অরাজ
প্রচ্ছদ » স্টেট স্পন্সর্ড ভিক্টিম ব্লেমিং: নতুন মহামারী, পুরানো দোষারোপ

স্টেট স্পন্সর্ড ভিক্টিম ব্লেমিং: নতুন মহামারী, পুরানো দোষারোপ

  • সুবিনয় মুস্তফী ইরন

মূলত সিস্টেম ও সিস্টেমের ডিজাইনারদের দায়িত্ব মানুষকে বোঝা এবং সেই অনুযায়ী কাজ করা। এটা মানুষের দায়িত্ব না যে, সিস্টেমের ইচ্ছেমতন এর স্বেচ্ছাচারী, অর্থহীন নির্দেশনা মানুষ মেনে চলবে।
—ডন নরম্যান, দ্যা ডিজাইন অব এভরিডে থিংস

ভিক্টিম ব্লেইমিং— বহুল প্রচলিত একটি টার্ম। কোনো অপরাধ বা নিপীড়নমূলক  ঘটনায় সেটির জন্য ক্ষতিগ্রস্ত তথা ভিক্টিমকেই দোষ ও দায় দেওয়াকে ভিক্টিম ব্লেইমিং বলে। ভিক্টিম ব্লেইমিং এর  একটি অন্যতম প্রচলিত উদাহরণ হলো: কোনো নারীর প্রতি সেক্সুয়াল, ডামেস্টিক বা অন্য কোনো ধরনের ভায়োলেন্স ঘটলে সেই ভিকটিম নারীটিকেই দোষ দেওয়া হয়। বলা হয়, নারীটিই দায়ী এবং ভিক্টিম নিজে তার দুর্দশাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আমরা সাধারণত এই টার্মটি ব্যক্তিগত পর্যায়ের নানা ঘটনায় ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু সমাজ ও ব্যক্তি পর্যায়কে ছাড়িয়ে এটির খুবই শক্ত প্রয়োগ দেখা যায় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। রাষ্ট্র ও সরকারের নানা প্রকার দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার জন্য দোষারোপ করা হয় জনতাকে। যাকে ‘স্টেট স্পনসর্ড ভিক্টিম ব্লেইমিং’ বলা যায়। বাংলাদেশ রাষ্ট্র বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে এটির সর্বোচ্চ চর্চা করে যাচ্ছে। এই করোনা মহামারীর সময়েও আলাদা কিছু হচ্ছে না। এই লেখাটিতে করোনার সময়কার কয়েকটি ঘটনা ও সাধারণ সময়ের কয়েকটি ভিক্টিম ব্লেইমিং সম্পর্কিত ঘটনা নিয়ে আলোচনা করা হবে।

কোনো ভুল কিছু ঘটলেই তাতে ব্যক্তির দোষ মনে করার ধারণাটা সমাজে বেশ গভীরে গেঁথে আছে। এই কারণেই আমরা অন্যদেরকে এমনকি নিজেদেরকেও দোষারোপ করি। দূর্ভাগ্যজনকভাবে, মানুষকে দোষারোপ করার এই ধারণা আমাদের আইনি ব্যবস্থাতেই বিদ্যমান। যখনই কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটে, তখন কোট-কাচারি করে এই দোষারপের আইনিযজ্ঞ শুরু হয়। আর সবসময়ই আরও নানা উপায়ে এই দোষারোপের বলি করা হয় ‘হিউম্যান এরর’কে। জড়িত ব্যক্তিকে জরিমানা, শাস্তি, বরখাস্ত ইত্যাদির ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিংবা প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে রিভাইজ করা হয়। আইন যেমন ছিলো, তেমনই তার মতন থাকে। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায় বলে, হিউম্যান এরর আসলে খারাপ ডিজাইনের একটা ফল। একে আসলে ‘সিস্টেম এরর’ বলে ডাকা উচিত। মানুষ অবিরাম ভুল করে যাবে– এটাই আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি। সিস্টেম ডিজাইনের এই ব্যাপারটা আমলে নেওয়া উচিত। ব্যক্তিকে দোষারোপ করা হয়তো একটা আরামদায়ক প্রক্রিয়া, কিন্তু সিস্টেমটা কেন এমনভাবে ডিজাইন করা, যাতে একজন ব্যক্তির একটা সিঙ্গেল কাজের ফলে পুরো সিস্টেমে বিপর্যয় ঘটবে? মূল অন্তর্নিহিত সমস্যা সমাধান না করে ব্যক্তিকে দোষারোপ করা আরও খারাপ একটা কাজ, এতে সমস্যার সমাধান হয় না। সেই একই ভুল, একই ত্রুটি আরেকজন ব্যক্তির মাধ্যমেই রিপিট হতে থাকে।
—ডন নরম্যান, দ্যা ডিজাইন অব এভরিডে থিংস

বিভিন্ন সমস্যায় জনতাকে দোষারোপ করার ব্যাপারটিকে স্টেট স্পন্সর্ড ভিক্টিম ব্লেইমিং বলার কারণ এটি সুপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। যার সাথে বিভিন্ন কর্পোরেট ও এনজিওভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম জড়িত থাকে। এতে এমনকি সরকারের সাথে সম্পর্কিত কিংবা এই চিন্তা-ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত বুদ্ধিজীবী, এক্টিভিস্ট কিংবা অন্য পরিচয়ের মানুষও জড়িত থাকে। নয়া-উদারবাদ, বিজ্ঞানবাদ, সংস্কৃতিবাদ, দেশপ্রেম, মানবতাবাদ, পলিটিক্যাল কারেক্টনেস, মেধাতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে আস্থা এনে এই গোষ্ঠী জনতার বাকিদেরকে হেয় গণ্য করে ক্রমকর্তৃত্বতান্ত্রিক (hierarchical) নিপীড়নের বয়ান প্রচার করে। অদ্ভুতভাবে, তারা এই গোষ্ঠীগুলো নিজেদেরকে জনতার থেকে আলাদা বা বাইরের মনে করে। বাকি জনতার মঙ্গল তারা নিজেরাই ঠিক করতে চায়। কেবলমাত্র নিজেদের আর্থ-সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং নয়া-উদারতাবাদী কিছু বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে তারা অযৌক্তিকভাবে পর্যাপ্ত পর্যালোচনা ছাড়াই  বাকি জনতার কী করা উচিত, কী করতে হবে এই জাতীয় আলাপ দিয়ে থাকে। রাষ্ট্রীয় নানা প্রচারণা ও এস্টাবলিশমেন্টের ফলে প্রিভিলেজড এই গোষ্ঠীর মধ্যে বিভ্রান্তির জন্ম নেয়, আবার অনেকে কার্যতই সরকারের হয়ে কাজ করে। এছাড়া কোনো ঘটনায় শাসকের সিস্টেমের দিকে আঙুল তোলার চেয়ে জনতাকে দোষ দেওয়া নিরাপদ ও নিজের মোরাল হায়ারার্কি বৃদ্ধির জন্য সহায়ক। যার ফলে স্বাভাবিকভাবেই জনতার একটা অংশ নিজেরাও নিজেদেরকে দোষারোপ করে। আবার, দীর্ঘ নিপীড়নের ফলে হতাশ জনতা একসময় মনে করে এসব দুর্দশা নিপীড়িতের নিজের কারণেই হয়েছে।

প্রথমত, সচেতনতা, দেশপ্রেম, উদারতা, সুশিক্ষা, নাগরিক দায়িত্ব ইত্যাদি শব্দের আবরণে এক মিথ্যে নৈতিকতার আবরণ তৈরি হয়। আর দ্বিতীয়ত, শাসনব্যবস্থায় প্রশ্ন তুললে ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে নানাপ্রকার আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়। কিন্ত, একই ক্ষেত্রে জনতার, নাগরিকদের দোষারোপ করে কোনো আলাপ আলোচনা দাঁড় করালে বরঞ্চ সরকারি বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে প্রশংসাও পাওয়া যায়। রাষ্ট্রীয় এই ভিক্টিম ব্লেইমিং এর অন্যতম প্রধান ভয়ঙ্কর দিক মূলত এটিই যে, এতে করে খোদ রাষ্ট্রের নাগরিকই তার সহ-নাগরিকের বিরুদ্ধে ও তার নিজের বিরুদ্ধে ন্যারেটিভ দাঁড় করানো শুরু করে। নিজের অধিকারকে নিজেই বিভিন্ন কর্পোরেট গোষ্ঠী, সরকার ও রাষ্ট্রের কাছে বন্ধক দিয়ে রাখে। এভাবে জনতাকে দোষারোপের ফলে রাষ্ট্র সমগ্র জনতাকেই আরও বেশি নিপীড়নের আওতায় আনার সম্মতি লাভ করে।

বাংলাদেশে বর্তমানে কার্যত স্বৈরতন্ত্র বিদ্যমান।  আওয়ামীলীগ সরকারের দীর্ঘ মেয়াদি এই স্বৈরতন্ত্রে উন্নয়ন, জিডিপি ইত্যাদি নানা সমৃদ্ধির গপ্প  প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অথচ রাষ্ট্র তার ন্যূনতম গণতান্ত্রিক চেহারাটিও হারিয়ে ফেলেছে এই সরকারের আমলে। যেহেতু রাষ্ট্র ও সরকার দুটোই অগণতান্ত্রিক, তাই জনতাকেই সবসময় নিপীড়িত হতে হয়। জনতার প্রতি সবসময়ই চলতে থাকে নানাবিধ নির্যাতন। আর সেই নির্যাতনের বৈধতা দিতেও ন্যারেটিভের উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাষ্ট্র বাকিদের মুখ বন্ধ করার ও মগজ ধোলাইয়ের পাঁয়তারায় থাকে সবসময়। এই জুলুমের সম্মতি উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়ার একটি অংশ হলো পাবলিক ভিক্টিম ব্লেইমিং। বিগত কয়েকটি জাতীয় দুর্যোগ, নাগরিক দুর্যোগ, নিরাপত্তা সংকট ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকার ও বিভিন্ন কর্পোরেট এজেন্সির নানাপ্রকার প্রচার-প্রচারণা ও ন্যারেটিভের দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হবে।

২০১৮ সালের অন্যতম আলোচিত আন্দোলনের নাম নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। সড়কে নিরাপত্তার দাবিতে সারা দেশের স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীরা রাজপথ দখল করে নেয়। তাদের অনেকেই রাস্তার দখল নিয়ে দেখিয়ে দেয় যে চাইলেই অনেক কিছু জনতা ঠিক করতে পারে। এমনকি তারা রাষ্ট্র মেরামতের দাবিও তোলেন। ক্ষমতাসীনদের বেকায়দায় ফেলে দেয়া এই আন্দোলনকে অবশেষে পুলিশ ও নিজ দলের গুণ্ডাদের হামলার মাধ্যমে দমন করা হয়। এই সরকারি হামলাকে বৈধতা দিতে ও আড়াল করতে পরবর্তীতে শুরু হয় রাষ্ট্র প্রণোদিত ভিক্টিম ব্লেইমিং প্রকল্প। বলা হতে থাকে, নাগরিকরা নিজেরাই রাস্তা ঠিক করে পার হয় না, ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করে না, তাই তাদের নিরাপদ সড়ক চাইবার অধিকার নাই।  সড়কের অব্যবস্থাপনা ঠিক না করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে তারা। ‘সচেতনতা’ সৃষ্টির নামে এই ভিক্টিম ব্লেইমিং-এ  দেশের বিভিন্ন সেলেব্রেটি ও কর্পোরেট এজেন্সিও যোগ দেয়। সবচেয়ে বেশি দোষ দেওয়া হয় ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করাকে। একইসাথে যেখানে সেখানে ফুট ওভার ব্রিজ তৈরির প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ফুটওভারব্রিজ প্রীতির অন্যতম কারণ এতে অনেক টাকার বাজেট থাকায়, দুর্নীতিরও অনেক সুযোগ রয়েছে।  কিন্তু আদতে দেশের নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, ফুটওভার ব্রিজ একটি অপ্রয়োজনীয় কাঠামো। যা যেকোনো শহরের জন্য ক্ষতিকর। আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রচণ্ড অমানবিক। সিগন্যাল ব্যবস্থা ঠিক না করে, জেব্রা ক্রসিং ঠিক না করে,  শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সুস্থ কাজের পরিবেশ নিশ্চিত না করে, রাস্তাঘাট সংস্কার না করে তারা কেবল দোষারোপ আর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়। যার সবই অকার্যকর আর নিপীড়নমূলক।

এরপর ধরা যাক, জলাবদ্ধতা। বর্ষা মৌসুমে ঢাকায় জলাবদ্ধতা প্রচণ্ড আকার নেয়। আর এই সময়ে সরকার নিজেদের বর্জ্য ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা সংস্কার করার বদলে জনগণকে প্রশ্ন করে যে তারা কেন ড্রেনে ময়লা ফেলে। অথচ তাদের জন্য উপযুক্ত স্থান বা ব্যবস্থাও সরকার তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। পাশাপাশি আড়াল করে এই সত্য যে, একটি কার্যকর ড্রেনেজ সিস্টেম থাকলে, কোন ময়লাই জমার কথা না। সবই অতিরিক্ত জলে ধুয়ে-ভেসে যাবার কথা। কিন্ত ঢাকার জলাবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ যে বিভিন্ন জলাশয়ের অবৈধ দখলদারিত্ব এই সত্য আড়াল করা হয়। সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতাও আলোচনায় আসে না।

একইরকমভাবে নগরের অবস্থার উন্নতির জন্য কাজ করার বদলে দোষারোপের মাধ্যমে জনতার প্রতি আরও নিপীড়ন নিশ্চিত করার কাজটি সরকার প্রত্যেক ঘটনাতেই করে যাচ্ছে। এমনকি ডেংগু মশার উৎপাতের সময়ও। আর টেলিভিশন, পত্রিকায় প্রতিনিয়ত সুনাগরিক হতে, আইন মেনে চলতে বলা হচ্ছে ‘সচেতনতা’ তৈরির নামে। টিভি নিউজ রিপোর্টে রাস্তায় র‍্যান্ডম মানুষজনকে ধরে হেনস্তা করা হয়। কিন্তু, মূল সিস্টেমের দিকে নজর নেই। সিস্টেমই যে মানুষকে ভুল কাজ করতে বাধ্য করে, মানুষের জীবনকে কঠিন করে তোলে সেই প্রশ্ন তোলার খবর নেই। বরঞ্চ, ভিক্টিম নাগরিককেই বারবার বলা হয় তারা নিজেরাই দোষী। এই প্রক্রিয়াটি এতই ক্রিয়াশীল যে, খোদ নিপীড়িত  নাগরিকের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সরকারি প্রোপাগান্ডা মেশিনে পরিণত হয়ে পড়ে। আর তারা তাদের সহ-নাগরিকদের প্রতি নানা প্রকার বিদ্বেষ চর্চা করতে থাকে।

আমরা যদি খেয়াল করি, তবে লক্ষ্য করবো যে, করোনা মহামারির শুরু থেকেই সরকার ব্যর্থতা ঢাকতে ও অন্যায়ের ন্যায্যতা পেতে একই কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে। গণমানুষের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ সরকার বরাবরই আঙুল তোলে গণমানুষের  দিকে। করোনা সংকটেও তার আলাদা কিছু ঘটেনি, একেবারে শুরু থেকে লক্ষ্য করা যাক।

প্রথম টার্গেট: ইতালি ফেরত শ্রমজীবী প্রবাসীগণ

করোনা সংকটের অব্যবস্থাপনা লুকাতে সর্বপ্রথম যাদের উপর দোষারোপ করে যাদেরকে ‘জাতীয় শত্রু’ হিশেবে উপস্থাপন করা হয় তারা হলেন গত বছরের ১৪ই মার্চ ইতালি থেকে আসা ১৪২ জন প্রবাসী। বিদেশ থেকে আসা লোকদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে না পারার ব্যর্থতাকে রাষ্ট্রীয় প্রপাগান্ডা মেকানিজম এই প্রবাসী মানুষদেরকে দোষারোপের মাধ্যমে লুকাতে অনেকটাই সক্ষম হয়। মার্চের মধ্যখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ভাইরাল স্ট্যাটাসের মাধ্যমে সবাই জানতে পারে দেশে একসাথে বিপুল পরিমাণ প্রবাসী বাংলাদেশী প্রবেশ করছে। ইতালিতে ততদিনে করোনার অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ আকার নিয়েছে। তাই স্বভাবতই বাংলাদেশে থাকা নাগরিকদের মনে আশঙ্কার জন্ম হয়েছিলো। সরকারের উচিত ছিলো যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে সকলের স্বাস্থ্য বিষয়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু দেখা গেলো তাড়াহুড়া করে ইতালি থেকে আসা প্রবাসীদেরকে আশকোনা হজ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অভিযোগ পাওয়া যায়, তাদেরকে ঠিকমতন খেতে দেওয়া হয়নি, স্বাস্থ্যসেবার মান অতি নিম্ন ছিলো, বাচ্চাদের জন্যও অসুবিধার পরিবেশ ছিলো, কোয়ারেন্টিন সেন্টারের মান অত্যন্ত বাজে।  তারপরই সেখানে এসব নানা প্রকার বাজে ব্যবস্থাপনার ফলে প্রবাসীরা বিক্ষোভ প্রকাশ করেন। এই বিক্ষোভকে আমলে নেওয়ার বদলে সরকার তাদেরকেই দোষ দেওয়া শুরু করে। তাদের বিক্ষোভের একটি ভিডিওকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়। প্রথমেই শুরু হয়, তাদের দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে প্রশ্ন তোলা। সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন সরকারপন্থী একটিভিস্টরা প্রশ্ন তোলে, এই ইতালি প্রবাসী নাগরিকরা যথেষ্ট দেশপ্রেমিক নন। কেননা তারা এই জাতীয় দুর্যোগের সময় দেশে এসে বাকিদের বিপদে ফেলতেন না, যদি তারা যথেষ্ট দেশপ্রেমিক হতেন। এই ধরনের বক্তব্য পরবর্তীতে পুরো সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। প্রবাসীদের নিয়ে প্রচুর ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক ন্যারেটিভ দেখা যায়। কিন্তু, এটি মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা যে, দূর্যোগের সময় নিজ ভূমিতে, নিজ পরিবারের সাথে থাকতে চাওয়া। ইতালিতে যেখানে মহামারি অবস্থা বাংলাদেশের থেকেও বাজে ছিলো, সেখানে প্রবাসীরা কী করে টিকে থাকবে? সকলের কি একই ধরনের প্রিভিলেজ ও আর্থিক সক্ষমতা রয়েছে? এছাড়াও রাষ্ট্রের কি দায়িত্ব না তার নাগরিককে রক্ষা করা? যেই রাষ্ট্রকে তারা ট্যাক্স,  ক্ষমতা ইত্যাদি দিয়ে রেখেছে নিজেদের কল্যাণের জন্য, সেই রাষ্ট্র যদি দুর্যোগের সময় পাশে না দাঁড়ায় তাহলে কি ক্ষোভ প্রকাশ করাই স্বাভাবিক নয়? একটা লোক বেকার, তার দেশে স্বজনদের কাছে ফিরবে। এটাই তো বড় কারণ। কেউ বিদেশ থেকে রেমিটেন্স পাঠাবে আর বিপদগ্রস্ত হলে দেশে ফিরতে পারবে না, ঐ দেশে বেকার হয়ে মরবে– এটা তো তাকে বেনাগরিক করে মারার মতো। সরকারের যেখানে উচিত ছিলো তাদের জন্য উপযুক্ত কোয়ারেন্টিন সেন্টারের ব্যবস্থা করা, সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী গণমাধ্যমের সামনে বলেন, “প্রবাসীরা দেশে এলেই নবাবজাদা হয়ে যান। তারা কোয়ারেনটাইনে যাওয়ার বিষয়ে খুব অসন্তুষ্ট হন। ফাইভ স্টার হোটেল না হলে তারা অপছন্দ করেন।” যা অত্যন্ত আপত্তিকর। রাষ্ট্রের নাগরিকের প্রতি নূন্যতম দায়িত্ববোধ নেই, সম্মান নেই এরকম একজন লোককে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। প্রবাসীরা কোনো ফাইভ স্টার হোটেল চাননি, তারা একটি সুব্যবস্থাপনার সম্মানজনক কোয়ারেন্টিন সেন্টার চেয়েছিলেন। কিন্তু পুরো ঘটনায় খোদ ভিক্টিমকেই যাবতীয় অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী করা হয়েছে।

এই ইতালি প্রবাসীদের ভিক্টিম ব্লেইমিং এর  পরের ধাপ, ইতালি থেকে আসা বাংলাদেশি নাগরিকদের শ্রেণি, শিক্ষাগত যোগ্যতা, স্বভাব ইত্যাদি নিয়ে শ্রেণি-বর্ণবিদ্বেষী আক্রমণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায়, সরকারপন্থি অনেকেই ইতালি থেকে আসা প্রবাসীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, তাদের শ্রমিক পরিচয় ইত্যাদির কারণে তাদের সবার স্বভাব-চরিত্র খারাপ বলে পোস্ট দিয়েছেন। সাধারণত সবসময়ই এই ধরনের বিদ্বেষমূলক প্রচারণার জন্য কিছু মিথ্যা তথ্যের প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে মিথ্যা তথ্য হিসেবে দেখা যায় এর আগে উহান থেকে আসা প্রবাসীদের কথা। বিভিন্ন পোস্টে দাবি করা হয় যে, উহানের লোকজন অধিকাংশই শিক্ষাকাজে উহানে যাওয়ায়, শিক্ষিত হওয়ায় উহান থেকে এসে তারা নাকি কোনো অভিযোগ করেননি। তারা সরকারের সব আদেশ মেনে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে ঐ একই হ্বজ ক্যাম্পে ১৪দিন কোয়ারেন্টিনে ছিলেন। এই তুলনা দেখিয়ে দাবি করা হয়, ইতালির শ্রমজীবী প্রবাসীরা অশিক্ষিত ও মূর্খ, তাই তারা কোয়ারেন্টিন মানেনি। এভাবে তাদের প্রতি হওয়া অন্যায়ের ন্যায্যতা আদায় করা হয়, আর এর দোষ তাদেরকেই দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তব চিত্র আসলে কী? উহানের লোকজন কি সত্যিই বিনা অভিযোগে সরকারের সব বিধি মেনে চলেছিলেন? গতবছর ২ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ হওয়া বিবিসি বাংলার নিউজে দেখা যায় উল্টো চিত্র।  “একই রুমের মধ্যে আমরা গ্যাদারিং করে পড়ে আছি। আমাদের রুমেই ৪০ থেকে ৫০ জন হব। এই রুমেই আছে ৮টা পরিবার। এদের মধ্যে বাচ্চারাও আছে। আবার ব্যাচেলরও আছে”, চীন থেকে এসে হজ ক্যাম্পে থাকা দুই সন্তানের মা ফারজানা ইসলাম জানান। পিএইচডি করতে চিনে যাওয়া শামীমা সুলতানা জানান,  “কোয়ারেন্টাইন বলতে যা বোঝায় সেটা হচ্ছে বিচ্ছিন্ন রাখা। তো সেটাতো এখানে দেখছি না। কালকে থেকে এ পর্যন্ত যেটা দেখলাম তাতে আমার মনে হচ্ছে যে অব্যবস্থাপনার একটা বিষয় আছে। কাল থেকে যে খাবারগুলো আসছে সে খাবারগুলোর প্যাকেটও এখনো পড়ে আছে। রুম থেকে বের করে মশা মারার জন্য ধোঁয়া দিয়েছিল। এটাও আমরা আসার আগে করলে ভাল হতো।” এছাড়া ২০২০-এ ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখে দ্য বাংলাদেশ টুডে পত্রিকায় “আশকোনা ক্যাম্পে নানান অব্যবস্থাপনার অভিযোগ চীন ফেরত শিক্ষার্থীদের!” শিরোনামে প্রকাশিত খবরে জানা যায় যে, উহান থেকে আসা অনেকেই দাবি করেছেন তাদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা হয়নি। এমনকি তাদের কাছে স্বাস্থ্যকর্মীরাও যায়নি। এই একই হজক্যাম্পেই ইতালি থেকে আসা প্রবাসীদের রাখা হয়েছে। যা অত্যন্ত বাজে অবস্থার একটি কোয়ারেন্টিন সেন্টার। সেখানে বরঞ্চ সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বেশি ছিলো। অথচ একটি ভুল ও মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ইতালি থেকে আসা প্রবাসীদের উপর শ্রেণিবিদ্বেষী আক্রমণ করা হয়।

ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসাকর্মীদের শত্রু হিসেবে উপস্থাপন

করোনাভাইরাস একটি স্বাস্থ্য বিষয়ক দুর্যোগ। তাই এই দুর্যোগ মোকাবেলায় সবার সামনে থেকে কাজ করতে হচ্ছে ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসাকর্মীদেরকে। কিন্ত, এরকম একটি জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলায় কেবল ব্যক্তিগতভাবে খেটে গেলেই হয় না। একটি উন্নত, জনবান্ধব নীতি নির্ধারণী ও নির্বাহী কাঠামো প্রয়োজন। কিন্ত আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে দুর্নীতি, লুটপাট, নিপীড়ন, উন্নয়নের মিথ্যা প্রপাগান্ডা, কর্তৃত্বের প্রয়োগ ছাড়া আর কিছুই হয়নি। তাই এই জাতীয় সংকটকালে একটি একেবারেই ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার স্বরূপ চূড়ান্ত রকমে প্রকাশ হয়ে পড়ে। এটি আড়াল করতেও নিজেদের ক্ষমতাকে বাঁচাতে নতুন বলি হিসেবে খোদ চিকিৎসা কর্মীদেরকেই বেছে নেওয়া হয়।

করোনা পরিস্থিতির শুরুর দিকে, ২০২০ সালের ১৪ই মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ঢামেক) নাজমা আমিন নামের এক তরুণীর মৃত্যু হয়। কারণ হিসেবে দেখা যায়, করোনা সন্দেহে চিকিৎসকরা তাকে চিকিৎসা দিতে অবহেলা করে। এরকম আরও বেশ কিছু ঘটনার পর ডাক্তারদের প্রতি আক্রমণ শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে অনলাইন ও অফলাইনে বিভিন্ন জায়গায় ডাক্তারবিরোধী ন্যারেটিভ প্রচার হয়। চিকিৎসায় অবহেলা মোটেই কাম্য নয়। কিন্ত একজন ডাক্তারের কাছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকলে তিনি কী করে চিকিৎসা করবেন সেটাও জরুরী সমস্যা। ডাক্তারদের অভিযোগ ছিলো তাদের কাছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, যেমন পিপিই, মাস্ক বা অন্যান্য নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরকার কিংবা কর্তৃপক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। এমন অবস্থায় করোনার চিকিৎসা করতে গেলে ডাক্তাররাও বিপদে পড়বে। পরবর্তীতে আরও বড় জনগোষ্ঠী ডাক্তারের অভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে পারে। এমনকি করোনা মহামারীর এক বছরে প্রচুর সংখ্যক ডাক্তার মারাও গিয়েছেন। ঢামেকে সেসময়ই চারজন ডাক্তারকে করোনায় আক্রান্ত হবার ফলে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়েছিলো। করোনার সময়ে অন্য রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়ায় সমস্যাযুক্ত। কারণ পর্যাপ্ত পরিমাণের তুলনায় টেস্টিং অনেক কম হওয়ায় কে করোনা রোগী, কে করোনামুক্ত তা জানা যায় না। ফলে ডাক্তারদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করা স্বাভাবিক। করোনার মতন একটি জাতীয় ও বৈশ্বিক মহামারিতে পিপিই, মাস্ক, টেস্টিং কিট সরবরাহ করার বিশেষ দায়িত্ব সরকারের ও বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। তা না করার ফলেই করোনার সময় ডাক্তাররা সঠিকভাবে চিকিৎসা দিতে পারছেন না। সেবার মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রায় ২০০জন ইন্টার্ন চিকিৎসক নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাবে কর্মবিরতি ঘোষণা করে। সেসময় তারা দাবি করে এর আগে হওয়া ডেংগু মৌসুমের সংকটে তারা কর্তৃপক্ষকে অব্যবস্থাপনা সম্বন্ধে জানালেও তাদের নিরাপত্তার নূন্যতম ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। ডেংগুর সময় তারা নৈতিক অবস্থান থেকেই চিকিৎসা কাজ চালিয়েছিলেন। কিন্তু নতুন মহামারিতে তা সম্ভব না। তাদের এই ক্ষোভ অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্ত সামগ্রিকভাবে ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য চিকিৎসা কর্মীদেরকে ‘ভিলেইন’ বানিয়ে উপস্থাপন করা হলো। কেউ কেউ আবার ডাক্তারদেরকে ব্যক্তিগতভাবে পিপিই কিনে সংকট নিরসনের কথা বলেন। কেউ কেউ আমেরিকার গার্বেজ ব্যাগ পরে চিকিৎসা করা নার্সদের উদাহরণ দেখান। কিন্তু, সেই গার্বেজ পরে চিকিৎসা দেওয়া নার্সদের সকলেই পরবর্তীতে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। এমনকি, কুয়েত মৈত্রি হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে করোনা ইউনিটের চিকিৎসাকর্মীরা ঠিক করে খাবার সুবিধাও পাননি।

সরকারের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নতিকরণে কোনো প্রকার ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তাদের দায়ী করা হলো। পিপিই সংকট নিয়ে এত আলোচনা হবার পরও স্বাস্থ্য মন্ত্রী দাবি করেন, দেশে পিপিই সংকট নেই। অথচ এই কারণেই অনেক ডাক্তারকে করোনায় আক্রান্ত হতে হয়েছে। এমনকি সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ডাক্তারদের হুশিয়ারি দিলেন। ৭ই এপ্রিল গণভবনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “প্রয়োজনে আমরা বাইরে থেকে ডাক্তার নিয়ে আসব, বাইরে থেকে নার্স নিয়ে আসব। কিন্তু এই ধরনের দুর্বল মানসিকতা দিয়ে আমাদের কাজ হবে না, এটা হল বাস্তবতা।” স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সামগ্রিক দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনার পরিবেশ জারি রেখে একটি রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান চিকিৎসকদের বাস্তবতা ও দুর্বল মানসিকতার কথা বলেন— এর থেকে হাস্যকর আর নির্মম কথা আর কী হতে পারে!

ডাক্তার বনাম রোগী/জনতা

জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবনতির কারণে স্বাস্থ্যসেবা না পেয়ে জনগণও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। যেহেতু ডাক্তার ও চিকিৎসাকর্মীরা রোগী ও রোগীর আত্মীয়সজনের সাথে যোগাযোগ করে, আর কর্তৃপক্ষ ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে তাই জনতা ও ডাক্তার পারস্পরিক সংঘর্ষের মধ্যে দাঁড়ান। এটিকেও সরকার সমর্থক অনলাইন এক্টিভিস্টরা নিজেদের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠায় ব্যবহার করে থাকেন। জনতাকে মূর্খ, বর্বর প্রতিপন্ন করে, জনতা ডাক্তারদের পেটায়, ডাক্তারদের ত্যাগ স্বীকার করে না ইত্যাদি বয়ানের মাধ্যমে এই দুরবস্থার জন্য জনতাকেই দায়ী করা হয়। অথচ ডাক্তার ও জনগণ— উভয়ই এই বাজে ব্যবস্থার ভিক্টিম।

জনতা লকডাউন মানে না

গত বছরের ২৬শে মার্চ থেকে বাংলাদেশে করোনা মহামারির কারণে প্রথমবারের মতন সাধারণ ছুটি ও লকডাউন ঘোষণা করা হয়। দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা যেখানে এমনিতেই যথেষ্ঠ বাজে, সেখানে এমন মহামারি আরও বড় সমস্যা নিয়ে হাজির হয়। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় জনতাকে ‘করোনায় মরবো নাকি না খেয়ে মরবো’ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। লকডাউনের ফলে এদেশের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ, দরিদ্র দিনমজুর থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তরাও প্রচণ্ড আর্থিক, মানসিক নানা ধরনের সমস্যায় পড়েন। কেননা, লকডাউনে শান্তিমতন জীবনযাপন করতে যেরকম রিসোর্স প্রয়োজন হয়, তার কোনোটাই তাদের নেই। এর কারণও বাংলাদেশ রাষ্ট্র, সরকার ও এসবের সাথে সম্পর্কিত প্রভাবশালী মহলের সীমাহীন দুর্নীতি। বাংলাদেশে লকডাউনের পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা দ্রব্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় রিসোর্স রেশনের মতন করে ব্যবস্থা করা ছাড়া লকডাউনকে মানবিক করা যায় না। দেশের এত এত মানুষের যখন লকডাউনের ফলে কাজে বের হতে না পারলে না খেয়ে থাকতে হয়, তখন লকডাউনে রাষ্ট্রের দায়িত্ব জনগণের প্রধান মৌলিক অধিকার খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কারণ, রাষ্ট্র আর সরকার এই কল্যাণের কথা বলেই জনতাকে শাসনের ক্ষমতা নেয়। কিন্তু বাস্তবে সরকার কী করে? বাস্তবে সরকার এইসব জীবনের প্রশ্ন আড়াল করে রাখে। বাস্তবে সরকার খোদ নাগরিক জনতাকেই দোষারোপ করে। বর্বর ধরনের শাস্তি দেয়। মানুষের মানবাধিকারকে ন্যূনতম সম্মান দেয় না। লকডাউনের শুরু থেকেই জনতার বিরুদ্ধে নানাপ্রকার দোষারোপের প্রচারণা চালায়। এই দোষারোপের চালানোর মূল উদ্দেশ্য জাতীয় দুর্যোগের সময়েও জনতাকে নিয়ন্ত্রণ ও জনতার উপর নিপীড়ন চালানোর ন্যায্যতা অর্জন।

গত বছরের ২৬শে মার্চ, লকডাউনের প্রথমদিনে ফেসবুকে একটি ভিডিও দেখা যায়। যেখানে পিপিই পরা একজন পুলিশ রাস্তায় এক রিকশাওয়ালাকে মাটিতে গড়াগড়ি দেওয়াচ্ছেন। যা কিনা অত্যন্ত অমানবিক ও মানবাধিকারবিরোধী কাজ। ঘটনাটি জামালপুরের কথাকলি মার্কেট এলাকায় ঘটে। রিকশাওয়ালার দোষ লকডাউনের মধ্যে রিকশা নিয়ে বের হওয়া। আবার তার পরদিনই আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, যশোরের মনিরামপুরে এসিল্যান্ড সাইয়েমা হাসান তিন বৃদ্ধকে কানে ধরিয়ে উঠবস করান এবং এর ভিডিও করেন, ছবি তোলেন। পরে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার সহযোগীরাই আপলোড করে এই কাজকে সমর্থন করেন। একই দিনে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার এসিল্যান্ড ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিদা আক্তার তার পরিচালনায় ভ্রাম্যমাণ আদালত চলাকালে জনসাধারণের ওপর লাঠিচার্জ ও ধাওয়া করেন। এরকম বেশ কিছু ঘটনা সেসময় সামাজিক মাধ্যমে প্রায়ই সামনে আসছিলো। আবার, নারায়ণগঞ্জ থেকে করোনা সারাদেশে ছড়ানোর বিভিন্ন নিউজ দেখা যায় গণমাধ্যমগুলোতে। নারায়ণগঞ্জ থেকে সরকারের অব্যবস্থাপনা, তথ্য লুকোচুরির কারণেই নারায়ণগঞ্জে কর্মরত দেশের নানা প্রান্তের মানুষ লকডাউন অমান্য করে নানা প্রক্রিয়ায় নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে নিজ নিজ আবাসস্থলে যান। এই অবস্থাকে উপলব্ধি না করে, উপযুক্ত ব্যবস্থা পরিকল্পনা না নিয়ে, গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে এই লোকগুলোকে দোষারোপ করা হতে থাকে। আবারও আগের প্রক্রিয়ায় নানা ধরনের শ্রেণি-বিদ্বেষমূলক আক্রমণ চলে। এছাড়াও ঈদসহ নানা ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই ধরনের আলাপ তো চালুই ছিলো। এবং, প্রত্যেক ক্ষেত্রেই সরকারপন্থি এক্টিভিস্টরা এসব কাজে জড়িত ছিলো। যখন রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব ছিলো প্রত্যেক নাগরিকের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা, জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করা, তখন রাষ্ট্র কেবল লুটপাট আর নির্যাতন করে গেছে। আর দিনশেষে তার দোষ দেওয়া হয়েছে খোদ ভিক্টিম জনতাকেই।

মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা

বাংলাদেশে করোনা মহামারি শুরু হবার এক বছর পর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ সময়টুকুতে সরকারি হিসাবমতে করোনার আবার নতুন প্রকোপ দেখা যায়। যা অনেকের মতেই আগের থেকে ভয়াবহ। এই অবস্থায় ৩ এপ্রিলে ৭ দিনের জন্য ৫ এপ্রিল থেকে দ্বিতীয়বারের মতো লকডাউন ঘোষণা করা হয়। তার দু’দিন আগে, ১ এপ্রিল মেডিকেল সায়েন্স পড়তে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়। এই ভর্তি পরীক্ষায় স্বাভাবিকভাবেই প্রচুর মানুষ হয়, প্রচুর ভিড় হয়। এমন একটা পরিস্থিতিতে এই পরীক্ষা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা কী ছিলো? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরীক্ষার হলগুলোতেও যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি। পরীক্ষার্থীদের স্যানিটাইজ করা, শরীরের তাপমাত্রা চেক করা ইত্যাদি কোনো স্বাস্থ্যব্যবস্থা মানা হয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু, এই সব অব্যবস্থাপনা, জনস্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলামূলক পলিসির বদলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে আলাপ তোলা হয় অভিভাবকদের সংখ্যা নিয়ে। পরীক্ষার্থীদের সাথে কেন অভিভাবক যায়, কেন তারা ভিড় করে, কেন তারা একের অধিক সংখ্যক যান – ইত্যাদি নানা প্রশ্ন তুলে সরকারের দায়িত্বহীনতাকে আড়াল করার চেষ্টা চলে। অথচ এই সব প্রশ্নই হাস্যকর। এত বড়, এত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় কেন কোনো অভিভাবক যাবে না? আর ভিড় যে হবে, তা কি প্রশাসন জানতো না? এটা মাথায় রেখেই কি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত না? যাতায়াতের ঝামেলা, অভিভাবকদের উদ্বেগ, করোনা পরিস্থিতির ভয়, পরীক্ষা কেন্দ্রের অধিক দূরত্ব – এতসব প্র্যাকটিক্যাল ও যৌক্তিক কারণ বাদ দিলেও স্রেফ মানসিক ভরসার জন্যও অভিভাবকরা সন্তানের সাথে পরীক্ষা কেন্দ্রে যায়। এই পরীক্ষা কেবল ছেলেমেয়েদের পরীক্ষাই নয়, বরঞ্চ অনেক পরিবারের স্বপ্ন, পরিশ্রমের ব্যাপারও এতে জড়িত। অথচ, এই সময়ে সরকারের অবহেলা, দুর্নীতি, অক্ষমতা আড়াল করতে খুবই অযৌক্তিকভাবে অভিভাবককে দোষ দেওয়া হচ্ছে।

এই লেখাটিতে কেবল কয়েকটি ঘটনার কথা আছে। কিন্ত সারাবছর প্রায় সব প্রাসঙ্গিক ইস্যুতেই এই স্টেট স্পন্সর্ড ভিক্টিম ব্লেইমিং চালানো হয়। সরকারের যাবতীয় উন্নয়নের ফাঁকিবাজি বুলি, যাবতীয় ডিজিটাল বাংলাদেশের গলাবাজি যখন কাজ করে না, তখন বলির পাঁঠা হিসেবে বেছে নেয়া হয় স্বয়ং নাগরিককে। এই সময়ে এসে আমাদের ভাবা উচিত, আমরা কি আসলেই সরকারের দোষারোপ মেকানিজমে মগজ বন্ধক দিবো? আমরা কি সরকারের এইসব সীমাহীন বেসাতি মেনে নিয়ে নিজেরা মরতে থাকবো? নাকি নিজেদের অধিকার আদায়ে সরকারের গণবিরোধিতা জোরদার প্রশ্নের সম্মুখীন করবো? যারা আমাদেরকে নিয়মিত সচেতন হতে বলে, তাদের ব্যাপারেই সচেতন হলেই চিন্তা আরও মুক্ত হয়, দৃষ্টি আরও ভিতরে প্রবেশ করতে পারে, প্রকৃত অবস্থা দেখা যায়। তাই, সচেতনতার নামে অচেতনতা আর দোষারোপের এই রাষ্ট্রীয় জারিজুরি উন্মোচন করতে হবে।

সুবিনয় মুস্তফী ইরন

সুবিনয় মুস্তফী ইরন শিক্ষার্থী ও অরাজপন্থী অ্যাক্টিভিস্ট। উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ শেষ করেছেন, ইনজিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি স্কুল এন্ড কলেজে। একইসাথে পেশায় তিনি গ্রাফিক ডিজাইনারও। এর পাশাপাশি তিনি চিলড্রেন'স ফিল্ম সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত। ২০১৮ সালে গড়ে ওঠা নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনেও অংশ নিয়েছিলেন।