অরাজ
আর্টওয়ার্ক: বিগ ডাটা শিল্পী: জাজা গানবল্ট সূত্র: সাৎসি আর্ট
প্রচ্ছদ » সভ্যতার অর্থ কি কেউ জানে?

সভ্যতার অর্থ কি কেউ জানে?

শহিদুল ইসলাম

এক
সভ্যতা নিয়ে বিতর্কের আর শেষ হল না। নতুন করে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সম্প্রতি আবার সে বির্তক সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে মানবস্বার্থ-কেন্দ্রিক বিশ্বভাবনা নিয়ে, যা মানুষকে করে তুলছে যান্ত্রিক, যুদ্ধবাজ এবং প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন। সভ্যতার উষালগ্নে রোমান কবি ওভিড ( ৪৩ খৃষ্টপূর্ব-১৭ খৃষ্টাব্দ) সভ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তাঁর বিখ্যাত ১২,০০০ লাইনের Metamorphosis কবিতায়—

Earth…had better things to offer…crops without cultivation,
fruit on the bough,honey in the hollow oak.
No one tore the ground with ploughshares
or parcelled out the land
or swept the sea with dipping oars—
the shore was the world’s end.
Clever human nature, victim of your inventions,
disastrously creative,
why cordon cities with towered walls?
Why arm for war?”

জে. বি. বিউরি
(১৮৬১-১৯২৭)

১৮৬০ সালে মাইকেল মধুসূধন দত্ত কলকাতায় ইংরেজি শিক্ষিত বাবু সম্প্রদায়ের উচ্ছৃঙ্খলতা লক্ষ্য করে লিখেছিলেন একটি ব্যঙ্গ নাটক একেই কি বলে সভ্যতা?। মানুষের স্বভাবগত সত্তার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা সভ্যতার অন্যতম একটি পদক্ষেপ। তাই ১৯১৪ সালে প্রখ্যাত ইতিহাসবিজ্ঞানী জে. বি. বিউরি বলেন—

যদি মানুষের কোন প্রাকৃতিক অধিকার বলে কিছু থেকে থাকে তাহলে নিজের জীবন বাঁচানো এবং সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে জীবনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা অবশ্যই তার মধ্যে পড়ে। তবু মানবসমাজ তার সদস্যদের এই উভয় অধিকারের ওপর বাধানিষেধ আরোপ করেছে। অন্যের অধিকারে থাকা খাবার না খাওয়ার জন্য একজন অভুক্ত মানুষের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বিভিন্ন আইন ও প্রসার সাহায্যে অবাধ যৌনসম্ভোগের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। (জে.বি. বিউরি, ১৯১৩:১২)

১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথ লেখেন সভ্যতার সংকট । ইংরেজ সভ্যতার ওপর তাঁর ছিল অগাধ বিশ্বাস। তিনি মনে করতেন ইংরেজি সভ্যতা একদিন সারাবিশ্বকে আলোচিত করবে। কিন্তু তাঁর সে বিশ্বাস কি করে হারালেন সে কথা তিনি আমাদের জানালেন উক্ত প্রবন্ধে। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯৪১:৭৩-৭৩৮)। ১৯৩০ সালে প্রকাশিত হয় সিগমন্ড ফ্রয়েডের বিখ্যাত প্রবন্ধ সংকলন Civilization and Its Discontents। তাঁর মতে মানুষের কিছু প্রবৃত্তি পরিবর্তনের অতীত। যেমন যৌনতা ও কর্তৃত্বের  বিরুদ্ধে তার ‘না’ বলার প্রবণতা। ব্যক্তি স্বাধীনতা মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষের তৈরি অপ্রাকৃতিক আইন-কানুনের সঙ্গে তার বিরোধ উপস্থিত হয়। উপর্যুক্ত দুটি আদিম প্রবৃত্তি সভ্যতা আইন তৈরি করে দমন করার চেষ্টা করে। এতে মানুষের সহজাত ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্বিত হয়। তিনি বলেন, “Civilization is built on erotic energy that has been blocked, concentrated, accumulated and reduced human freedom.”

বইটির ভূমিকায় বলা হয়—

…This process, argues Freud, is an inherent quality of civilization that gives rise the perpetual feelings of discontents among its citizens.” (Freud:1930:1)

আজকের নবীন নৃতত্ত্ববিদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন “সভ্যতার অর্থ কি?” বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি ব্যাপক আলোচনা ও গবেষণা চলছে। আমরা এতদিন জেনে এসেছি যে, মানুষ যেদিন নিজের খাদ্য নিজেই উৎপন্ন করতে এবং কতিপয় পশুকে গৃহপালন করতে শিখল, সেদিনই বর্তমান সভ্যতার সূচনা। কিন্তু এ বিশ্বকে চরমভাবে আঘাত করে ১৯৯৯ সালের  প্রথমে Discover Magazine-এ বিশ্ববিখ্যাত নৃবিজ্ঞানী ও ক্রমবিকাশ উদ্ভিদতত্ত্ববিদ জারেড ডাইমন্ড যে লেখাটি প্রকাশ করেন, তা সারা বিশ্বে প্রবল আলোড়ন তোলে। প্রবন্ধটির নাম,  Agriculture: The worst Mistake in the History of Man. তিনি বলেন যে কৃষি আবিষ্কার ও পশুর গৃহপালন মানুষের সবচেয়ে বড় ভুল, সেখান থেকে মানুষ কোনদিনই মুক্তি পাবে না। ২০১০ সালে তাঁর লেখা, Guns, Germs and Steel: The Fate of Human Society বইটি পুলিংকার পুরঙ্কার পায়। বইতে তিনি বলেন—

Human gatherer practiced the most successful and largest lasting life style in human history….. In contrast, we are still struggling with the mess into which agriculture has trumbled us and it is unclear whether we can solve it.Ó (Christopher Ryan and Cakilda Jetha (2010:228)

কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো রচনা এবং ‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ সংক্রান্ত গ্রন্থে সভ্যতার সূচনার ওপর আমাদের সৃষ্টি ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে আমরা আজ কিভাবে পুঁজিবাদী সমাজে পৌঁছলাম, তার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। মানুষ কতটা সামাজিক ও কতটা প্রাকৃতিক এ নিয়ে বেশ মতবিরোধ আছে। এরিস্টটল বলেছিলেন যে, মানুষ একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রাণী। মানুষ যে একটি সামাজিক প্রাণী এ নিয়ে আজ কোনো সন্দেহ নেই। এটাতো সমাজ সৃষ্টির পরের কথা। তার আগে যখন সভ্যতার সূচনা হয়নি, তখনকার মানুষকে কি সামাজিক বলা যাবে? তাহলে প্রশ্ন আসে সমাজ কখন, কবে ও কেন গড়ে উঠেছিল? তাই জারেড ডাইমল্ড প্রশ্ন তুলেছেন, “আমাদের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলল কে?” সেই সঙ্গে তাঁর কথায়, “মানুষ একই সঙ্গে একটি প্রাণী: a species of big mammal”। এই পার্থক্য অত্যন্ত আগ্রহোদ্দীপক ঘটনা। এটা উপলব্ধি করতে আমাদের দীর্ঘ সময় ও পরিশ্রম করতে হয়েছে। মানুষও অন্যান্য প্রাণীর মতো একটা প্রাণী। কিন্তু মানুষের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীর পার্থক্য রচিত হল কি করে? নিশ্চয়ই মানুষের এমন কিছু গুণ আছে, যা তাকে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করে তুলেছে এবং আমরা

আর্ট্ওয়ার্ক: দ্য পা্ওয়ার অব ট্রুথ সিরিজ
সূত্র: চাইনা ডেইলি

অন্যান্য পশুপ্রাণীকে আমাদের থেকে আলাদা করতে শিখেছি। আমরা শিখেছি পশুর ‘পশুত্ব’ এবং মানুষের ‘মনুষ্যত্ব’ আলাদা। মানুষের মধ্যে যেমন পশুত্ব নাই, তেমনি পশুর মধ্যে কোন মানবীয় গুণাবলী নাই। যে পার্থক্য মানুষ ও পশুর মধ্যে এই বিভাজন সৃষ্টি করেছে, তা হল মানুষের বুদ্ধি আছে, চিন্তা করার ক্ষমতা আছে, পশুর তা নেই। সেই চিন্তা ও বুদ্ধির শক্তিতে মানুষ কৃষি সভ্যতার পর নিজেকে অন্যান্য পশুর থেকে পার্থক্য বৃদ্ধি করে চলেছে। আমাদের ‘উন্নতি’ আজ এতদূরে পৌঁছেছে যে, মানুষ আজ নিজেকে একটা প্রাণী ভাবতে পারে না। ভাবতে পারে না যে, সে প্রকৃতিরই এক সামান্য অংশ মাত্র। তাছাড়া বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন অন্যান্য প্রাণীর অনু-পরমাণু ও জিনস মানুষের মতই। আঠারো শতকেই প্রমাণিত হয়েছিল যে, শিম্পাঞ্জীর সঙ্গে মানুষের পার্থক্য খুবই কম। কিন্তু সেই সামান্য পার্থক্যই মানুষকে এক বিশেষ প্রাণীতে পরিণত করেছে। হাতিয়ার তৈরি, ভাষার সৃষ্টি, সংস্কৃতি নির্মাণ, পরিধীয় বস্ত্রাদির সঙ্গে মানুষসহ অন্যান্য প্রজাতির গণহত্যার মাধ্যমে আমরা নিজেকে এক আলাদা বিশেষ প্রাণীতে পরিণত করতে পেরেছি।

দুই
ভূতাত্ত্বিক টাইম স্কেল অনুযায়ী আমরা ‘মানুষ’, ক্রোম্যাগনন ‘মানুষ’ যে সময়ে বাস করছি, তার নাম ‘হলোসিন’ যুগ। প্যালিওলিথিক বরফ যুগ শেষ হয় ১২,০০০ বছর আগে। সেটা সর্বশেষ বরফ যুগ। তারপর তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। বর্তমানের ‘হলোসিন’ যুগের শুরু হয়, যেটা ছিল পঞ্চম বরফ যুগ। আমরা ষষ্ঠ বরফ যুগের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে সভ্যতার শুরু হয় আজ থেকে ১০,০০০ বছর আগে। অনেক স্থানে পুরনো শিকারি যুগের সমাজ কাঠামো বিদ্যমান থাকে। এমনকি আজও পৃথিবীর অনেক স্থানে মানুষ শিকারি যুগে বাস করছে। তারা কৃষিকাজ ও পশুর গৃহপালনের মত কষ্টকর কাজে লিপ্ত হতে রাজী নয়। প্রকৃতির দান দু’হাত ভরে গ্রহণ করে তারা মহাসুখে আছে। ১৮ ও ১৯ শতকের মাঝামাঝি শিল্প বিপ্লব যখন শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে, তখন পৃথিবীর লোক সংখ্যা ছিল এক বিলিয়ন। হোমো স্যাপিয়ান্সের আবির্ভাব প্রায় ৭০/৮০ হাজার বছর আগে। তখন থেকে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে মানুষের সংখ্যা এক বিলিয়নে পৌঁছেছিল। ২০০০ সালে সে সংখ্যা ছয় বিলিয়ন অতিক্রম করে। শিল্প বিপ্লব মানুষের উৎপাদন শক্তি এতটা বৃদ্ধি করে যে মাত্র ১৭০ বছরে পৃথিবীর লোকসংখ্যা ৫ বিলিয়ন স্পর্শ করে। মাত্র ১১ বছরে পৃথিবীর লোক সংখ্যা এক বিলিয়ন বৃদ্ধি পায়। পৃথিবীর জনসংখ্যার ঘড়ি অনুযায়ী ২০১৭ সালে এ সংখ্যা ৭.৫ বিলিয়নে পৌঁছে।

প্রবন্ধ পাঠের সময়ে লেখক

জনসংখ্যার ঘড়ি অনুযায়ী ২০১৭ সালের ফ্রেব্রুয়ারি মাসে প্রতিদিন ৮৬,৫০০ শিশু জন্মগ্রহণ করছে যা ক্রমবর্ধমান। সে বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৬০ লক্ষেরও বেশি যা ক্রমবর্ধমান। ফলে এই বর্ধিত মানুষের জীবন ধারণের প্রয়োজনে প্রকৃতির ওপর চাপ বাড়তেই আছে— বাড়তেই থাকবে। বিশেষ করে ১৯৫০ সালের পর। কারণ প্রযুক্তির উন্নয়ন রকেটের গতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে। আন্তর্জাতিক ভূতাত্ত্বিক সোসাইটি একটি নতুন যুগের শুরু বলে ঘোষণা দিয়েছে। তাহল ‘অ্যানথ্রোপোসিন যুগ’ (Anthropocene Age)- মানুষের যুগ। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর খাওয়া-পরা ও জীবন ধারণের ব্যবস্থা মানুষকেই করতে হবে। শিল্প বিপ্লবের ফলে মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির উৎপাদন যেমন বেড়েছে, তার চেয়েও বেশি বেড়েছে অপ্রয়োজনীয় বিলাস দ্রব্যের উৎপাদন। সেই সঙ্গে বাড়ছে মেগাসিটির সংখ্যা ও শিল্পকলকারখানা। সেসব কলকারখানা সচল রাখতে বাড়ছে শক্তির প্রয়োজন। সে শক্তিও আসছে প্রকৃতি থেকে। প্রকৃতির ওপর আমাদের নির্ভরতা যেমন বাড়ছে, প্রকৃতির ভান্ডারও তেমনি শূণ্য হয়ে পড়ছে। এই বিপুল জনগোষ্ঠির মাথা গোঁজার ঠাঁই দরকার। তার জন্য দরকার জমি। জঙ্গল কাটো, নদ-নদী-খাল-বিল ভরাট করো। একই পরিমাণ জমিতে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। মাটিতে মেশাও নাইট্রোজেন, ফসফরাস। কীট পতঙ্গের আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষা করতে হবে। কীটনাশক রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করো। আমাদের লজ্জা নিবারণ করতে হবে। প্রাকৃতিক সূতো দিয়ে তা সম্ভব নয়। তাই মানুষের তৈরি অপ্রাকৃতিক সূতোর ব্যবহার বাড়াও। পৃথিবীর শপিং মলগুলিতে সে কাপড় উপছে পড়ছে।

তিন
সব ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী মানুষ স্রষ্ঠার শ্রেষ্ঠ প্রাণী এবং পৃথিবীর মালিক তারাই। সতেরো শতকে ফ্রান্সিস বেকন ও রেনে দেকার্ত বলেছিলেন যে, মানুষ তার বুদ্ধিশক্তি ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে প্রকৃতির মালিকে পরিণত হতে পারে। তাদের পথ অনুসরণ করে মানুষ আজ প্রকৃতির ওপর এতটাই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে যে, মানুষ ভাবতেই পারে সে প্রকৃতির মালিক। কিন্তু সত্য হল যে, মানুষ কখনই প্রকৃতির মালিক হতে পারে না। মানুষের নির্দেশে সূর্য প্রতিদিন পশ্চিম দিগন্তে উঠবে না এবং পূর্ব দিগন্তে ডুববে না। মানুষ কি কখনও Law of Conservation of Energy ও Mass এর বিরুদ্ধে গিয়ে এক মিলিগ্রাম শক্তি ও বস্তু উৎপাদন করতে পারবে? মানুষ কি প্রাকৃতিক ক্রমবিকাশের ধারা বন্ধ করতে পারবে? প্রকৃতির যে বিশাল ব্যাপ্তি মানুষ তার একটা ক্ষুদ্র যোগসূত্র মাত্র। তার বেশি নয়। সতের শতকেই ব্লেইস পাসকেল (১৬২৩-১৬৬২) বলেছিলেন, ‘‘Humankind is a very small link in the immense web of nature, it is the only one that through for the earth and will be able to transform it for the better or for worse.’’। আজ বোধহয় এ প্রশ্ন তোলার সময় হয়ে গেছে: মানুষ কি পৃথিবীকে ভালো পথে নিয়ে চলেছে, না অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে?

দ্বিতীয় প্রধান পরিবর্তন ঘটে মাত্র সেদিন, যখন পেটুক ধনী ও মধ্যবিত্তশ্রেনীর বিস্ফোরণ ঘটে। তাদের অন্তহীন ক্ষুধা, ভোগবাদ ও বিলাসিতা বাজারের বিকাশ ত্বরান্বিত করেছে। উদাহরণ, শিল্প-বিপ্লবের মাঝামাঝি সময়ে একজন আমেরিকান যখন বাজারে যেত, বাজারের আয়তন ছিল ১৫০ বর্গমিটার এবং তার সামনে সর্বোচ্চ ৩০০ টি দ্রব্যের সম্ভার সাজানো থাকতো। কিন্তু ২০০০ সালে সে বাজারের (শপিং মল) আয়তন দাঁড়ায় ১.৫ মিলিয়ন বর্গমিটার এবং তার সামনে সাজানো থাকে এক মিলিয়ন মনোহারি জিনিসের ভান্ডার। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সেগুলি অপ্রয়োজীয়। মার্ক টোয়াইন (১৮৩৫-১৯১০) লিখেছিলেন, ‘‘Civilization is a limitless multiplication of unnecessary necessities’’। অপ্রয়োজীয় জিনিসের পুনরুৎপাদনের বাসই হল সভ্যতা।

আর্টওয়ার্ক: বার্নিং আর্থ
সূত্র: পিন্টারেস্ট

এই সীমাহীন অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির উৎপাদন প্রকৃতির ওপর বিরুপ প্রভাব ফেলছে। যাদের লোভ-লালসার সীমা নেই, যাদের ক্ষুধা কখনো পূর্ণ হয় না, হবে না। সেই মুষ্টিমেয় ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অসীম ক্ষুধা নিবৃত্ত করার জন্য পৃথিবী অতি দ্রুত তার উৎপাদনশীল জমি, উদ্ভিদ ও প্রাণীজগৎ, বৈচিত্র্যময় জলবায়ু, পানি ও বিশুদ্ধ বায়ু হারাচ্ছে। একদিকে যেমন মেরুপ্রান্তের হিমবাহগুলো গলতে শুরু করেছে, অন্যদিকে তেমনি বৃষ্টির অভাবে বিশ্বের উর্বর জমিগুলো ক্রমশ মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। প্রতিবছর শক্তির চাহিদা শতকরা ২ভাগ বাড়ছে। মানুষ মরিয়া হয়ে জীবাশ্ম জ্বালানির ভান্ডার শেষ করে দিচ্ছে। সেই জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে প্রতিবছর মিলিয়ন টন CO2 বাতাসে মিশে যাচ্ছে। ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে। ১৯৬২ সালে র‌্যাচেল ভারসন ভয়ঙ্কর জলবায়ু সংক্রান্ত বিপদ সম্পর্কে পৃথিবীকে সাবধান করে দেন। তারপর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গ্রিন হাউজ গ্যাস কমানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে আসছে। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং লল্ডন যাদুঘরের পরিচালক প্রফেসর ক্রিস রিপ্লে বলেন, “আমরা আগুন নিয়ে খেলছি। আমরা যে প্রবল বেপরোয়া জীবনযাপন করছি, এর জন্য হয়তো আমাদের অনুশোচনা করতে হবে যদি অবস্থার ওপর আমাদের কোন নিয়ন্ত্রন না থাকে”। বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতবাণী করেছেন যে মানুষ যদি তাদের জীবনযাত্রা প্রণালী পরিবর্তন না করে, তাহলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২১ শতকের শেষে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারে। স্টানফোর্ড, ক্রিস্টন ও বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন যে, জীবনবিনাশী যুগ আসছে এবং সে পর্বে প্রথম বিলুপ্ত হবে মানুষ। ৬.৫ কোটি বছর আগে পঞ্চম জীবনবিধ্বংসী পটে অন্যসব প্রাণীর সঙ্গে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছিল।

চার
জারেড ডাইমন্ডের উপর্যুক্ত প্রবন্ধের কথায় আসি। ডায়মন্ড বলেন, “না, আমরা কতিপয় উদ্ভিদ ও পশুকে পোষ মানাই নি। বরং আমরাই উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের সঙ্গে নিজেকে পোষ মানিয়েছি।” ফলে মানুষ অন্যান্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর সঙ্গে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। কৃষি আবিষ্কারের আগের মানুষের সঙ্গে অন্যান্য পশুর কোন প্রভেদ ছিল না। নিজেদের মধ্যেও কোনো ভেদাভেদ ছিল না। কৃষি ও উদ্ভিদ পোষ মানানোর সঙ্গে সঙ্গে পূর্বের সেই প্রাকৃতিক সাম্য বিনষ্ট হতে শুরু হয়। কৃষি আদিম সাম্যবাদী সমাজ ধ্বংস করে এবং কৃষি জমিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে সমাজ। সে সমাজে গভীর শ্রেণীর বিভাজন সৃষ্টি হয়, কৃষি জমি রক্ষনাবেক্ষণে এবং পশুর সেবা যত্নের ফলে মানুষের জীবনে অবসর হারিয়ে যেতে থাকে এবং পূর্বে যে উদ্ভিদ আপনিই জন্মাত (বন্য) এবং তা খেয়ে মানুষ প্রানে বেঁচে থাকতো, সেগুলো যখন মানুষ যত্ন সহকারে রোপন করতে শুরু করে, তার পিছনে মানুষকে সারাক্ষণ সজাগ থাকতে হয় যা আগে হতো না। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সে ফসলক্ষেত বাঁচাতে মানুষকে আজকের মতই প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে হয়। ফলে মানুষের পরিশ্রম বেড়ে যায়। অবসর কমে যায়। পুষ্টিহীনতা, দুর্ভিক্ষ ও মহামারির আঘাতে অসুখ-বিসুখে মানুষের শরীর জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। শিকারি যুগে মানুষ খাদ্য মজুদ করার চিন্তাও করতো না। তার কোনো উপায়ও ছিল না। গুদাম ছিল না। প্রতিদিন তিন/চার ঘন্টা পরিশ্রম করে যা খাবার সংগ্রহ করতো, সেই দিনই সবাই মিলে তা খেয়ে শেষ করতো। সেখানে রাজা-বাদশা-জমিদার-সুদখোর, ব্যবসায়ী-ব্যাংক-লুটেরা ধনি শ্রেণী ছিল না। অন্যের উৎপাদিত খাদ্য খেয়ে পেট মোটা সামাজিক পরাশ্রয়ী বা পরজীবী মানুষের অস্তিত্ব ছিল না। শ্রেণী-বৈষম্যহীন সাম্যবাদী সমাজ ছিল। পুঁজিবাদী অর্থনীতির পয়গম্বর এডাম স্মীথ (১৭২৩-১৭৯০) তাঁর Lectures on Jurisprudence বইতে লেখেন, ‘In a nation of hunters there is properly no goverment at all… [They] have agreed among themselves to keep together for their mutual safety, but they have no authority one over another.” (Christopher Rayan and Carilda Jetha (2010:230)। কৃষির আবিষ্কার এরকম পরজীবী শ্রেণীর জন্ম দেয়। তারা অর্ধভুক্ত ও রোগাক্রান্ত উৎপাদক শ্রেণীর ওপর অধিপত্য বিস্তার করে। পুষ্টিবৈষম্য কৃষি সমাজের সৃষ্টি যা আজ ভয়স্কর বৈশ্বিক আকার ধারণ করেছে।

জারেড ডায়ামন্ড

কৃষি আবিষ্কার নারীর ওপর পুরুষতন্ত্রের জোয়াল চাপিয়ে দেয়, যা শিকারি যুগে ছিল না। কৃষি কাজের জন্য বেশি মানুষের প্রয়োজন। সেই বেশি বেশি মানুষ সরবরাহ করতে নারীর শরীর অকালেই ভেঙ্গে পড়ে— তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন সমাজে তারা অপাঙ্গশ্রেয় হয়ে পড়ে। ক্রিস্টেফার রায়ান ও ক্যাসিলডা জেথা তাঁদের Sex at Dawn (২০১০) বইতে এক বিবাহ প্রথার উন্মেষের কারণ নির্দেশ করেছেন। কৃষি সমাজের উন্মেষের সাথে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উন্মেষ ঘটে এবং নারীও পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়। এর পিছনে কৃষি অর্থনীতির চাপ কাজ করে। শিকারি যুগে অন্যান্য পশুপ্রাণীর মত মানুষও ছিল বহুগামী। সেটাই প্রাকৃতিক। এতে সন্তানের পিতৃত্ব নির্ধারণ করা সম্ভব ছিল না। তাই যখন ব্যক্তিগত সম্পত্তির সৃষ্টি হয়, তখন সে সম্পত্তি প্রকৃত উত্তরাধিকারের হাতে অর্পণ করা জরুরি হয়ে পড়ে। ফলে একগামী (Monogamous) বিবাহ কাঠামোর সৃষ্টি হয়। এভাবে কৃষি আবিস্কার শ্রেণীবিভক্তির সৃষ্টি করে; নারীকে পুরুষের অধীনস্ত করে।

কৃষির উদ্ভব মানুষের স্বাধীনতা ও অবসর সময় কেড়ে নেয়। কৃষি ফার্ম, শিল্পকারকানা এমনকি ওয়াল স্ট্রিটের ভদ্রলোকদের চেয়ে শিকারি যুগের মানুষ অনেক বেশি স্বাধীনতা ও অবসর সময় উপভোগ করতো।

শিকারি যুগে মানুষের মুখে ‘কাজ’ বলে কোনো শব্দ ছিল না। যেমন ছিল না ‘সুখ’ বা অসুখের’ কথা। শিকার তাদের কাছে ছিল একটা খেলা। জীবন বাঁচানোর খেলা। শিকার করতে তাদের বেশি শ্রমের প্রয়োজন পড়ত না। সবাই মিলে দক্ষতার সঙ্গে সে খেলায় মেতে উঠতো। খিধে পেলেই শিকারের প্রয়োজন দেখা দেয়। পেট ভর্তি থাকলে তাদের অফুরন্ত সময়। বুশম্যানকে জিজ্ঞাসা করলে বলে, “কৃষিকাজ করবো কেন? বন্য ফলমূল এত যে কৃষিকাজ করার জন্য সময়ের অপচয় করার কোনো অর্থ হয় না।”

কৃষিকাজ আবিষ্কারের পর কৃষি জমির দেখভালের জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রমের প্রয়োজন পড়ে। ফসল পাহারা দেয়া, পোকামাকড় থেকে ফসল রক্ষা করার জন্য মানুষকে সব সময় সতর্ক থাকতে হয়। গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে মারামারি শুরু হয়। কিন্তু প্রাক-কৃষি যুগের মানুষ জমির জন্য লড়াই করতো না। কারণ তখন জমির কোনো মালিক ছিল না। তাদের সুখের সীমা ছিল না।

কম করে হলেও ১৯০ হাজার বছর মানুষ কৃষিকাজ ছাড়াই তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। নৃতত্ত্ববিদ ভ্যানিয়েল কুইনের মতে ‘শিকারি সংগ্রহকারী অর্থনীতি’ অনেক বেশি শক্তিশালী ((Sustainable)। কিন্তু গত মাত্র ১০ হাজার বছরে সেই কৃষিনির্ভর সভ্যতা বিভিন্ন স্তর পার হয়ে আজ অমানবিক গণতান্ত্রিক সভ্যতার জন্ম দিয়েছে। এই সভ্যতার আগে মানববান্ধব পরিবেশ আজ ধ্বংসের সম্মুখীন।

পাঁচ
বিগত সত্তর হাজার বছরের মানবজাতির ইতিহাস তুলে ধরার পর য়ুভাল নোয়া হারারি তাঁর বিখ্যাত বই Sapiens: A Short History of Mankind এর উপসংহারটি উদ্ধৃত না করে পারলাম না। সত্তর হাজার বছর আগে আফ্রিকা মহাদেশের এক প্রান্তে হোমো স্যাপিয়েন্স কোনোভাবে জীবনযাপন করছিল। গত দশ হাজার বছরে তারা সমগ্র পৃথিবীর মালিকে পরিণত হয়েছে। সেই সঙ্গে জলবায়ু ও পরিবেশের জন্য ভয়ঙ্কর এক প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। তারা অমরত্ব লাভ করতে চলেছে। ঈশ্বরের স্থানটি তাদের প্রায় দখলে চলে এসেছে। একই সঙ্গে সৃষ্টি ও ধ্বংসের ঐশ্বরিক ক্ষমতা লাভ করতে চলেছে। দুঃখের বিষয় স্যাপিয়েন্সদের রাজত্ব খর্ব করার মত কিছু সৃষ্টি করতে পারেনি। আমরা আমাদের পারিপার্শিকতার ওপর আধিপত্য স্থাপন করেছি, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করেছি, শহর-নগর-বন্দর-সাম্রাজ্য স্থাপন করেছি এবং বিশ্বময় এক বাজার গড়ে তুলেছি। কিন্তু আমরা কি পৃথিবী থেকে দুঃখ-কষ্ট দূর করতে পেরেছি। মানুষের শক্তি বেড়েছে একথা ঠিক। কিন্তু ব্যক্তি মানুষের প্রাকৃতিক চরিত্র উন্নতি করতে ব্যর্থ হয়েছি এবং অন্য প্রাণীর দুঃখ-দুর্দশা বাড়িয়ে তুলেছি।

হারারি

বিগত কয়েক দশকে দুর্ভিক্ষ, প্লেগ ও যুদ্ধ কমিয়ে এনেছি। এতে মানুষের কিছু বৈষয়িক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য প্রাণ ও পরিবেশ দ্রুত আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। মানুষের অসীম সৃজনশীলতা সত্ত্বেও আমরা আজও আমাদের গন্তব্যস্থান নির্ণয় করতে পারিনি। আমরা আগের মতই অতৃপ্ত রয়ে গেছি। আমরা শালতি নৌকা থেকে রকেটের যুগে প্রবেশ করেছি। কিন্তু কেউ জানে না আমরা কোথায় চলেছি। আমরা আগের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী কিন্তু সেই শক্তি নিয়ে আমরা কি করবো, সে সম্পর্কে আমাদের সামান্যই ধারণা আছে। তার চেয়েও খারাপ হল মানুষ আজ অনেক বেশি দায়িত্বজ্ঞানহীন। পদার্থ বিজ্ঞানের কতিপয় সূত্রের সাহায্যে আমরা নিজেকে ঈশ্বর ভাবতে শুরু করেছি। কিন্তু আমরা কারো কাছে দায়বদ্ধ নই। তার ফলে আমরা পৃথিবীর জন্য ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছি। আমরা নিজের আরাম-আয়েশ ও বিনোদন ছাড়া আর কিছু বুঝি না। তবুও আমরা তৃপ্ত নই।

এমনি অতৃপ্ত ও দায়িত্বজ্ঞানহীন ঈশ্বরের চাইতে আর কিছু কি বেশি ভয়ঙ্কর হতে পারে? সে জানে না সে কি চায়? (Harari, 2011:465)

লেখাটি শেষ করেছি। কিন্তু আজ ১৯ অক্টোবর, ২০১৮ সকালে ইন্টারনেটে হঠাৎ একটি লেখার প্রতি চোখ আঁটকে গেল। গত ১৫ অক্টোবর দি ডেইলি মেইল পত্রিকায় মার্ক প্রিগের লেখা There is no God and there are forms of intelligent life out there: Stephen Hawking’s final book reveals his answers to the big ‘Questions’ তিনি সদ্য প্রকাশিত স্টিফেন হকিং- Brief Answers to the Big Questions বইটির ওপর আলোকপাত করেছেন। সেখানে দশটি প্রশ্নের একটি হল “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা” (Artifical intelligent) কি আমাদের কর্মক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তাকে ছাড়িয়ে যাবে না? হকিং সাবধান করে বলেন যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা DNA’র সামান্য রদবদল আমাদের আয়ু বৃদ্ধি করবে; বুদ্ধি বাড়বে এবং অসুখ-বিসুখ হবে না। সৃষ্টি হবে নতুন এক ধরনের মানুষ ‘সুপারহিউম্যান’। সেই কৃত্রিম ‘সুপারহিউম্যান’ হয়তো একদিন পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে হোমো স্যাপিয়েন্সকে বিলুপ্ত করবে। তিনি আরো বলেন যে আইনের দ্বারা এই গবেষণা বন্ধ করার চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু তা ফলপ্রসু হবে বলে তিনি মনে করেন না। কারণ মানুষের কৌতূহলের সীমা নেই। বিজ্ঞান মানুষের মৃত্যুকে জয় করার পথে অনেকটা এগিয়েছে। তাই যদি কখনও হয় তাহলে পৃথিবীর সব প্রাণী, মানুষসহ সকল উদ্ভিদ জন্মগ্রহণ করবে আর মারা যাবে। কেবল ‘সুপারহিউম্যান’ জন্ম গ্রহণ করবে কিন্তু মারা যাবে না। তাহলে কিছুকাল পরে পৃথিবীর অবস্থা কি হবে?

চারিদিক থেকে সব সংবাদ আসছে, তাতে কেবল মানুষ নয়, সকল প্রাণ সম্পর্কেই শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বুদ্ধিমান মানুষ সভ্যতার সেই উষালগ্নে যে কৃষি সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল, তা আজ তার যৌক্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বুদ্ধি ও যুক্তির শক্তিতে মানুষ আজ পৃথিবীর জন্য ভয়ঙ্কর এক প্রাণীতে পরিণত হয়েছে।

মানুষ আজ দায়িত্বজ্ঞানহীন এক ঈশ্বরে পরিণত হতে চায়। আমার মনে হয় এটাই ‘সভ্যতার অর্থ’। সভ্যতা কেবল বাইরের খোলস, মানুষের অন্তর্নিহিত সত্তার কোন সদর্থক পরিবর্তন হয়নি। বরং শিকারি যুগের চাইতে মানুষ আজ অনেক মারমুখী, লোভী ও দানবীয়। কৃষি আবিষ্কার ব্যক্তিগত সম্পত্তির সৃষ্টি করে। ফলে মানুষের চরিত্রের ষড়রিপুর দু’টি ‘লোভ’ ও ‘মোহ’ সম্ভবত তার ওপরেই মানুষের চরিত্রে স্থান করে নেয়। লোভ ও মোহের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পত্তির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। কাজেই সভ্যতার অর্থ কি? এ প্রশ্নের উত্তর সময়ের সাথে পাল্টে যেতে পারে। এতক্ষণ আমি যেসব অর্থহীন কথা বললাম, তা বিগত দশ হাজার বছরের সমাজ পরিবর্তন ও বর্তমান বৈশ্বিক আস্থাকে সামনে রেখে; যেসব কথা কলমের ডগায় চলে এল। জানি না, এতে সভ্যতার অর্থের কোনো সুরাহা হল কি না?

তথ্যসূচী

Ovid, Amores, Book3, Translation—Ronald Wright in the book’ a short history of progress

Christopher Ryan and Cacilda Jetha, Sex at Dawn; The Prehistoric Origins of Modern Sexuality, Harpur, 2010.

Dawkins, R. The Selfish Genes, New York, Oxford University Press, 1976

Gowdy, J. (Edn.), Limited Wants, Unlimited Means: A Reader on Hunter Gatherer Economics and Environment, Island Press, Washington DC, 1998.

Harris, M. Cutural Materialism: The struggle for a Science of Culture, Vintage Books, New York, 1980.

Harari, Yuval Noah, Sapiens: A Brief History fo Mankind, Vintage Books, London, 2011.

Jarred, Diamond, Guns, Germs and Steel: The Fate of Human Society, W.W. Norton and Company, N. York, London, 1999,1997.

Jarred, Diamond. The Third Chimpanzee, A Seven stories press, 2014

Bury, J. B. A History of Freedom of Thought, Henry Holt & Company, New York and Williums and Norgali, London, 1913.

মাইকেল মধুসূধন দত্ত, ‘একেই কি বলে সভ্যতা’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সভ্যতার সংকট, রবীন্দ্র রচনাবলী, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ত্রয়োদশ খণ্ড, ১৯৯২।

Sigmund Freud (1930), Civilization and Its Discontents, Published by General Book

২০ অক্টোবর,২০১৮
মোহম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

সম্পাদকীয় নোট: বিশ্ব দর্শন দিবসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের আমন্ত্রণে ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর সিনেট ভবনে উপস্থাপিত প্রবন্ধ । অরাজে ঈষৎ পরিবর্ধিত রূপ প্রকাশিত হল।

 

শহিদুল ইসলাম

বাংলাদেশের যে মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবী জীবননিষ্ঠ মননের সদনুশীলনে আত্মনিয়োজিত, শহিদুল ইসলাম নিরলস চর্চার মধ্য দিয়ে নিজেকে সেই গোষ্ঠীর অন্যতম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে নিতে পেরেছেন। গত পাঁচ দশক ধরে তিনি লিখছেন। সমাজনীতি, রাষ্ট্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বিজ্ঞানমনস্কতা, শিক্ষা, শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে অনবরত লিখে চলেছেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।

তিনি স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন এক সমাজব্যবস্থার, অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থার যেখানে মানুষ পাবে মানুষের অধিকার। বিষয়গুলো নিয়ে তাঁর গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে। তিনি বিজ্ঞানের দর্শন নিয়েও গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করেন।

শহিদুল ইসলামের জন্ম ১৯৪০ সালে ১০ ফেব্রুয়ারি, পাবনার ঈশ্বরদীতে। তিনি সাঁড়া মাড়োয়ারি উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা, পাবনা এওয়ার্ড কলেজ থেকে আইএসসি, রাজশাহী কলেজ থেকে বিএসসি (অনার্স) এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করেন।

তিনি ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত রসায়ন বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষকদের একজন ছিলেন। ২০০০-২০০৩ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নবপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। ২০১৩-১৫ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু ইনস্টিটিউট অব লিবারেশন ওয়ার অ্যান্ড বাংলাদেশ স্টাডিজ এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। সম্পাদনা করেছেন 'সমাজ ও প্রগতি জার্নাল'।

তাঁর উল্লেখযোগ্য বই: শিক্ষাভাবনা, প্রসঙ্গ শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় ও স্বায়ত্তশাসন, আমরা কি ধরনের শিক্ষা চাই?, বিজ্ঞানের দর্শন, চিন্তার স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস, একাত্তরে বাংলাদেশের অভ্যুদয়, দেশভাগ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, জাতীয়তাবাদ: সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, সাম্প্রদায়িকতা রাষ্ট্র ও রাজনীতি, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ: মিথ ও বাস্তবতা, মৃত্যুহীন প্রাণ, শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধ।

২০১৩ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান।

বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি নিজকে নিয়োজিত করেছেন জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক নানা গবেষণায়।