018/11/leftovers__michel_moro_gomez__moro_.jpeg)
শিল্পী: মেরো
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট
ইতিহাসের দীর্ঘ প্রক্রিয়া মানুষকে শিখিয়েছে যে, বিভাজন ও বিবাদ মানে মৃত্যু আর ঐক্য ও সহযোগিতা অগ্রগতি ঘটায়, তার শক্তিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় ও আরো কল্যাণ বয়ে আনে। সরকারের স্পিরিট সব সময় এর সামাজিক প্রয়োগের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার বিপরীতে কাজ করে; ব্যতিক্রম হয় কেবল যেখানে রাষ্ট্র ও তার সহযোগীদের নিজস্ব স্বার্থ জড়িত থাকে। রাষ্ট্রের এবং সুবিধাভোগী শ্রেণীর এই প্রগতি বিরোধী ও সমাজ বিরোধী শক্তি, যার জন্য মানুষের সাথে মানুষের তিক্ত সংগ্রাম দায়ী। ব্যক্তি ও ব্যক্তির সমষ্টি বৃহত্তর গ্রুপ তখন দেখতে শুরু করে উপরিতলে সবকিছু প্রতিষ্ঠিত চিত্র। তখন আর তারা পূর্বের মতো ধোঁয়াশা ও ফাঁকা ধারণা নিয়ে থাকে না এবং ‘জীর্ণ ব্যক্তিতন্ত্রতার’ ‘আশীর্বাদ’ নেয় না। মানুষ বৃহত্তর মানবিক সম্পর্কে উপনীত হয় যা কেবল স্বাধীনতাই দিতে পারে। এটি ‘সংবিধান’ ‘আইনগত অধিকার’ বা ‘আইন’ ইত্যাদি কাগুজে শব্দ নয়। এটা কোনো কিছু থেকে মুক্ত হয়ে সত্তার নেতিবাচকতা নয়; কারণ এ ধরনের মুক্তি পেলে হয়তো আপনাকে না খেয়ে মরতে হবে। সত্যিকারের মুক্তি, সত্যিকারের স্বাধীনতা হলো ইতিবাচক এটা কোনো কিছু করার স্বাধীনতা; এটা হয়ে ওঠার, কিছু করার স্বাধীনতা। সংক্ষেপে বাস্তব ও সক্রিয় সুযোগের স্বাধীনতা।
এ ধরনের মুক্তি কোনো দয়া-দাক্ষিণ্য নয়। এটা মানুষের–সকল মানুষের সহজাত অধিকার। এ অধিকার কাউকে দেওয়া যায় না। এটা কোনো আইন কিংবা সরকার আরোপ করতে পারে না। সকল ধরনের দমন-পীড়ন অমান্য করা হলো এর সহজাত প্রকাশ। বিদ্রোহ ও বিপ্লব হলো এ থেকে মুক্তির কোনো না কোনোভাবে সচেতন প্রয়াস। এ ধরনের ব্যক্তিক বা সামাজিক প্রকাশ হলো মানুষের মূল্যবোধের মৌলিক প্রকাশ। এ মূল্যবোধ ধারণ করার জন্য কমিউনিটিকে এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, এর সবচেয়ে টেকসই এবং বড় সম্পদ, একক হলো–ব্যক্তি।
বাস্তবতাকে মোকাবিলায় রাজনীতির মতো ধর্মেও মানুষ বিমূর্তায়ন এবং বিশ্বাস নিয়ে কথা বলে। কিন্তু যখন তা বাস্তব ও স্পর্শযোগ্য বিষয় হিসেবে সামনে আসে,মনে হয় তখন অধিকাংশ মানুষ এর সাথে একাত্মতা হারিয়ে ফেলতে থাকে। এর অন্যতম কারণ হতে পারে কেবল বাস্তবতা মানুষের হৃদয়ে উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে যথেষ্ট নয়। নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়াবলি ও সাধারণের বাইরের কোনোকিছু দ্বারা মানুষের মধ্যে উর্দ্দীপনা সৃষ্টি হতে পারে। অন্যভাবে বলা যায়, আইডিয়াল বা আদর্শ হলো সেই জিয়নকাঠি যা কল্পনাও মানুষের হৃদয়ে শিখা জ্বালাতে পারে। মানুষের জড়তা এবং তার অস্তিত্বের সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে কিছু কিছু আইডিয়ালের প্রয়োজন পড়ে যার মাধ্যমে সে দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে নায়কোচিত ব্যক্তিতে পরিণত হতে পারে।
এখানে অবশ্য বিরোধিতাকারী মার্ক্সবাদী যারা নিজেরাই মার্ক্সকে বিসর্জন দিয়েছেন তাদের প্রসঙ্গ আসে। তাদের কাছে মানুষ হলো দূরকল্পী ঈশ্বর বা অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণবাদ, আরো নগ্নভাবে বলা যেতে পারে, শ্রেণী সংগ্রামের হাতের পুতুল মাত্র। এ সকল মার্ক্সবাদীরা মানুষের ব্যক্তিক ও সামষ্টিক ইচ্ছা,তার মনোজাগতিক জীবন ও মানসিক ধরন ইত্যাদি বিবেচনাই করেন না এবং এগুলো তার মানবসভ্যতার ইতিহাসের ধারণায় প্রভাব ফেলে না।
কোনো বুদ্ধিমান ছাত্রই সামাজিক অগ্রগতি ও মানবসভ্যতার উন্নয়নে অর্থনৈতিক ভূমিকাকে অস্বীকার করবে না। কিন্তু ব্যক্তির কল্পনা ও আকাঙ্ক্ষার দ্বারা সৃষ্ট কোনো ধারণা যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, তাকে সংকীর্ণ ও স্বেচ্ছাকৃত গোঁড়ামি অবজ্ঞা করে।
মানুষের অভিজ্ঞতায় এক ফ্যাক্টর দিয়ে আরেক ফ্যাক্টরের সাথে ভারসাম্যের চেষ্টা করা অর্থহীন ও অপ্রয়োজনীয়। ব্যক্তি ও সমাজের জটিল আচরণে কোনো একক ফ্যাক্টরকে সিদ্ধান্তগ্রহণমূলক ফ্যাক্টর হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। কোনো মানুষের আচরণ নির্ধারণে তার মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে আমরা খুবই কম জানি, এমনকি হয়তো কখনোই পর্যাপ্ত জানতে পারবো না। আমরা এও জানি না, এই আচরণ নির্ধারণে কোন কোন আপেক্ষিক ফ্যাক্টর আমরা পরিমাপ করবো ও বিবেচনায় আনবো। এ ধরনের অন্ধ বিশ্বাস তৈরিতে সামাজিক গূঢ়ার্থ হলো তাদের গোঁড়ামি ছাড়া আর কিছুই না। যদিও, সম্ভবত এর ব্যবহার রয়েছে এবং তা প্রমাণ করতে হয় মানুষের ইচ্ছার অনড় অবস্থান ও মার্ক্সবাদীদের যুক্তি ভুল প্রমাণ করে।
সৌভাগ্যক্রমে এমনকি কিছু মার্ক্সবাদী বুঝতে শুরু করেছে যে, মার্ক্সবাদের সবকিছুই যে ভালো তা ঠিক নয়। সর্বোপরি মার্কস একজন মানুষ– যেমন সকলেই মানুষ–ফলে কোনোভাবেই তিনি ভুলভ্রান্তির উর্ধ্বে নন। রাশিয়ায় অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণবাদের বাস্তব প্রয়োগ অধিকতর বুদ্ধিমান মার্ক্সবাদীদের কাছে তা পরিষ্কার হতে সাহায্য করছে। সমাজতান্ত্রিক এমনকি কমিউনিস্ট নামধারী ইউরোপের দেশগুলোকে মার্ক্সিয়ান মূল্যবোধকে পুনর্মূল্যায়ন করতে দেখা যাচ্ছে। তারা এখন ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে, তাদের তত্ত্ব মানবিক দিককে উপেক্ষা করেছে,সমাজতান্ত্রিক পত্রিকা ডেন মেনচেইন তা প্রকাশ করেছে। মানবসভ্যতার নবজাগরণের (rejuvenation of mankind) জন্য প্রয়োজন একটি আদর্শের উর্দ্দীপনা এবং তেজস্বী শক্তি।
এ রকমের আদর্শ আমি এনার্কিজমের মধ্যে পাই। তবে এটা নিশ্চিত যে, তা রাষ্ট্র ও অথরিটির পূজারিদের দ্বারা এনার্কিজমের প্রচলিত অপব্যাখ্যা না। এটা দিয়ে আমি নতুন সমাজ ব্যবস্থার দর্শনকে বোঝাতে চাইছি যার ভিত্তি হলো ব্যক্তির অফুরন্ত শক্তি এবং মুক্তিমনা ব্যক্তিবর্গের মুক্তসংঘ।
সকল ধরনের সামাজিক তত্ত্বের মধ্যে এনার্কিজমই একমাত্র দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করতে পারে যে, সমাজের অস্তিত্ব কেবল মানুষের জন্য,মানুষ সমাজের জন্য না। সমাজের একমাত্র বৈধ উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তির অগ্রগামী আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজন পুরন করা। কেবল এভাবেই সমাজের অস্তিত্বের ন্যায্যতা এবং তা অগ্রগতি ও সংস্কৃতির অংশ হতে পারে।
যে মানুষ ও রাজনৈতিক দল বর্বরভাবে ক্ষমতার জন্য উন্মাদ হয়ে গেছে তারা আমাকে গালাগাল করবে। আমি আনন্দের সাথে তাদের সে সব গালাগাল শুনতে রাজি আছি। আমি এটা ভেবে নিশ্চিত হই যে, তাদের মানসিক অস্থিরতা ক্ষণিকের। তাদের উদ্ধারের চিৎকার কয়েক ঘণ্টার জন্য মাত্র।
সকল প্রকারের অথরিটি ও ক্ষমতাবলয় থেকে মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, অথরিটি ও ক্ষমতাবানদের ভাঙা রেকর্ডে কখনোই নিভে যাবে না। সমস্ত শেকল হতে মুক্তির এই মানব অনুসন্ধিৎসা চিরকালীন। এ অনুসন্ধান থামলে চলবে না, তা চলবেই।
তথ্যপঞ্জি
১. সাধারণত খুব কঠিন কোন সমস্যা ভিন্ন ধারায় চিন্তা করে খুব সহজ উপায়ে সমাধান করার রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
২. শব্দদ্বয় প্রেসিডেন্ট হাভার্ড হুভার বারবার ব্যবহার করতেন। এ ধারণার মাধ্যমে বোঝায়, প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজকে সাহায্য করবে, যেখানে রাষ্ট্র মানুষের অর্থনৈতিক জীবন প্রবাহ বিশেষত জাতীয় অর্থনীতির কোন ভূমিকা থাকবে না, যার সঙ্গে সোসাল ডারউইনিজমের মিল আছে।
৩. বাইবেল অনুসারে জেরুজালেম দেয়ালের পাশের একটি স্থান যেখানে যিশুকে হত্যা করা হয়েছিল।
সম্পাদকীয় নোট: রচনাটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত রাষ্ট্রচিন্তা পত্রিকায় ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রথম প্রকাশিত হয়।