অরাজ
আমার ভেতরে এমন কোন চিন্তার কখনোই জন্ম হয় না যেখানে ‘মৃত্যু’ খোদাই করা নেই... ভ্যাটিকানের সিস্টিন চ্যাপেলে মিকেলেঞ্জেলোর আঁকা ‘লা ক্রিয়েজিওন’ (ইতালীয় ভাষায় ‘সৃষ্টি’)। ছবি: প্লিনিও লেপ্রি/এপি)।
প্রচ্ছদ » হিশাম মাতার।। কিভাবে কালো মৃত্যু চিরদিনের মত শিল্পকলাকে বদলে দিয়েছে?

হিশাম মাতার।। কিভাবে কালো মৃত্যু চিরদিনের মত শিল্পকলাকে বদলে দিয়েছে?

অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী

হিশাম মাতারের জন্ম ১৯৭০ সালে আমেরিকায়। তিনি এক বৃটিশ-লিবীয় লেখক। নিখোঁজ বাবাকে খোঁজার স্মৃতি নিয়ে লেখা তাঁর বই দ্য রিটার্ন ২০১৭ সালে আত্মজীবনী শাখায় পুলিৎজার পুরষ্কার এবং একই বছরে পেন আমেরিকা জাঁ স্টেইন বুক অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে। তাঁর সূচনা উপন্যাস ইন দ্য কান্ট্রি অফ মেন ২০০৬ সালে ম্যান বুকার প্রাইজ অর্জনের জন্য মনোনীত হয়। মাতারের নানা প্রবন্ধ আশারক আল-আওসাত, দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট, দ্য গার্ডিয়ান, দ্য টাইমস এবং দ্য নিউইয়র্ক টাইমসেও প্রকাশিত হয়। তাঁর দ্বিতীয় উপন্য্যাস অ্যানাটমি অফ আ ডিসএ্যাপিয়রেন্স  ২০১১ সালের ৩রা মার্চ প্রকাশিত হয়। তিনি লন্ডনে বাস করেন ও সেখানে থেকেই লেখালিখি করেন। বর্তমানে তিনি রয়্যাল সোসাইটি অফ লিটারেচারের ফেলো ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্নার্ড কলেজের ইংরেজি এবং তুলনামূলক সাহিত্যের এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।

হিশাম মাতারের সিয়েনায় এক মাস প্রকাশ করেছে ভাইকিং। সিনেমা, নৃত্য, চিত্রকলা, ইনস্টলেশন, থিয়েটার, কবিতা ও সেমিনার বিষয়ক করোনেট থিয়েটারের ‘ইনসাইড আউট সিরিজ: মুক্ত অনলাইন উপস্থাপনা’য় হিশাম অংশ নিচ্ছেন।

প্লেগ বা মড়কের পর, মৃত্যু হয়ে উঠেছিল রেনেসাঁ যুগের চিত্রকরদের এক নি:শব্দ সঙ্গী। হিশাম মাতার সিয়েনায় একটি মাসের কথা স্মরণ করেছেন প্রেম, ক্ষতি, মরণশীলতা ও শিল্পকলা বিষয়ে জানাচ্ছেন তাঁর নানা ভাবনার কথাও।

 

হিশাম মাতারের ‘সিয়েনায় এক মাস’

মূল লেখা

২০১৬ সালে আমি যখন ‘দ্য রিটার্ন’ লেখা শেষ করেছি, দীর্ঘ ৩৩ বছর রাজনৈতিক কারণে লিবিয়ায় যেতে না পারা আমার লিবিয়ায় ফেরা ও গাদ্দাফির একনায়কত্বের সময়ে আমার রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী বাবার প্রথমে কারারুদ্ধ ও পরে চিরতরে নিখোঁজ হওয়া সেই বাবাকে খুঁজে ফেরার ব্যর্থ প্রচেষ্টার কাহিনী লেখার পরে আমি সিয়েনা গেলাম। একটা মাস আমি সেই তুস্কানী শহরে সিয়েনিজ স্কুলের যাবতীয় চিত্রকলা দেখে কাটালাম। মূলত: ত্রয়োদশ, চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকের যত চিত্রকলা। লন্ডনের জাতীয় গ্যালারিতে প্রথম দেখার পর থেকে ইতিহাসের এই বিশেষ সময়ের চিত্রকলা বরাবরই আমার মনোযোগ কেড়েছে। সে আজ থেকে প্রায় বছর পঁচিশেক আগের কথা, আমার বয়স তখন ১৯, যে বছর কিনা আমার বাবা অপহরণ বা গুম হয়েছিলেন। লন্ডনের গ্যালারিতে এই যুগের চিত্রকলার প্রাপ্তিযোগ্যতা ও ছবিগুলোর অন্তর্নিহিত শক্তি আমাকে টেনেছিল। সিয়েনায় কাটানো এক মাসের এই সময়টুকু আমাকে পৃথিবীতে ভালবাসা ও বিচ্ছেদ, মৃত্যু ও শিল্পকলার ভেতরকার সম্পর্ক বুঝতে সহায়তা করেছে।

সিয়েনিজ স্কুল যা কিনা ইউরোপে চার্চের প্রভাব কমে আসা ও রেনেসাঁ বা পুনরুজ্জীবনের মধ্যবর্তী সময়ের সৃষ্টি, ১৩৪৮ সালের মহামারী বা কালো মৃত্যু দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। সেবারের সেই প্লেগ বা মড়ক মানবেতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক বা বিধ্বংসী ঘটনা হিসেবে দেখা দেয়। এটা শুধুই মানব সমাজকে বদলায়নি, বরং বদলেছে খোদ আমাদের কল্পনাশক্তিকেও।

এই যুগের চিহ্নগুলো আজো খুঁজে পাওয়া যায়, এবং সম্ভবত: আজকের এই কঠিন দিনগুলোয় আরো সহজবোধ্যভাবেই আমরা তাদের চিনে নিতে পারব। চতুর্দশ শতকের সিয়েনিজরা হালের আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়াই অবিশ্বাস্য অনেক কাজ করতে সক্ষম হয়েছিল যা আজকের করোনা ভাইরাস সঙ্কটের শুরুর দিনগুলোয় আমরা পারছি না। কালো মৃত্যুর গতি তখন এত প্রবল ছিল যে এক বছরের ভেতরে গোটা মধ্যযুগের পৃথিবী গ্রাস করে নেয় এই মড়ক। প্রতিটি দেশের জনসংখ্যা গড়ে ৪৫% শতাংশ কমে যায়। সিয়েনিজ শিল্পীদের কাছে (যারা কিনা নিজেদের ভেতরে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক অথচ একে অপরের প্রতি সহায়তা দানে অকুণ্ঠ ও ফলপ্রসূ এক শিক্ষানবিশী অবকাঠামো গড়ে তুলেছিলেন তরুণ চিত্রশিল্পীদের জন্য) এই কালো মড়ক ছিল বহু দূরের কোন আখ্যান এবং কালো মড়কের প্রতিবেদনগুলো এতই বন্য ও অদ্ভুত ছিল শুনতে যে এগুলো তাঁদের পক্ষে বিশ্বাস করাও ছিল কঠিন। কিন্তু অবশেষে যখন তাঁরা শুনলেন যে খোদ সিসিলি শহরে ঢুকে পড়েছে এই কালো মৃত্যু, তখন তারা বুঝলেন যে সহজে এই মড়ক থেকে রেহাই নেই।  ভীতি এবং হিস্টেরিয়া গ্রাস করলো গোটা সিয়েনাকে। কিছু মানুষ পালিয়ে গেল গ্রামে, অন্যরা শহরেই নিজেদের নিরাপদ ভেবে শহরে প্রবেশের দরজাগুলোর কোন কোনটা দিয়ে তাড়াহুড়ো করে ভেতরে ঢুকে পড়লো। মিকেলেঞ্জেলো, রেমব্রান্ডন্ট ও ভের্নিয়ের সবাই কালো মৃত্যুর ভয়ে ভীত হলেন। রোগের দুশ্চিন্তাতেই টিটিয়ান মারা গেলেন।

ইতালি একটি জাতি বা রাষ্ট্র হয়ে ওঠার আগে এটি ছিল বেশ কিছু নগর-রাষ্ট্রের সমাহার যাকে শাসন করত একটা ‘অতোরিতা সুপেরিয়র (উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ)।’ সাধারণত: কোন অভিজাত পরিবার বা কোন বিশপই এই উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের রূপ পরিগ্রহ করতেন।  সিয়েনা ছিল এক ব্যতিক্রম যেহেতু এই নগরের অধিবাসীরা পৌর শাসন পছন্দ করতেন। আর অংশত: একারণেই এ শহরের চিত্রকলার ছিল এক স্বতন্ত্র চারিত্র্য। আম্ব্রোগিয়ো লোরেঞ্জেত্তির ‘ভাল ও মন্দ সরকারের রূপক (দ্য অ্যালেগরি অফ দ্য গুড অ্যান্ড ব্যাড গভর্নমেন্ট)’ শীর্ষক ফ্রেস্কো সিরিজ অঙ্কিত হয়েছিল নগরীর কেন্দ্রবিন্দু প্যালাজ্জো পাব্লিকো-য়। এটা প্রাচীনতম ও ইহজাগতিক ধারার সবচেয়ে প্রভাবশালী চিত্রকলাসমূহের অন্যতম। পৌর শাসন যদি হয়ে থাকে গির্জার সমতূল্য, তবে এই ফ্রেস্কো সিরিজ যেন ছিল গির্জার পেছনের দেয়ালে আঁকা ছবির মত কিছু।  সিয়েনা তার শিল্পীদের আর একটি বিরল ও মানবীয় কৌতূহলেও জারিত করতে পেরেছিল যে এমনকি ধর্মীয় দৃশ্যাবলী আঁকার সময়েও এই শিল্পীরা মানব মনস্তত্ব ও মানবীয় ভাবনার গতি-প্রকৃতি বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতেন।

‘দ্য অ্যালেগরি অফ দ্য গুড অ্যান্ড ব্যাড গভর্নমেন্ট, ফটোগ্রাফ: হেরিটেজ ইমেজ পার্টনারশীপ লিমিটেড

তবে সিয়েনীজ শিল্পীদের এই ইহজাগতিক বা ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী বদলে যায় কালো মৃৃত্যুর আবির্ভাবের সাথে সাথেই। সিয়েনীজরাও তাদের সমসাময়িক আরো যত মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় খ্রিষ্টানদের মতই দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করত যে সব ব্যধিই ঈশ্বরের কাছ থেকে আসে। কাজেই কালো মৃত্যু বা প্লেগ তাঁদের কাছে নিজেদের কৃত নানা পাপের প্রমাণ হিসেবে দেখা দিল। চোদ্দ শতকের মধ্যযুগীয় ইংরেজ বিবরণধর্মী কবিতা ‘পিয়ের্স প্লাউম্যান’-এ উইলিয়াম ল্যাংল্যান্ড সংক্ষেপে বলছেন, ‘নিরেট পাপ থেকে দেখা দিয়েছে যত মড়ক ও মহামারী।’ আর এক তুস্কানী কবি পের্ট্রাক মড়কে পরিত্যক্ত যত মৃত দেহ দেখে লিখছেন, ‘হে অনাগত দিনের সুখী মানুষেরা, তোমরা যারা এই দূর্দশা ও দূর্ঘটনা দ্যাখো নি, তাদের কাছে আমাদের এই সাক্ষ্য উপকথার গল্পের মত মনে হবে। আসলে আমাদের হয়তো এই শাস্তি প্রাপ্য অথবা আরো কঠিনতর কিছুও পাওনা থাকতে পারে।’

চার্চ বা গির্জাও এমন অলৌকিক নানা ব্যাখ্যাকে অনুপ্রেরণা যোগাতো।  অনেক যাজকই মড়কে সংক্রমিত রোগীদের এই যুক্তিতে আশীর্ব্বাদ জানাতে চাইত না যে হয়তো দ্বারা ঈশ্বরের দণ্ডপ্রাপ্ত। অধিকাংশ ধর্মবিশ্বাসী মানুষই সারাদিন প্রার্থনা ও নানা প্রায়শ্চিত্তমূলক কাজে সময় ব্যয় করতেন, দিন কাটাতেন গির্জা মেরামত করে এবং ধর্মীয় নানা প্রতিষ্ঠান স্থাপনার কাজ করে। পোপের শাসন আরো পোক্ত হয়ে উঠলো। মানুষের ধ্যান-ধারণা এবং মূল্যবোধের খাতে এক বড় পরিবর্তন দেখা দিল।

১৩৪৮ সালের এই কালো মড়ক এবং তার কিছু পুনরাবৃত্তিমূলক ঘটনা মৃত্যু ও মরে যাওয়া সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী বদলে দেয়, বদলে দেয় চারপাশের পৃথিবী ও জীবন সম্পর্কে আমাদের ভাবনা-চিন্তাও। তিউনিসীয় ইতিহাসবিদ ও ইতিহাস-রচয়িতা ইবন খালদুন যাকে কিনা হালে সমাজতত্ত্বের পুরোধা বা পথপ্রদর্শক হিসেবে স্বীকার করা হচ্ছে, এই কালো মৃত্যু বা মড়কেই তাঁর পিতা-মাতাকে হারান। তাঁর কাছে এই মড়কের যেমন ছিল অসীম বৈশ্বিক গুরুত্ব, তেমন ছিল ব্যক্তিগত ক্ষতির দিক। বাবা-মা’কে হারিয়ে তিনি এই বোধে আসেন যে কালো মৃত্যু আসলে মানব সভ্যতার গভীর দূর্বলতাকেই তুলে ধরছে। তিনি ছিলেন ডারউইনের আগের এক ডারউইনবাদী বা প্রাক-বিবর্তনবাদী সময়ের এক বিবর্তনবাদী। কাজেই বেদনার এই সময়েরও ভাল বা সুযোগের দিকগুলো তিনি দেখতে চাইলেন। তিনি লিখলেন যে কালো মৃত্যু যেন জীবনকে দেখাচ্ছে, ‘তার আদি রূপে এবং পুন:পুন সৃজনের সম্ভাবনায়, অস্তিত্বের প্রবাহে এক নতুন পৃথিবীর উন্মেষ।’ বাস্তবিকই মড়ক এক দিকে যেমন ছিল ধ্বংসাত্মক তেমনি সৃষ্টিমূলক। এই কালো মৃত্যুর ছায়া থেকেই পাঁপড়ি মেললো রেনেসাঁ ও বারোক শিল্পকলা। মিকেলেঞ্জেলো, রেমব্রান্ডন্ট ও ভের্নিয়ের সবাই এই মড়কে পর্যায়ক্রমে আশঙ্কিত হয়েছেন। অনুমান করা হয় যে টিটিয়ান এই মড়কে মারা যান। এবং সেই থেকে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে অন্য শিল্পীদের ভেতরেও। তাঁদের চিন্তায় অমোচনীয় ছাপ রেখে যায় এই কালো মড়ক এবং মৃত্যু তাঁদের কাছে হয়ে ওঠে এক পরিচিত ও অলঙ্ঘ্যনীয় অতিথি, এক নিঃশব্দ সঙ্গী যে কিনা শেষ কথাটি বলবে। এটাই অপরিহার্য বাস্তবতা। সব কিছুর অন্তিমে এক চিরস্থায়ী বিনাশ ও সংহারের দিকেই শিল্পীদের কল্পনার ডানা পাখা মেললো। ‘আমার ভেতরে এমন কোন চিন্তার কখনোই জন্ম হয় না যেখানে ‘মৃত্যু’ খোদাই করা নেই,’ ভাসারিকে একটি চিঠিতে লিখলেন মিকেলেঞ্জেলো।

‘বোধ হয় আমি সিয়েনায় গেছি শুধুমাত্র এর চিত্রকলার বিপুল সম্ভারকে দেখতে’: হিশাম মাতার, আলোকচিত্র: আনাদোলু এজেন্সি

কালো মৃত্যুর কারণে ধর্মীয় যে উত্তাপের সৃষ্টি হলো সেটা সিয়েনার শিল্পীদের ভেতর চার্চের প্রতি এক গভীর আনুগত্য সৃষ্টি করলো। মাত্র সাত বছর যেতে না যেতে, ১৩৫৫ সাল নাগাদ, সিয়েনায় পৌর শাসনের অবসান হলো এবং যাজকেরা বা চার্চ ক্ষমতায় এলেন।  তাঁদের হাতেই জমা হলো বিপুল ধন-সম্পদ ও ক্ষমতা। তাঁরাই ঠিক করে দিতে থাকলেন যে শিল্পীরা কি আঁকবেন। আম্ব্রিয়োগো লোরেঞ্জোত্তির ‘ভাল ও মন্দ সরকারের রূপক’-এর করিডোরের নিচ থেকেই এক নতুন চ্যাপেল বা খ্রিষ্টীয় ভজনালয়ের কাজ করাবেন বলে মনস্থ করলেন পাদ্রিরা। তাদ্দেও দি বার্তেলো নামের শিল্পীকে এই চ্যাপেলের দেয়ালগুলো অলঙ্করণের কাজ দেয়া হলো। সিয়েনিজ ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পাশাপাশি নতুন পৃষ্ঠপোষক বা শাসকশ্রেণি তথা চার্চের পাদ্রিদের রুচি অনুযায়ী কাজের দায়ও তাঁর কাঁধে চাপলো বৈকি। বার্তেলোর কাজে কুমারীর মৃত্যু এবং চারপাশের সবকিছু ধ্বংস হয়ে আসা সংক্রান্ত চিত্রাবলী এক নতুন রীতির স্বাক্ষর যা এর আগে সিয়েনিজ চিত্রকলার কেন্দ্রীয় ভাবনা ছিল না। ‘কুমারীর শেষকৃত্য (দ্য ফিউনারেল অফ দ্য ভার্জিন)’-এ দৃষ্টিপাত করলে কালো মড়কের সময়ে সিয়েনার ফুটপাথে স্তুপ হয়ে থাকা শবদেহের কথা মনে না এসে পারবে না। কবর দেবার জায়গাও ছিল না। খ্রিষ্টের প্রত্যেক বার্তাবাহকই কুমারী মা’কে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন আর পথের মানুষদের সবাইকেই মনে হচ্ছে চূড়ান্ত নিঃসঙ্গ, যেন তাঁরা প্রত্যেকেই মৃত্যুর চিন্তায় আচ্ছন্ন। গোটা চ্যাপেলটিই যেন অনুশোচনা ও অতিরেকে পূর্ণ স্ববিরোধী আয়োজনের এক অত্যাশ্চর্য উপস্থাপনা। প্রতিটি পরিসর- মেঝের প্রতি সেন্টিমিটার, দেয়াল এবং সিলিংয়ের পরিসর সুসজ্জিত। এ যেন এক উদ্বিগ্ন পরিসর। এর জমকালো নিশ্চয়তা ও স্থির দৃঢ়তার সাথে চ্যাপেলটি সক্ষম হয়েছে একই সাথে পাদ্রিদের খুশি করতে আবার বিশ্বাস নিয়ে মানুষের মনোজগতের দ্বন্দ্বকে উপস্থাপন করতে: বিশ্বাস, যে কোন ধরনের বিশ্বাস, এবং আপাত: দৃষ্টে যত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বিশ্বাসই মনে হোক, মূলত: সংশয়ের এক ভূমিও বটে। যেন বা বার্তোলো ফ্লোরেন্সীয় কবি ও পের্ট্রাকের বন্ধু বোক্কাচ্চিওর সেই দুষ্টু বাক্যটিই আওড়াচ্ছে, ‘একটি শোভন বিষয় হলো… আমরা যা কিছু করি, তা’ যেন একইসাথে সেই পবিত্র ও ভয়ানক নামে শুরু হয় যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন।’ এই তিক্ত বিদ্রুপাত্মক বিদ্রোহও যেন এই চ্যাপেলে উপস্থিত, যদিও খুব সূক্ষ ভাবে। যেন বা আদৌ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতও নয় অথচ বিশ্বাসের ইতিবাচক মহিমার দু’ধার বিশিষ্ট ছুরির মাধ্যমে শিল্পী তাঁর সংশয়ও প্রকাশ করেছেন।

তাদ্দেও দি বার্তেলো-ওর আঁকা ‘দ্য ফিউনারেল অফ দ্য ভার্জিন’ নামে একটি ছবির দৃশ্য। আলোকচিত্র: দ্য পিকচার আর্ট কালেকশন।

প্রথমে আমি ভেবেছিলাম যে আমি সিয়েনা গেছি শুধু এর চিত্রকলা দেখতে। পরে বুঝলাম যে আমি আসলে গেছিলাম শোক করতে, নতুন ভূখণ্ড দেখতে এবং নিজের কাছে পরিষ্কার হতে যে কিভাবে আমি এখান থেকে আবার আমার কাজ শুরু করব।  সিয়েনায় এক মাস লিখতে গিয়ে আমার এসব কিছুই মনে করতে হয়েছে এবং ভেবেছি যে মৃত্যু কিভাবেই না সবকিছু বদলে দেয়। আর এরপরই মড়কে আক্রান্ত আমাদের বর্তমান সময়ের নিজস্ব পৃথিবীকে খুঁজে পাওয়াও কেমন ভুতুড়ে মনে হয়। এবং এসবকিছু নিয়ে ভাবতে গিয়েই আমার বিশ শতকের ইতালীয় কবি ও ঔপন্যাসিক সিজার পাভেসের বক্তব্য ‘শিল্প হলো জীবনের সব আক্রমণের বিরুদ্ধে এক সুরক্ষা’, এই আপ্তবাক্যটি মনে পড়ে গেলো। আমার আরো মনে পড়ে গেল যে যদিও এমন অনুজ্ঞা যথাযথ ভাবে পালন করতে চাওয়াটা খুবই উচ্চাভিলাষী তবু এ ত’ সত্য যে সত্যিকারের শিল্প সবসময়ই একইসাথে একটি লক্ষণ ও প্রতিভাস বা উদ্ঘাটন। দুঃসময়ে আনন্দ ও নিরাময় দানের পাশাপাশি বর্তমানকে বিবেচনা ও সেখানে স্থান খুঁজে পাওয়ার কাজেই এটি এক আশ্চর্য হাতিয়ার।

অদিতি ফাল্গুনী

অদিতি ফাল্গুনী লেখক, অনুবাদক ও গবেষক। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। কাজ করেছেন ও করছেন একাধিক সংবাদপত্র, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায়। জন্ম : ১৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪। প্রবন্ধ-গবেষণা-গল্প-কবিতা-অনুবাদসহ প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩০ । তাঁর উল্লেখযোগ বইগুলো হচ্ছে: ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে, অপৌরুষের ১৯৭১, ধৃতরাষ্ট্রের বালিকারা, ইমানুয়েলের গৃহপ্রবেশ, চিহ্ণিত বারুদ বিনিময়, প্রবাল দ্বীপে টিয়া টিটো, নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও বিবিধ প্রসঙ্গ, চেরনোবিলের কণ্ঠস্বর : একটি পারমানবিক দুর্ঘটনার কথ্য ইতিহাস ইত্যাদি। যোগাযোগ : audity.falguni@gmail.com