- অনুবাদ: শাহারিয়ার জিম
ভূমিকা
আঁলা বাদিয়্যু প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক। করোনা ভাইরাস মহামারী প্রসঙ্গে বাদিয়্যু’র বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে verso -তে On the Epidemic Situation শিরোনামে।বাদিয়্যু’র লেখাটির ইংরেজি অনুবাদক আলবার্তো তসকানো। তসকানো বাদিয়্যু’র বই ও অন্যান্য লেখাজোঁখা নিয়মিত অনুবাদ করেন। গত ২৩ শে মার্চে এই ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। তসকানোকৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে এখানে বাংলা ভাষায় বাদিয়্যু’র লেখাটির অনুবাদ করেছেন শাহারিয়ার জিম। বোধিচিত্তর সৌজন্যে প্রকাশ করা হল।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2020/04/Introducing-Alain-Badiou-A-Graphic-Guide.jpg)
মূল রচনা
শুরু থেকে আমার কাছে মনে হচ্ছিল বর্তমানে এই ভাইরাসজনিত মহামারী বিশেষ কোনো ব্যতিক্রম পরিস্থিতি না। এইডস’সহ আরও অন্যান্য জীবাণু যেমন এভিয়ান ফ্লু, ইবোলা ভাইরাস এবং সার্স-১ ভাইরাস, এমনকি নতুন ধরনের যক্ষ্মা ও হাম ধরনের রোগ, এগুলো বর্তমানে আর অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দমন করা সম্ভব হয় না- আমরা এও জানি যে, বর্তমানে চিকিৎসাব্যবস্থা ও ভ্যাক্সিনেশনের ব্যাপারে বৈশ্বিক বাজারের অবহেলা এবং বৈশ্বিক শৃঙ্খলার অভাব, এই দুই কারণে অবধারিতভাবেই গুরুতর এবং বিধ্বংসী মহামারী রূপ নেয় (যেমন এইডসের ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু)। এছাড়াও বর্তমানের মহামারী পরিস্থিতি পশ্চিমা তথাকথিত আরামের জীবনকে ব্যাহত করছে এমন বিলাপও শোনা যাচ্ছে যা কোনো নতুন তাৎপর্য বহন করে না। বরং এটি একটি অনিশ্চিত আর্তনাদের মতই যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নির্বুদ্ধিতা বৈ আর কিছুই না। ভাইরাস প্রতিরোধের পূর্বপ্রস্তুতি এবং ভাইরাস যাতে আর নতুন কাউকে সংক্রমণ করার মত না পায়, এমন কোনও পদ্ধতি গ্রহণ করা হলেও অন্তত নৈতিকতার প্রশ্নে একটি বিশেষ অবস্থান পাওয়া যেত।
বর্তমান মহামারীর নামের দিকে তাকালেও আমরা বুঝতে পারি যে এটা নতুন কোনও পরিস্থিতি নয়। সার্স-২ বা Severe Acute Respiratory Syndrome 2 নামটিই ইঙ্গিত করে যে এই ভাইরাসের দ্বিতীয়বারের মত আবির্ভাব ঘটেছে। এর পূর্বেও সার্স-১ ভাইরাসের আক্রমণ ঘটে ২০০৩ সালের বসন্তকালে। সেসময়ে এটিই ছিল ‘একবিংশ শতাব্দীর প্রথম অজ্ঞাতরোগ’। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে বর্তমানের মহামারী কোনো অর্থেই একেবারে আমূল নতুন কিছুর আবির্ভাব নয়। এর আগেও একই জাতের ভাইরাস আমরা এই শতাব্দীতেই দেখেছি এবং তারই বংশধর এটি। এরকম পরিস্থিতিতে এটাই বলা যায়, সার্স-১ এর আবির্ভাবের পর চিকিৎসাক্ষেত্রে যথাযথ অর্থনৈতিক বিনিয়োগ করা হয়নি যাতে করে এমন ভাইরাসের (সার্স-২) আবার আবির্ভাব ঘটলে সেটিকে মোকাবেলা করা যায়।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2020/04/01-02-51-passover_2020___pedro_x__molina.jpeg)
শিল্পী: পেড্রো
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট
তো এই সময়ে সবার মতই বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘরে বসে থাকার চেষ্টা করা এবং সবাইকে একই পদ্ধতি অবলম্বন করার কথা বলা ছাড়া আমার আর কিছু করার আছে বলে মনে হয়নি। ভাইরাস থেকে বাঁচাতে কাজ করা সুরক্ষাকর্মী যেমন মেডিকেল স্টাফ, শৃঙ্খলাকর্মী যারা একেবারে সামনের কাতারে এই ভাইরাসের মুখোমুখি তাদেরও যথাযথা নিরাপত্তা এবং যথাযথ শৃঙ্খলাপ্রদানের ব্যবস্থা করাটাও জরুরী। এছাড়াও সংক্রমিত রোগীদের পাশাপাশি যারা এই ভাইরাসের আক্রমণে সবথেকে ঝুঁকির মুখে যেমন বৃদ্ধবয়সের লোকজন এবং মহামারীর আতঙ্ক নিয়েও কাজে যেতে হয় যাদের, তাদের চিকিৎসার নিশ্চিত ব্যবস্থা রাখাও অত্যাবশ্যক। ‘বাড়িতে থাকুন’ ধরনের সতর্কবার্তা দেয়ার আগে এটিও ভাবা উচিত যে, যাদের থাকার বাসস্থানই নেই তারা কোথায় থাকবে, তাদের জন্য নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থার কথাটিও ভাবা দরকার। এক্ষেত্রে হোটেলগুলোতে সাময়িক বাসস্থানের ব্যবস্থাও করা যেত।
এটা সত্য যে এই ধরনের দায়িত্বগুলো অন্তত প্রাথমিক অবস্থায় খুব দ্রুতই অত্যন্ত দরকারি হয়ে পড়েছে, কিন্তু এগুলোর ব্যবস্থা করতে খুব বেশি বিশ্লেষণী মাথা কিংবা নতুন ধরনের চিন্তা করার দরকার পড়ে না।
আমরা এখন যে পরিস্থিতিতে আছি এমন একটি সোজাসাপ্টা পরিস্থিতি নিয়ে আমার আশেপাশের মহলগুলোয় অনেক ধরনের আলাপ আলোচনা শুনছি এবং পড়ছি। এই সোজাসাপ্টা পরিস্থিতি নিয়ে তাদের বোঝাপড়ার অক্ষমতা আমার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই এক প্রকার অসন্তোষ এবং ধাঁধার জন্ম দিয়েছে।
এসব দৃঢ় বিবৃতি, করুণ আবেদন এবং জোরালো দোষারোপ বিভিন্ন রূপধারণ করে, তবে এগুলো সবই বর্তমান মহামারী পরিস্থিতির সারল্য এবং নতুনত্বের ব্যাপারটিকে এমনভাবে উপেক্ষা করছে যা কৌতুহলের উদ্রেককারী। কেউ কেউ ক্ষমতার সামনে অপ্রয়োজনীয়ভাবেই নতজানু এবং তারা বর্তমানে সেই কর্মকান্ডগুলোই করছে যেগুলো করতে তাদের এই দুর্বলতা বাধ্য করে। বাকিরা পৃথিবী এবং এর সম্পর্কিত কিছু অতীন্দ্রিয়বাদী ঘটনার সাথে তুলনা করছে সেটিও কোনও কাজের নয়। কেউ কেউ আবার সব দোষ অভাগা ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাকরনের উপর চাপাচ্ছে, যদিও একজন রাষ্ট্রপ্রধান যুদ্ধ কিংবা দুর্যোগের সময় যা করে থাকে, তাই করছে ম্যাকরন স্বাভাবিকভাবে। অনেকে আবার এই সময়ে এমন এক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছে যা এখন পর্যন্ত নজিরবিহীন এবং এই ভাইরাস মোকাবেলায় বর্তমানে যার কোনও তাৎপর্য নেই, ফলশ্রুতিতে এই ভাইরাস ঠেকাতে নতুন কোনো উদ্যোগ বা চিন্তার লক্ষণ নেই ‘বিপ্লবীদের’ মধ্যেও। কেউ কেউ আবার এটিকে কেয়ামতের লক্ষণ ভেবে হতাশায় পর্যবসিত হচ্ছে। আর বাকিরা সমসাময়িক মতাদর্শ অনুযায়ী ‘আমি আগে’ ধাঁচের ‘সুবর্ণমন্ত্র’ অবলম্বন করছে, এবং এই মন্ত্রও আসলে বর্তমান পরিস্থিতিতে অনিষ্টই ডেকে আনে জোরালোভাবে।
মহামারীর চ্যালেঞ্জে মনে হচ্ছে সব জায়গাতেই যুক্তিবুদ্ধির কার্যক্ষমতা ভেঙ্গে পড়েছে, যার কারণে মধ্যযুগীয় প্লেগের সময় যেমন মানুষের মধ্যে এক ধরনের অতীন্দ্রিয়বাদ, প্রার্থনা এবং দৈববাণীসংক্রান্ত কর্মকান্ড বেড়ে যেত ঠিক তেমনটাই দেখা যাচ্ছে বর্তমান সময়েও। সুতরাং এই সোজাসাপ্টা বিষয়গুলো নিয়ে একসাথে কিছু আলোচনা করার তাড়নাবোধ করছি। এই আলোচনায় আমি কোনো সংকোচ ছাড়াই কার্তেসীয় পদ্ধতি অবলম্বন করবো।
যেহেতু অন্যান্য আলোচনায় সমস্যাটির সংজ্ঞায়ন এবং বোঝাপড়া বেশ নাজুক, তাই প্রথমেই সমস্যাটির সংজ্ঞায়ন দিয়ে শুরু করা যাক।
যেকোন মহামারী সবসময়েই প্রাকৃতিক এবং সামাজিক কিছু উপাদানের উপর ভিত্তি করে হয়ে থাকে, যার ফলে ব্যাখ্যার সময় এটি স্বভাবতই একটি জটিল পরিস্থিতির তৈরী করে। সুতরাং এটির সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ এই দুইয়ের সমন্বয়েই হতে পারে: পরিষ্কার বোঝাপড়ার জন্য অবশ্যই এর প্রাকৃতিক ও সামাজিক দুটি দিক নিয়েই ভাবা উচিত এবং এই দুটি ব্যাপার কোথায় এসে মিলিত হয় তার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তে আসা দরকার।
উদাহরণস্বরূপ, বর্তমান মহামারীর কেন্দ্রস্থল হিসেবে বলা যায় উহান প্রদেশের বাজারগুলোকে চীনাবাজারগুলো তাদের ভয়ংকর নোংরা পরিবেশ এবং উন্মুক্তস্থানে সব ধরনের পশুপাখি গাদাগাদি অবস্থায় রেখে বিক্রিবাট্টা চালানোর জন্য পরিচিত। তাই বলা চলে, বাদুড়ের শরীরে ভাইরাসটি জন্মলাভের পর ছড়িয়ে পড়ার জন্য বেশ উপযুক্ত একটি জনবহুল অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ পেল।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2020/04/the_forbidden_food_bat_soup___ali_miraee__seyed_ali_miraee_.jpeg)
শিল্পী: আলি মিরায়ি
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট
একটি প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ভাইরাসটি কীভাবে ছড়ালো সেটির ব্যাখ্যা এখনও আমরা জানি না। একমাত্র বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমেই সেটি আমরা জানতে পারব। আপাতত অনলাইনে চলমান বর্ণবাদী মিথ যেমন চীনা জাতির লোকজন আধাকাঁচা বাদুড়ের মাংস খায়, এসব বাদ দিয়ে পুরো বিষয়টি নিয়ে একটু পরিষ্কারভাবে চিন্তা করা যাক…
লোকালয়ের সাথে অন্যান্য প্রাণীর সংস্পর্শ, যা মূলত মানুষের সাথে প্রাণীগুলোর সম্পর্ক স্থাপন করে, এই বিষয়টি পুরো ঘটনার মূলকেন্দ্র। এই সম্পর্ক ছাড়াও সমসাময়িক বিশ্বের একটি মৌলিক উপাত্তও রয়েছে: চীনা রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী পর্যায়ে উত্থান, অর্থাৎ বৈশ্বিক বাজারে চীনের তীব্র প্রভাব। ভাইরাসটি মূলত যেখান থেকে ছড়িয়ে পড়লো, সেই জায়গাটির সাথে বিশ্বের অন্যান্য অসংখ্য স্থানের একটি নেটওয়ার্ক রয়েছে। তারপরেও অবশ্য ভাইরাস ধরা পড়ার পর পুরো অঞ্চলটিকে যেখানে ৪ কোটি লোকের বসবাস, সেটিকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে সক্ষম হয় চীন। তবে ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে আসলে, মহামারী ভাইরাস ততক্ষনে জাহাজ এবং উড়োজাহাজে ভ্রমণের মাধ্যমে বৈশ্বিকভাবে অস্তিত্ববান হয়ে ওঠার পথে।
আমি প্রথমে যে দ্বিমুখী বিশ্লেষণের কথা বললাম সেই পদ্ধতি ব্যবহার করে এখন কিছু বিষয় খোলাসা করা যাক: আজকে উহান প্রদেশে সার্স-২ ভাইরাসকে প্রতিরোধ করা গেলেও সাংহাইতে এই ভাইরাসে অনেকেই সংক্রমিত হচ্ছে এখনও, এবং সেটি স্থানীয় লোকজন নয় বরং বাইরে থেকে আসা প্রবাসী চীনা লোকজনের মাধ্যমেই সংক্রমণ ঘটছে। যেকারণে বুঝা যায় চীন দুইটি বিষয়ের যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে, এর মধ্যে একটি আদিম, অন্যটি আধুনিক। একদিকে প্রকৃতি-সমাজ যোগসূত্র যা পরিচালিত হয় আদিম পর্যায়ের নোংরা পরিবেশের বাজারব্যবস্থার মাধ্যমে। অন্যদিকে বৈশ্বিক নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত থাকা, পুঁজিবাদী বৈশ্বিক বাজারের মত গতিশীল ব্যবস্থায় অংশগ্রহন করা, যেটি আধুনিক পর্যায়কে ইঙ্গিত করে।
এরপর আলোচনা করা যাক স্থানীয় পর্যায়ের প্রাদেশিক সরকারগুলো নিয়ে, যারা এই ব্যাপ্তিকে দমন করতে সচেষ্ট। আমাদেরকে এটা খেয়াল রাখতে হবে যে প্রশাসনিক বিষয়গুলো একেবারেই স্থানীয়, অন্যদিকে মহামারী ব্যাপারটি আন্তর্জাতিক। কিছু আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের অস্তিত্ব থাকলেও, এটি পরিষ্কার যে স্থানীয় বুর্জোয়া সরকারই প্রথম সারিতে রয়েছে প্রশাসনিক কাজের ক্ষেত্রে।
এখানে আমরা বর্তমান বিশ্বের একটি মুখ্য স্ববিরোধীতা দেখতে পাই। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বৈশ্বিক বাজারের উপর নির্ভর করে তার উৎপাদনব্যবস্থা জারি রাখে— আমরা জানি যে একটি মোবাইল ফোন প্রস্তুত করতেই কয়েকটি রাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন কাঁচামাল যোগাড় করতে হয়। অন্যদিকে রাজনৈতিক ব্যবস্থা আবার জাতীয় পর্যায়ে পরিচালিত হয়ে থাকে। পুরানা সাম্রাজ্যবাদ (ইউরোপ ও আমেরিকা) এবং নতুন সাম্রাজ্যবাদ (চীন, জাপান…) এই দুইয়ের দ্বন্দের ফলে এখনও পুঁজিবাদী বৈশ্বিক রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এই মহামারীও ঠিক তেমনই একটি পরিস্থিতি যেখানে অর্থনীতি ও রাজনীতির দ্বন্দ্ব ঘোরতর হয়ে ওঠে। এমনকি ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রগুলোও নিজেদের মধ্যে কোনও সমন্বিত পলিসির দিকে যেতে পারছে না এই ভাইরাসের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও।
এই স্ববিরোধিতার ফলে জাতীয় রাষ্ট্রগুলো এমন সব কর্মকাণ্ড এবং পলিসি নিচ্ছে যা পুঁজির কার্যক্ষমতাকে বলবৎ রেখেই প্রয়োগ করা যায়, যদিও ভাইরাসের হুমকির মুখে তাদের এখন অন্য পদ্ধতি এবং অন্য ধরনের ক্ষমতা চর্চা প্রয়োগ করতে হবে।
আমরা আগে থেকেই জানি যে স্থানীয় পুঁজিবাদকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে যেকোনো যুদ্ধ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র শুধু জনগণই নয় বরং বুর্জোয়াদের উপরেও অনেক ধরনের দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে থাকে। কিছু কলকারখানা একেবারে রাষ্ট্রীয়করণ করে ফেলা হয় অস্ত্র তৈরী করার জন্য এবং যুদ্ধকালীন উদ্বৃত্ত সম্পদ তৈরীর জন্য। অনেক বুর্জোয়াদেরকে অফিসার করে যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়। বিজ্ঞানীরা দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে চলে নতুন অস্ত্র আবিষ্কারের জন্য। অসংখ্য বুদ্ধিজীবী এবং শিল্পী-সাহিত্যিকরা নেমে পড়ে জাতীয় প্রপাগান্ডা ছড়ানোর দায়িত্বে ইত্যাদি।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2020/04/corona_and_the_human_achievements__mohammad_sabaaneh.jpeg)
শিল্পী: মোহাম্মদ সাবানেহ
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট
এরকম মহামারীর মুখে রাষ্ট্রের পক্ষে নিজের ভোল পাল্টে ফেলা খুবই স্বাভাবিক। যেকারণে আমরা বর্তমানে দেখতে পাচ্ছি উৎপাদনব্যবস্থা, কলকারখানা ইত্যাদি প্রায় বন্ধ হবার উপক্রমের পরেও ম্যাকরন কিংবা প্রধানমন্ত্রী এডুয়ার্ড ফিলিপ্পে ঘোষণা দিচ্ছে কল্যাণ-রাষ্ট্রীয় নীতিমালা গ্রহণের। শ্রমিকদেরকে কাজে যাওয়ার জন্য বিবিধ সুবিধা দেয়া হবে, যেসব ব্যক্তিমালিকানার দোকানগুলো বন্ধ হয়ে গেছে তাদেরকে আলাদা টাকাপয়সা দেয়া হবে, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ১০০ বা ২০০ বিলিয়ন টাকা প্রণোদনা দেয়া হবে, এবং এমনকি আরও অনেক সেক্টরে রাষ্ট্রীয়করণ নীতি গ্রহণ করা হবে। এসব কোনো কিছুই আসলে তেমন আপাতবিরোধী বা বিস্ময়কর কোনো ঘটনা না। ম্যাকরনের ভাষণে ‘আমরা এখন যুদ্ধের মধ্যে আছি’ এরকম উপমা ব্যবহার করা পুরোপুরি যথার্থ। যুদ্ধ হোক কিংবা মহামারী, এমন অনেক পরিস্থিতিই রয়েছে যেখানে রাষ্ট্র তার স্বাভাবিক শ্রেণীচরিত্রকে এড়িয়ে গিয়ে একদম ভিন্ন ধরনের পলিসি গ্রহণ করে, যা একই সাথে কর্তৃত্ববাদী আচরণ এবং কৌশলগত বিপর্যয় থেকে বাঁচার উপায় মাত্র।
বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা যথাসম্ভব নিশ্চয়তার সাথেই জারি রেখে যুদ্ধ জেতার (আবারও ম্যাকরনের উপমা ব্যবহার করলাম) ব্যাপারটি, অর্থাৎ এখন মহামারী ঠেকানোর ব্যাপারটি একেবারেই স্বাভাবিক, এখানে জটিল কোনো সমীকরণ নেই আসলে। এটা কোনও হাসিঠাট্টার বিষয় না, এটা একটা প্রয়োজনীয়তা যা প্রকৃতি (যেকারণে এখানে বিজ্ঞানীদের একটা বড় ভূমিকা আছে) এবং সমাজ (যেকারণে এর সাথে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের জবরদস্তি চলে আসে)-এর মিথস্ক্রিয়া ও ব্যাপ্তি প্রক্রিয়ার ফলে ডেকে আনা প্রাণঘাতী পরিস্থিতিকে নির্দেশ করে।
তবে এতসব প্রচেষ্টার মধ্যেও কিছু ঘাপলা থেকে যায় অনিবার্যভাবেই। যেমন নিরাপত্তা মাস্কের সংকট অথবা হসপিটালগুলোতে আইসোলেশনের ব্যবস্থার অভাব। তবে এমন পরিস্থিতি হবে সেটা আগে থেকে কেইবা ‘হিসাব করেছে’? নিদির্ষ্ট কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় তেমন কোনও পদক্ষেপ নেয়নি এটা সত্যি। দশকের পর দশক ধরে জাতীয় চিকিৎসাব্যবস্থার দুর্বল ব্যবস্থাপনা এবং চিকিৎসাখাতে টাকা না খাটিয়ে অন্যখাতে খাটানো যা সাধারণ জনগণের স্বার্থের বিপরীত, একটা রাষ্ট্র মহামারীর সংক্রমণে মুখথুবড়ে পড়ার পিছনে এই কারণগুলোও রয়েছে অবশ্যই। এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অবস্থান নিন্দনীয়, কিন্তু সেটা শুধু ম্যাকরনের সরকার নয়, বরং গত ত্রিশ বছরে যারাই রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছে, তাদের সবারই দোষ।
তবে এখানে একটা বিষয় অবশ্যই লক্ষনীয় যে, অল্প কয়েকজন বিজ্ঞানী ছাড়া কেউ কস্মিনকালেও ভাবেনি ফ্রান্সে এমন ধরনের কোনো মহামারী হতে পারে। বেশিরভাগই হয়ত এটা ভেবে বসে ছিল যে, এই ধরনের মহামারী গজব অন্ধকারাচ্ছন্ন আফ্রিকা কিংবা কর্তৃত্ববাদী চীনের জন্য, গণতান্ত্রিক ইউরোপে এমন গজব আসবে না। বামপন্থী-হলুদ জ্যাকেট আন্দোলনকারীরা অথবা ট্রেড-ইউনিয়নবাদী যারা সবসময় ম্যাকরনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ব্যস্ত, তারাও এইরকম দশা হবে সেটা একবারও ভাবতে পারেনি। অন্যদিকে, মহামারী ততক্ষনে চীন থেকে রওনা দিয়েছে সারাবিশ্বের উদ্দেশ্যে, ভ্রমণের পথে সে তার সংখ্যা বাড়িয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ম্যাকরনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হোক বা যথেষ্ট ব্যবস্থা না নেয়ার অভাবে যত অভিযোগ সমাবেশই হোক, এরপরেও এই সত্য স্বীকার করতে হবে যে, ফ্রান্সের অন্য কোনও রাজনৈতিক পক্ষই এই মহামারীর সংক্রমণ সংক্রান্ত কোনো আন্দাজ করতে পারেনি।বরং ম্যাকরোনীয় রাষ্ট্রই প্রথম এই মহামারী সংক্রমণের পরিমাণকে আমলে আনে।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2020/03/our_leader___ali_rastroo.jpeg)
শিল্পী: আলি রাস্ত্রু
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট
এই অবস্থার পাশাপাশি, বুর্জোয়া রাষ্ট্র এখন এমন এক পরিস্থিতিতে পড়েছে যেখানে তাকে শুধু আর বুর্জোয়াশ্রেণীর স্বার্থের কথা ভাবলেই হচ্ছে না, বরং সাধারণ মানুষের স্বার্থের কথাও ভাবতে হচ্ছে ঘোষনা দিয়ে, এবং সেটা মূলত ভবিষ্যতে বুর্জোয়া রাষ্ট্র ও বুর্জোয়া স্বার্থ টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনেই। অর্থাৎ যেই শ্রেণীর স্বার্থ বুর্জোয়া রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখতে কাজ করে, এই সংকটকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেটি বাদ দিয়ে এখন সাধারণ স্বার্থের কথাও ভাবতে হচ্ছে তার অভ্যন্তরীন স্বভাবগত শত্রুকে মোকাবিলার জন্য—যুদ্ধের সময় যে ভূমিকায় থাকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ, বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা সার্স-২।
এই ধরনের পরিস্থিতি (বিশ্বযুদ্ধ অথবা বৈশ্বিক মহামারী) রাজনৈতিক পর্যায়ে সাধারণত একেবারেই অসাড় ভূমিকা পালন করে থাকে। অতীতের বিশ্বযুদ্ধগুলোর ফলে মাত্র দুইটি জায়গাতেই বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল, তাও এমন দুইটি স্থান যেখানে তৎকালীন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তেমন শক্তিশালী ছিলোনা। আমি চীন ও রাশিয়ার কথা বলছি। রাশিয়ার ক্ষেত্রে বলা যায়, জারের ক্ষমতা সবদিক থেকেই অনেকদিন ধরে পতনশীল ছিল যার মধ্যে ধীরে ধীরে পুঁজিবাদের ভ্রুণ জন্মাচ্ছিল। অন্যদিকে এর বিপরীতে ছিলো বলিষ্ঠ বলশেভিকরা, অসাধারণ নেতাদের হাতে তৈরী একটি আধুনিক রাজনৈতিক ভ্যানগার্ড পার্টি। চীনের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ বিপ্লবী যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবকে অতিক্রম করে গিয়েছিল, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৪০ সালে ইতোমধ্যে একটি পরীক্ষিত জনপ্রিয় সেনাবাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। বিপরীত দিকে আমরা দেখতে পাই কোনো পশ্চিমা রাষ্ট্রেই জয়লাভকারী কোনও বিপ্লব ঘটেনি। ১৯১৮ সালে জার্মানি পরাজিত হয়ে দুর্বল শক্তি হওয়া সত্ত্বেও সেখানে বিপ্লবের চেষ্টাকে দুমড়ে ফেলা হয়।
উপরের উদাহরণগুলো দিয়ে আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি সেটা খুবই পরিষ্কার, চলমান মহামারীর ফলে আসলে ফ্রান্সের মত দেশে কোনো উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। এমনকি এসব বালখিল্য প্রতিবাদ কিংবা ফিল্মি স্লোগানের উত্তেজনায় যদি বুর্জোয়ারা এটা বিশ্বাসও করে বসে যে ম্যাকরনের পতন অনিবার্য, তাতেও বিশেষ কোনো পরিবর্তন হবে না সামনে। ম্যাকরনের পতনে কিছু হবে না, কারণ ইতোমধ্যে অন্যান্য অনেক ‘সুশীল’ (Politically Correct) রাজনৈতিক প্রার্থীরা তাদের ঝোলার ভেতর অধুনালুপ্ত বিরক্তিকর সূক্ষ্ম জাতীয়তাবাদের বিষ নিয়ে অপেক্ষা করছে জনগণকে গেলানোর জন্য।
যারা আমাদের মত আসলেই বাস্তব কোনো পরিবর্তন চান এই দেশের রাজনৈতিক অবস্থার, তাদের অবশ্যই এই মহামারী সময়ের সুবিধা নেয়া উচিৎ, এমনকি তা যদি পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন (isolation) অবস্থায় থেকেই হয় তবে তা-ই সই। রাজনীতির নতুন কাঠামো’র কথা আমাদের ভাবা উচিৎ এবং এর নতুন দিকগুলো নিয়ে কাজ করা উচিত। তাই এ সময়ে কোনও বাস্তব পরিবর্তন চাইলে, আন্তঃরাষ্ট্রীয় আন্তর্জাতিক কম্যুনিজমের তৃতীয় ধাপের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত, যার পূর্বসুরী গত শতাব্দীর গৌরবান্বিত আবিষ্কারঃ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কম্যুনিজম পরীক্ষণ।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2020/04/first_responders___khalid_albaih-Copy.jpeg)
শিল্পী: খালিদ আলবাহ
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট
মহামারীর মতো ধারণা নতুন কোনো রাজনৈতিক আবিষ্কারের দিকে আমাদেরকে ধাবিত করতে পারে, এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে গেলেও আমাদেরকে অনেক কঠোর সমালোচনার জবাব প্রস্তুত রাখতে হবে। সব থেকে বড় কথা হচ্ছে মহামারী সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক তথ্যাবলি প্রকাশিত হলে, হাস্পাতাল, গণস্বাস্থ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সাম্যবাদী শিক্ষা, প্রবীণদের দেখাশুনা করা এবং এই ধরনের আরও অনেক প্রশ্নের ক্ষেত্রে নতুন রাজনৈতিক দিগন্ত ও অভিযোগের ব্যাপারগুলো সামনে আসবে। এই বিষয়গুলোকে স্পষ্টভাবে বুঝতে হলে আমাদেরকে এসব ক্ষেত্রে ভয়ংকর দুর্বলতাসমূহও বুঝতে হবে যেগুলো বর্তমান মহামারী পরিস্থিতির কারণে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
এছাড়াও এই বিষয়গুলোকে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে তথাকথিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা প্রতিনিয়ত যেসব প্রপাগান্ডা এবং গণ-মানসের অসাড়তা দেখতে পাচ্ছি যা শুধু বিলিয়নিয়ারদের পকেট ভড়তে সাহায্য করে এবং এক ধরনের ফ্যাসিবাদী ধোঁয়া তৈরী করে পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তোলে, সেগুলোর মুখোমুখি হতে হবে সহী জবাব নিয়ে।
আমরা যেন বৈজ্ঞানিক সত্য এবং নতুন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি যা স্থানিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তার কৌশলগত লক্ষ্যকে গড়ে তোলে, তা বাদ দিয়ে অন্য কোনও ভ্রান্ত বিশ্বাসে মেতে না উঠি, বিশেষ করে আমাদের এই বিচ্ছিন্ন অবস্থার মধ্যে।