অরাজ
আর্টওয়ার্ক: ইউনিটি শিল্পী: মেনেক্সি কাম সূত্র: পলআর্ট
প্রচ্ছদ » স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ: নৈরাজ্যবাদ প্রসঙ্গে হাওয়ার্ড জিন  

স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ: নৈরাজ্যবাদ প্রসঙ্গে হাওয়ার্ড জিন  

অনুবাদ: সহুল আহমদ

অনুবাদকের ভূমিকা

হাওয়ার্ড জিন প্রখ্যাত আমেরিকান ইতিহাসবিদ, চিন্তক ও বুদ্ধিজীবী। প্রায় বিশের অধিক বই-পুস্তক লিখেছেন, পাশাপাশি নাগরিক অধিকার আন্দোলন, যুদ্ধ-বিরোধী আন্দোলন এবং যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক ইতিহাস নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করেছেন, সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, আলাপ-আলোচনা করেছেন। তাঁর বিখ্যাত ও প্রভাবশালী A People’s History of the United States গ্রন্থ সম্পর্কে প্রায় সকলেই জানেন, সিনেমা থেকে শুরু করে বিদ্বৎসমাজ সবখানেই এই গ্রন্থ বহুরূপে উল্লেখিত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন এয়ারফোর্সে যোগদান করেছিলেন, এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝে গিয়েছিলেন যে, যুদ্ধের দোহাই দিয়ে সাধারণ জনগণের ত্যাগ-তিতীক্ষাকে ব্যবহার করে গুটিকয়েক ফায়দা হাসিল করেন। আজীবন বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধ-বিরোধী আন্দোলন ও নাগরিক অধিকার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে গিয়েছেন।

হাওয়ার্ড জিন এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল Counter Punch এ ২০০৮, ১২ মে। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন জিগা ভদোভনিক।  তিনি স্লোভেনিয়ার University of Ljubljana এর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক; কাজ করেন আমেরিকার সামাজিক আন্দোলন, নৈরাজ্যবাদী তত্ত্ব ও সমসাময়িক রাজনৈতিক তত্ত্ব নিয়ে।

জিগা ভদোভনিকের সাথে কথোপকথনে হাওয়ার্ড জিন নিজেকে অ্যানার্কিস্ট বা নৈরাজ্যবাদী হিসেবে অভিহিত করেই কথা বলা শুরু করেন। তারপর কথা বলেছেন নৈরাজ্যবাদী বিভিন্ন ধারণা, মানুষের স্বাধীনতা, সামাজিক আন্দোলনের গুরুত্ব, নির্বাচনী ও ভোটের রাজনীতি বনাম সামাজিক আন্দোলন, কর্তৃত্বপরায়ন আন্দোলন বনাম মুক্তিমুখীন আন্দোলন, নৈরাজ্যবাদের ইতিহাস, উপায় ও উদ্দেশ্য ইত্যাদি বিষয়ে।

বর্তমানে anarchism এর ভাষান্তর ‘নৈরাজ্যবাদ’ না করে অরাজ/ অরাজপন্থা ইত্যাদিও করা হয়, বা অনেকেই ‘অ্যানার্কিজম’ই রেখে দেন, কেননা প্রচলিত অর্থে ‘নৈরাজ্য’ শব্দ নেতিবাচক ভাবে ব্যবহৃত হয় (যেমন, বিশৃঙ্খলা)। এই সাক্ষৎকারে হাওয়ার্ড জিন অ্যানার্কি শব্দকে chaos বা বিশৃঙ্খলা অর্থে ব্যবহার করার রাজনীতি নিয়েও আলোচনা করেছেন। তাই, অ্যানার্কিজমের বাংলা রূপান্তর হিসেবে নৈরাজ্যবাদই রাখা হয়েছে।

হাওয়ার্ড জিন

১৯৮০ দশক থেকে আমরা দেখছি অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের প্রক্রিয়াটি দিনে দিনে শক্তিশালী হচ্ছে অনেক বামপন্থীরা এখন একটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে মধ্যে পড়ে গিয়েছেন: বিদেশি ও বৈশ্বিক পুঁজির নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক বাধা তৈরির লক্ষ্যে জাতিরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের হাতের শক্তি বাড়াতে কাজ করবেন, নাকি বিদ্যমান বিশ্বায়নের একধরনের অজাতীয় বিকল্পের দিকে ঝুঁকবেন, যা সমানভাবে বৈশ্বিক সম্পর্কে আপনার মতামত কি?

আমি একজন নৈরাজ্যবাদী, এবং নৈরাজ্যবাদী নীতি অনুসারে জাতিরাষ্ট্র সত্যিকারের মানবিক বিশ্বায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এক অর্থে বিশ্বায়নের দিকে এই আন্দোলন, যেখানে পুঁজিবাদীরা জাতিরাষ্ট্রের সীমানা ডিঙানোর চেষ্টা করছেন, সেখানে আন্দোলনের জন্য জাতীয় সীমানা উপেক্ষা করার একধরনের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে; যা বৈশ্বিক পুঁজির বিরুদ্ধে মানুষকে একত্রে নিয়ে আসতে পারে, বিশ্বায়নের প্রচলিত ধারণার বিপরীতে জনগণের বিশ্বায়ন সৃষ্টি করতে পারে। অন্য ভাবে বললে, বিশ্বায়নকে এমন ভাবে ব্যবহার করা (বিশ্বায়ন ধারণার সাথে কিন্তু কোনো ঝামেলা নেই) যেন, এটি জাতীয় সীমানা উপেক্ষা করবে এবং অবশ্যই দুনিয়ার মানুষ সম্পর্কে যে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়া হবে তাতে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।

পিয়েরে জোসেফ প্রুধোঁ একদা লিখেছিলেন, স্বাধীনতাই হলো জননী, হুকুমের সন্তান নয় জাতিরাষ্ট্রের পরে বা বাইরে জীবনকে আপনি কোন জায়গায় দেখেন?

জাতিরাষ্ট্রের বাইরে? (হাসি) আমি মনে করি, জাতিরাষ্ট্রের বাইরে যা আছে সেটা হচ্ছে জাতীয় সীমানা ব্যতীত এক জগত, কিন্তু সংগঠিত জনসাধারণ নিয়েই। কিন্তু জাতি হিসেবে সংগঠিত না হয়ে বরঞ্চ দল হিসেবে, সমষ্টি হিসেবে জনসাধারণ সংগঠিত হবে; জাতীয় বা এই ধরনের কোনো সীমানা ছাড়াই। কোনো ধরনেরই সীমানা, পাসপোর্ট, ভিসা থাকবে না। এসবের একটাও না। বিভিন্ন আকারের সমষ্টি যৌথ বা সমবেত কাজের উপর ভিত্তি করে একে অন্যের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করবে। আপনি স্বয়ংসম্পূর্ণ ছোট ছোট গোষ্ঠী খুঁজে পাবেন না, কারণ তাদের কাছে কাছে ভিন্ন ভিন্ন জিনিসপাতি থাকবে। এটা এমন কিছু যা নৈরাজ্যবাদী তত্ত্ব এখনো তৈরি করেনি, এবং হয়তোবা আগাম করা সম্ভবও না, কারণ চর্চার মাধ্যমেই একে কার্যে পরিণত করতে হবে।

পিয়েরে যোসেফ প্রুধোঁ

আপনি কি মনে করেন, প্রাতিষ্ঠানিক পার্টি রাজনীতির মাধ্যমে কোনো পরিবর্তন সাধন করা সম্ভব? নাকি অসহযোগ আন্দোলন, সমান্তরাল কাঠামো তৈরি, বিকল্প মিডিয়া প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির মতো বিকল্প মাধ্যমেই কেবল করতে হবে

আপনি যদি বিদ্যমান কাঠামোর মাধ্যমে কাজ করেন আপনি দূষিত হবেন। রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিবেশকে বিষাক্ত করে, এমনকি প্রগতিশীল সংগঠনগুলোকেও। আপনি দেখবেন আমেরিকাতেও, ‘বাম’ধারার লোকেরা নির্বাচনী প্রচারণায় ধরা পড়েছেন এবং কোন তৃতীয় শক্তিকে সমর্থন দেয়া যায় তা নিয়ে যুক্তি-তর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। এটা খুব ছোট একটা নমুনা যে, আপনি যদি নির্বাচনী রাজনীতির মাধ্যমে কাজ করতে শুরু করেন তাহলে আপনি আপনার আদর্শকে দূষিত করা শুরু করেছেন। সুতরাং আমি মনে করি, প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার, ভোট, নির্বাচনী রাজনীতির মাধ্যমে কাজ না করে, কর্মস্থলে, পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন ধরনের সামাজিক আন্দোলন ও সমষ্টি গড়ার চিন্তা করতে হবে, যেন এগুলোই শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব গ্রহণের মতো যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে: প্রথমত, কর্তৃত্ব তাদের সাথে যা করছে তা প্রতিরোধ করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠা এবং দ্বিতীয়ত প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠা।

একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি আপনি কি নির্বাচনে যান? ভোট দেন?

যাই, কখনো সখনো, সবসময় না। এটা নির্ভর করে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে কখনো কখনো এক প্রার্থীর বদলে আরেক প্রার্থীকে পাওয়া হয়তো জুতসই, যদিও আপনি মানেন এটাই সমাধান নয়। কখনো কখনো কম মন্দটিও তত কম মন্দ হয় না, তাই আপনি এটা উপেক্ষা করতে চান, এবং হয় আপনি ভোট দিবেন আর না হয় পার্টি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে আপনি তৃতীয় পার্টিকে ভোট দিবেন। কখনো কখনো দুই প্রার্থীর মধ্যকার পার্থক্যটা গুরুত্বপূর্ণ এবং যিনি একটু ভালো, একটু কম বিপজ্জনক তাকে দায়িত্ব দেয়ার চেষ্টাটাও বোধগম্য। কিন্তু কোনোভাবেই ভুলে যাওয়া যাবে না যে কে পদের দায়িত্ব নিচ্ছেন এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নয়, বরঞ্চ প্রশ্ন হচ্ছে আপনার কোন ধরনের সামাজিক আন্দোলন রয়েছে। কারণ আমরা ঐতিহাসিকভাবে দেখেছি, যদি আপনার কোনো শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন থাকে তাহলে পদের দায়িত্বে কে রয়েছেন সেটা অগুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। দায়িত্বে যেই থাকুক না কেন, রিপাবলিক বা ডেমোক্রেট যেই হোক না কেন, যদি আপনার শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন থাকে, তাহলে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিকে সমর্পণ করতেই হবে, কোনো না কোনোভাবে সামাজিক আন্দোলনের শক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেই হবে।

ষাটের দশকে আমরা এটি দেখেছি, রিচার্ড নিক্সন মোটেও কম শয়তান ছিলেন না, বরঞ্চ তিনি অধিকতর শয়তান ছিলেন। কিন্তু তার আমলেই অবশেষে যুদ্ধের অবসান ঘটেছিল, কারণ তাকে যুদ্ধ-বিরোধী আন্দোলনের শক্তি মোকাবিলার পাশাপাশি ভিয়েতনামি আন্দোলনের শক্তিকেও মোকাবিলা করতে হয়েছিল। আমি ভোট দেব, কিন্তু সর্বদা এই সতর্কতার সাথে যে ভোটদান চূড়ান্ত নয়, এবং সংগঠিত করাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

যখন কেউ ভোটদানের বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে, তারা জিজ্ঞেস করে আপনি কোন প্রার্থীকে সমর্থন দিবেন? একে নাকি ওকে? আমি বলি: ‘আমি যখন বুথে ভোট দেব কেবল তখনই মাত্র এক মিনিটের জন্য কোনো এক প্রার্থীকে সমর্থন করব, কেবল সেই মুহূর্তে আমি ক বনাম খ-কে সমর্থন দেব। কিন্তু ভোটিং বুথে যাওয়ার পূর্বে এবং বুথ থেকে বের হওয়ার পরও আমি আসলে মনোযোগ দেব মানুষকে সংগঠিত করার দিকে এবং কোনো নির্বাচনী প্রচারণা সংগঠনের দিকে নয়।

অ্যানার্কিস্ট পোস্টার

এই ক্ষেত্রে নৈরাজ্যবাদ যথাযথভাবেই প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের বিরোধিতা করছে, কারণ এটাও একধরনের স্বৈরশাসনের রূপ—সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরশাসন তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটের এই ধারণাতে আপত্তি জানান, সংখ্যাগরিষ্ঠের মত সবসময় নৈতিকভাবে সহি মতের সাথে মিলে না থোরিও একদা বলেছিলেন, বিবেকের হুকুমে কাজ করার প্রতি আমাদের একধরনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে, এমনকি সেটা যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের মত বা সমাজের আইনকানুনের বিরুদ্ধেও যায় আপনি কি এর সাথে একমত?

একদম। রুশো একবার বলেছিলেন, যদি আমি একশ জনের দলে একাও হয়ে থাকি, বাকি ৯৯ জন কি কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠতার অজুহাতে আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার অধিকার রাখে? না। সংখ্যাগরিষ্ঠরাও ভুল করতে পারেন, তারা সংখ্যালঘুদের অধিকার খর্ব করতে পারেন। যদি সংখ্যাগুরুরাই শাসন করতো তবে এখনো দাসপ্রথা বহাল থাকত। জনসংখ্যার ৮০% একদা ক্রীতদাস বানিয়েছিল ২০% লোককে। সংখ্যাগরিষ্ঠের নিয়মানুযায়ী এটা ঠিক ছিল। এটা আসলে গণতন্ত্রের খুব ত্রুটিযুক্ত ধারণা। গণতন্ত্রকে বেশ কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে— জনগণের আনুপাতিক প্রয়োজনীয়তা; কেবল সংখ্যাগুরুদের চাহিদাই নয়, সংখ্যালঘুদের চাহিদাকেও আমলে নিতে হবে। এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে, যে সমাজে মিডিয়া জনমতকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সে সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ মত সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত বা অশুভ হতে পারে। সুতরাং হ্যাঁ, জনগণকে বিবেক অনুসারেই কাজ করতে হবে, কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট দিয়ে নয়।

যুক্তরাষ্ট্রে নৈরাজ্যবাদের ঐতিহাসিক উৎস কোথায় বলে আপনি মনে করেন?

নৈরাজ্যবাদ নিয়ে কাজ করার একটা মুশকিল হচ্ছে এখানে আপনি অনেক লোক পাবেন যাদের ধারণাগুলো নৈরাজ্যবাদী, কিন্তু নিজেদেরকে নৈরাজ্যবাদী বলে অভিহিত করেন না। উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে প্রুধোঁ এটা প্রথমবারের মতো ব্যবহার করেন, কিন্তু তার পূর্বে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে বহু নৈরাজ্যবাদী ধারণা চালু ছিল।উদাহরণস্বরূপ থমাস পেইনের কিছু ধারণার কথা বলা যায়, তিনি নৈরাজ্যবাদী ছিলেন না, নিজেকে এই নামে অভিহিতও করতেন না, কিন্তু সরকার ব্যবস্থা নিয়ে তিনি সন্দিহান ছিলেন। আরো আছেন হেনরি ডেভিড থোরিও। তিনি নৈরাজ্যবাদ শব্দটাও জানতেন না এবং শব্দটা কখনো ব্যবহারও করেন নি। কিন্তু তার চিন্তা নৈরাজ্যবাদের খুব কাছাকাছি। তিনি যে কোনো ধরনের সরকার ব্যবস্থার ঘোর বিরোধী ছিলেন। যদি আমরা যুক্তরাষ্ট্রে নৈরাজ্যবাদের  উৎস সন্ধান করি, তাহলে সম্ভবত থোরিও প্রথম আমেরিকান নৈরাজ্যবাদী হওয়ার খুব কাছাকাছি ছিলেন। সিভিল ওয়ার শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আসলে নৈরাজ্যবাদের সাথে আপনার মোলাকাত হয়নি, যখন ইউরোপীয় নৈরাজ্যবাদী, বিশেষত জার্মান নৈরাজ্যবাদীরা যুক্তরাষ্ট্রে আসতে শুরু করেন। তারাই আসলে সংগঠিত করা শুরু করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে নৈরাজ্যবাদ প্রথমবারের মতো সংগঠিত শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল এবং সর্বজনীন পরিচিত লাভ করেছিল শিকাগোতে, হেমার্কেট ঘটনার সময়ে।

যুক্তরাষ্ট্রের সমসাময়িক নৈরাজ্যবাদের মূল অনুপ্রেরণা আপনি কোথায় দেখেন? ট্রান্সসেন্ডেন্টালিজম সম্পর্কে আপনার মতামত কি? মানে, এই ক্ষেত্রে হেনরি ডি থোরিও, রালফ ডব্লিউ এমারসন, ওয়াল্ট হুইটম্যান, মার্গারেট ফুলারদেরকে অনুপ্রেরণা হিসেবে?

আচ্ছা, ট্রান্সসেন্ডেন্টালিজমকে আমরা বলতে পারি নৈরাজ্যবাদের একেবারে গোড়ার দিকের এক রূপ। তারাও নিজেদেরকে নৈরাজ্যবাদী বলে অভিহিত করেননি, কিন্তু তাদের চিন্তা ও সাহিত্যে নৈরাজ্যবাদী ধ্যানধারণা ছিল। হারমেন মেলভিলে বিভিন্ন ভাবে এমন কিছু নৈরাজ্যবাদী ধারণা প্রকাশ করে। তারা সকলেই কর্তৃত্ব নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। আমরা বলতে পারি যে, কর্তৃত্ব ও সরকারব্যবস্থার প্রতি একধরনের সন্দেহের পরিবেশ তৈরিতে ট্রান্সসেন্ডেন্টালিজম একটা ভূমিকা রেখেছিল।

দুর্ভাগ্যক্রমে, যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে কোনো প্রকৃত সংগঠিত নৈরাজ্যবাদী আন্দোলন নেই। অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ দল বা গোষ্ঠী রয়েছে যারা নিজেদেরকে নৈরাজ্যবাদী দাবি করে, কিন্তু এগুলো ক্ষুদ্র। আমার মনে আছে ১৯৬০’র দশকে এখানে বোস্টনে একটা নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠী ছিল যারা সংখ্যায় প্রায় পনের জনের মতো, কিন্তু তারা তখন বিভক্ত হয়ে যায়। কিন্তু ষাটের দশকের অন্যান্য আন্দোলনের সাথে মিলে ষাটের দশকে নৈরাজ্যবাদ আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।

এনার্কিস্ট পোস্টার

আজকাল র‌্যাডিকাল রাজনীতির বেশিরভাগ সৃজনশীল শক্তি নৈরাজ্যবাদ থেকে উঠে আসছে, কিন্তু এই আন্দোলনে জড়িত খুব কম লোকই নিজেকে নৈরাজ্যবাদী দাবি করেন আপনার মতে এর মূল কারণ কি? রাজনৈতিক কর্মীরা (অ্যাক্টিভিস্ট) কি এই বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের সাথে নিজেকে চিহ্নিত করতে লজ্জা পাচ্ছেন? নাকি তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, সত্যিকারের মুক্তির জন্য যে কোনো ধরনের লেবেল থেকেও মুক্তি প্রয়োজন?

নৈরাজ্যবাদ শব্দটি এমন দুটো প্রপঞ্চের সাথে জড়িয়ে পড়েছে যেগুলোর সাথে প্রকৃত নৈরাজ্যবাদীরা যুক্ত হতে চান না। একটা হচ্ছে সহিংসতা এবং অন্যটা হচ্ছে বিশৃঙ্খলা। নৈরাজ্যবাদের জনপ্রিয় ধারণাগুলোর একদিকে রয়েছে বোমা-নিক্ষেপ ও সন্ত্রাসবাদ এবং অন্যদিকে রয়েছে কোনো বিধি-বিধান, শৃঙ্খলার অভাব, যা ইচ্ছা তাই করতে পারা, বিভ্রান্তি ইত্যাদি। এই কারণে এই শব্দ ব্যবহারে একরকম অনিচ্ছা আছে। কিন্তু ১৯৬০ এর দশকের আন্দোলনগুলো যেভাবে ভাবতে শুরু করেছিল তাতে নৈরাজ্যবাদের প্রকৃত ধারণা মিশে গিয়েছে।

আমার মনে হয় এর সর্বোত্তম প্রকাশটি ঘটেছিল সম্ভবত এসএনসিসি (Student Nonviolent Coordinating Committee) এর সাথে নাগরিক অধিকার আন্দোলনে। এসএনসিসি দর্শন হিসেবে নৈরাজ্যবাদ সম্পর্কে না জেনেই এর বৈশিষ্ট্যগুলোকে মূর্ত করে তুলেছিল। তারা বিকেন্দ্রীভূত ছিল। অন্যান্য নাগরিক অধিকারের সংগঠনগুলো, যেমন সেভেন খ্রিষ্টান লিডারশিপ কনফারেন্স, একজন নেতা (মার্টিন লুথার কিং) সমেত কেন্দ্রীভূত সংগঠন ছিল। এনএএসিপি (National Association for the Advancement of Colored People) নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক একধরনের কেন্দ্রীভূত সংগঠন ছিল। অপরদিকে, এসএনসিসি ছিল পুরোপুরি বিকেন্দ্রীভূত। তাদের ফিল্ড সেক্রেটারি ছিল, যারা পুরো দক্ষিণাঞ্চলের ছোট ছোট শহরে স্বায়ত্তশাসনের সহিত কাজ করত। জর্জিয়ার আটলান্টায় তাদের একটা অফিস ছিল, কিন্তু অফিসের কোনো শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত কর্তৃত্ব ছিল না। আলবামা, জর্জিয়া, লুসিয়ানা এবং মিসিসিপির বিভিন্ন মাঠে যারা কাজ করতেন তারা নিজেদের ওপরই বেশি নির্ভর করতেন। তারা স্থানীয় ও তৃণমূল জনগণের সাথে কাজ করতেন। এবং তাই এসএনসিসির কোনো এক নেতা ছিল না, এবং সরকারের প্রতি সন্দিহান ছিল।

তারা সাহায্য-সমর্থনের জন্য সরকারের উপর নির্ভর করতো না, যদিও ষাটের দশকের গোঁড়ার দিকে সরকারকে প্রগতিশীল লিবারেল বলে ভাবা হতো। বিশেষ করে জন এফ কেনেডিকে। কিন্তু তারা তার আচরণ প্রত্যক্ষ করেছিল। কেনেডি কৃষ্ণাঙ্গদের সমঅধিকারের জন্য দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে উঠা আন্দোলনগুলোকে সমর্থন করেননি। যারা পৃথকীকরণে বিশ্বাস করে (segregationists) এমন বিচারকদের তিনি দক্ষিণে পাঠানো শুরু করলেন এবং তাদেরকে যা ইচ্ছা তাই করার অনুমতি দিলেন। সুতরাং এসএনসিসি ছিল বিকেন্দ্রীভূত, সরকার-বিরোধী, নেতৃত্বহীন। কিন্তু নৈরাজ্যবাদীদের মতো ভবিষ্যতের সমাজ নিয়ে তাদের কোনো ভিশন ছিল না। তাদের দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা ছিল না, ভবিষ্যতে আমাদের কি ধরনের সমাজ হবে তা নিয়ে তাদের কোনো জিজ্ঞাসা ছিল না। তারা আসলেই জাতিগত পৃথকীকরণের তাৎক্ষণিক সমস্যায় মনোনিবেশ করেছিল। কিন্তু তাদের মনোভঙ্গি, তার যেভাবে কাজ করছিল, যেভাবে সংগঠিত হচ্ছিল তা বলা যায় নৈরাজ্যবাদী ধারায় ছিল।

আপনার কি মনে হয় যে, মানুষ মুক্ত হতে পারবে ধারণাটি ক্ষমতাসীনদের জন্য ভয়ঙ্কর হওয়ার কারণেই নৈরাজ্যবাদ শব্দের নিন্দাসূচক (অপ)ব্যবহার করা হয়

কোনো সন্দেহ নেই। নিঃসন্দেহে, নৈরাজ্যবাদী ধারণা ক্ষমতাসীনদের জন্য ভয়ঙ্কর। ক্ষমতাসীনেরা লিবারেল ধারণাগুলোকে সহ্য করতে পারেন। যে ধারণাগুলো সংস্কারের ডাক দেয় সেগুলোকে তারা সহ্য করতে পারেন, কিন্তু কোনো রাষ্ট্র থাকবে না, কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব থাকবে না— এমন ধারণা তারা সহ্য করতে পারেন না। সুতরাং নৈরাজ্যবাদের ধারণাটিকে বিদ্রূপ করা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যেন সহিংস ও বিশৃঙ্খলা হিসেবে নৈরাজ্যবাদের একটা ছাপ তৈরি হয়। হ্যাঁ, তাদের জন্য এটা দরকারি।

অ্যানার্কিস্ট পোস্টার

তত্ত্বীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আমরা বিশ্লেষণাত্মকভাবে অ্যানার্কিজমের দুটো ধারণা শনাক্ত করতে পারি, একদিকে ইউরোপের মধ্যে তথাকথিত যৌথতাবাদী নৈরাজ্যবাদ (collectivist anarchism), এবং অন্যদিকে আমেরিকার মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী নৈরাজ্যবাদ (individualist anarchism) বিশ্লেষণাত্মক এমন পৃথকীকরণের সাথে আপনি কি একমত?    

আমার কাছে এটি একটি কৃত্রিম পৃথকীকরণ। বিশ্লেষকরা প্রায়শই বিষয়গুলো নিজেদের জন্য সহজ করে তুলতে বিভিন্ন বর্গ তৈরি করেন এবং আন্দোলনগুলোকে সেই বর্গে পছন্দসই বসিয়ে দেন। কিন্তু আমি মনে করিনা আপনি এটি করতে পারেন। এখানে যুক্তরাষ্ট্রে নিশ্চয়ই অনেকেই আছেন যারা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী নৈরাজ্যবাদে বিশ্বাস করেন, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রেই আবার ১৮৮০ সালে শিকাগো অথবা এসএনসিসিতে সংগঠিত নৈরাজ্যবাদীদের পাওয়া যায়। আমার মনে হয় উভয় নজিরই ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে পাবেন, তবে ইউরোপে অ্যানার্কো-সিন্ডিকালিজমের ধারণাটা আমেরিকার চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। যদিও, যুক্তরাষ্ট্রে আপনার কাছে আইডব্লিউডব্লিউ (IWW) এর মতো অ্যানার্কো-সিন্ডিকালিস্ট সংগঠন এবং নিশ্চিতভাবেই এটা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী নৈরাজ্যবাদের সাথে মিলে না।

বিপ্লব বনাম সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তন— উপায়ের এই উভয়সঙ্কট বিষয়ে আপনি কি অভিমত

আমি মনে করি এখানে বেশ কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্ন রয়েছে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে ভায়োলেন্স বা সহিংসতার বিষয়, এবং এখানে নৈরাজ্যবাদীরাই দ্বিমত পোষণ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে আপনি মতবিরোধটি খুঁজে পাবেন, এবং আপনি একক ব্যক্তির মধ্যেই এই মতবিরোধটি পেতে পারেন। আপনি বলতে পারেন এমা গোল্ডম্যান, তার মৃত্যুর পর, ষাটের দশকে যুক্তরাষ্ট্রে নৈরাজ্যবাদকে সামনে নিয়ে আসেন। তখন তিনি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেন। কিন্তু এমা গোল্ডম্যান হেনরি ক্লে ফ্রিকের হত্যার পক্ষে ছিলেন, আবার তিনিই পরে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এটা ঠিক পথ নয়। তার বন্ধু ও কমরেড অ্যালেক্সান্ডার বার্কম্যান সহিংসতার ধারণাকে পুরোপুরি নাকচ করেননি। অন্যদিকে আপনি টলস্টয় এবং এমনকি গান্ধীরও মতো অ্যানার্কিস্ট পাবেন যারা অহিংসতায় বিশ্বাস করতেন।

উপায়ের বিষয়ে নৈরাজ্যবাদের একটি কেন্দ্রীয় নীতি আছে, এবং সেই নীতি হলো প্রত্যক্ষ সংগ্রামের (ডিরেক্ট একশন) নীতি— প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারব্যবস্থা, ভোটদান, আইন প্রণয়নের মতন সমাজ কর্তৃক প্রস্তাবিত রূপগুলোর মাধ্যমে না গিয়ে সরাসরি ক্ষমতা গ্রহণ। ট্রেড ইউনিয়ন, অ্যানার্কো-সিন্ডিকালিজমের ক্ষেত্রে এর অর্থটা কেবল শ্রমিকদের ধর্মঘটে যাওয়াই নয়, বরঞ্চ তারা যে কারখানায় কাজ করেন সেগুলো দখল করা এবং পরিচালনা করা। প্রত্যক্ষ সংগ্রামটা কি? দক্ষিণে যখন কৃষ্ণাঙ্গরা জাতিগত পৃথকীকরণের বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছিল, তারা তখন সরকারের সংকেতের জন্য অপেক্ষা করেনি, আদালতের মাধ্যমে যায়নি, মামলা দায়ের করেনি, কংগ্রেসে আইন পাস করার অপেক্ষা করেনি। তারা সরাসরি একশনে চলে গিয়েছিল, তারা রেস্টুরেন্টে গিয়েছে, বসে পড়েছে এবং নড়েনি। তারা বাসে উঠে পড়েছে এবং যে পরিস্থিতিকে হাজির করতে চায় সেটাই বাস্তবায়ন করেছে।

অবশ্য, ধর্মঘট-হরতাল সর্বদাই একধরনের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম। ধর্মঘটের মাধ্যমে আপনি কেবল আইন পাস করে বিষয়গুলো সহজ করার জন্য সরকারকে বলছেন না, বরঞ্চ আপনি মালিকের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামেই নেমেছেন। আমি বলব, উপায় বিষয়ে যতদূর যাওয়া হোক না কেন, আপনি যে অশুভ শক্তিকে সরাতে চান তার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ধারণাই নৈরাজ্যবাদী চিন্তা ও আন্দোলনের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য। আমি এখনও মনে করি, নৈরাজ্যবাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নীতি হচ্ছে, আপনি উপায় ও উদ্দেশ্যকে পৃথক করতে পারবেন না। যদি আপনার উদ্দেশ্য থাকে সমতাবাদী (egalitarian) সমাজ, তাহলে আপনাকে সমতাবাদী উপায় ব্যবহার করতে হবে, আপনার যদি উদ্দেশ্য হয় যুদ্ধবিহীন অহিংস সমাজ, তাহলে সেটা আপনি কখনো যুদ্ধের মাধ্যমে হাসিল করতে পারবেন না। আমি মনে করি নৈরাজ্যবাদের চাওয়া হচ্ছে উপায় ও উদ্দেশ্যকে সামঞ্জস্য রেখে চলা। আমি মনে করি এটা আসলে নৈরাজ্যবাদের অন্যতম স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।

নোয়াম চমস্কিকে তার নৈরাজ্যবাদী সমাজের ভিশনের ব্যাপারে এবং সেখানে পৌঁছানোর বিস্তারিত পরিকল্পনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, আপনি যদি এগুলো নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা না করেন তাহলে কোন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে তার সুরাহা করতে পারবেন না আপনার কি এমন মনে হয় যে, অনেক বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা চর্চার ক্ষেত্রে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করতেই সহি উপায় ও উদ্দেশ্য নিয়ে তাত্ত্বিক বিতর্কে প্রচুর শক্তি হারাচ্ছেন?

আমি মনে করি নমনীয়তা বজায় রেখে বিভিন্ন আইডিয়া বা ধারণা পেশ করা গুরুত্বপূর্ণ, যেমন উদারহরণস্বরূপ মাইকেল অ্যালবার্টের ParEcon (Participatory economics, often abbreviated ParEcon) কথা বলা যায়। আমরা ভবিষ্যৎ সমাজের ব্লুপ্রিন্ট এখন তৈরি করতে পারবো না, কিন্তু আমি মনে করি এটা নিয়ে চিন্তা করা ভালো। মনের মধ্যে একটা লক্ষ্য রাখা ভালো। ভবিষ্যতের সমাজ কেমন হবে তা নিয়ে চিন্তা করাটা গঠনমূলক, সহায়ক এবং স্বাস্থ্যকর, কারণ তখন আপনি আজকে যা করছেন তা খানিকটা পথপ্রদর্শন করবে, কিন্তু সেটা কেবল ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ ভবিষ্যৎ সমাজ নিয়ে আলাপ-আলোচনা ভবিষ্যতের দিকে কাজ করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। অন্যথায়, আপনি এই ইউটোপিয়ান সম্ভাবনা বনাম ঐ ইউটোপিয়ান সম্ভাবনা নিয়ে বিতর্কেই সময় খোয়াবেন, এবং এই সময়ে সেটার কাছাকাছি যাওয়ার মতো কাজও করছেন না।

সূত্র: অ্যানার্কিস্ট আর্ট এন্ড প্রপাগান্ডা

Peoples History of United States গ্রন্থে আপনি দেখিয়েছেন যে, আমাদের স্বাধীনতা, অধীকার, পরিবেশগত মান ইত্যাদি গুটিকয়েক ধনী ও প্রভাবশালীরা কখনো দিয়ে দেয়নি, বরং সাধারণ মানুষ অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে সর্বদা লড়াই করেই সেটা আদায় করেছে এই ক্ষেত্রে আরেকটি ভালো দুনিয়ার দিকে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হওয়া উচিৎ?

আমি মনে করি আমাদের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে নিজেদের সংগঠিত করা এবং বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা— যুদ্ধের বিরুদ্ধে, অর্থনৈতিক ও যৌন শোষণের বিরুদ্ধে, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ইত্যাদি। কিন্তু এমনভাবে নিজেদের সংগঠিত করতে হবে যেন উপায়ের সাথে উদ্দেশ্যের সামঞ্জস্য থাকে, এবং এমন এক মানবিক সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে নিজেদের সংগঠিত করতে হবে যেন সে সম্পর্ক ভবিষ্যৎ সমাজে বিদ্যমান থাকতে পারে। এর মানে হলো কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব, কোনো ক্যারিশম্যাটিক নেতা ছাড়াই এমনভাবে নিজেদের সংগঠিত করতে হবে যেন তা ভবিষ্যতের সমতাবাদী সমাজের আদর্শের একটি ছোটখাটো চিত্র হাজির করে। ফলে, আপনি যদি আগামীকাল অথবা পরের বছর যদি কিছু নাও জিতেন, তবু এর মাঝেই কিন্তু আপনি একটা মডেল দাড় করিয়ে ফেলেছেন। ভবিষ্যতের সমাজ কেমন হওয়া উচিৎ তা আপনি বের করে ফেলেছেন এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন না করতে পারলেও আপনি একটা তাৎক্ষনিক পরিতৃপ্তি তৈরি করে ফেলেছেন।

মানুষের স্বাধীনতার প্রবৃত্তি রয়েছে, কেবল ইচ্ছাই নয় জৈবিক প্রয়োজনও আছে, বাকুনিনের এই অন্টোলজিক্যাল অনুমানের বৈজ্ঞানিক প্রমাণের বিভিন্ন প্রচেষ্টা সম্পর্কে আপনার কি অভিমত?

আমি আসলে এই ধারণায় বিশ্বাস করি, কিন্তু আমি মনে করি এর স্বপক্ষে আপনি বায়োলজিক্যাল বা জৈবিক প্রমাণ পাবেন না। স্বাধীনতার জন্য কি আপনাকে জিন খুঁজে পেতে হবে? না। আমি মনে করি আরেকটা উপায় হচ্ছে মানব আচরণের ইতিহাসের দ্বারস্থ হওয়া। মানব আচরণের ইতিহাস স্বাধীনতার এই আকাঙ্ক্ষাই প্রমাণ করে। ইতিহাস এটা প্রমাণ করে যে, জনগণ যখনই স্বৈরশাসনের অধীনে বসবাস করেছে, এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে।

সহুল আহমদ

সহুল আহমদ, লেখক, অনুবাদক ও অ্যক্টিভিস্ট। গবেষণার পাশাপাশি সমকালীন বিষয়াবলীর বিশ্লেষক। জন্ম সিলেটে, ১৯৯১ সনে। পড়াশোনা করেছেন শাবিপ্রবিতে, পরিসংখ্যান বিভাগে। একাধিক জার্নাল সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত। প্রকাশিত বই: মুক্তিযুদ্ধে ধর্মের অপব্যবহার; জহির রায়হান: মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক ভাবনা; সময়ের ব্যবচ্ছেদ (সহ-লেখক সারোয়ার তুষার)। অনুবাদ: ইবনে খালদুন: জীবন চিন্তা ও সৃজন।