অরাজ
আর্টওয়ার্ক: ডেথ এন্ড লাইফ শিল্পী: গুস্তাফ সূত্র: পিনটারেস্ট
প্রচ্ছদ » লরা স্পিনি।। জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটানো ১৯১৮’র স্প্যানিশ মহামারী

লরা স্পিনি।। জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটানো ১৯১৮’র স্প্যানিশ মহামারী

  • নাঈমা নুসরাত যূথীকা

মূল রচনাটির লেখক  লরা স্পিনি, তিনি একজন বৃটিশ বিজ্ঞান বিষয়ক সাংবাদিক, ঔপন্যাসিক এবং প্রাবন্ধিক। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস “পেল রাইডার” ১৯১৮ সালের মহামারী অবলম্বনে লেখা। এই প্রবন্ধটি তিনি ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রচনা করেন।  অনুবাদটি  প্রথমে নয়া দুনিয়ায় প্রকাশিত হয়। 

আর্টওয়ার্ক: দ্য ইনটেরিয়র অব হসপিটাল টেন্ট
শিল্পী: জন সিঙ্গার
সূত্র: পিনটারেস্ট

মূল রচনা
প্রায় ১০০ বছর আগে ১৯১৮ সালে, সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে বা পুরো মানব ইতিহাসে, ব্ল্যাক ডেথের পর মৃত্যুর জোয়ার নেমেছিল। আমরা সেই জোয়ারকে স্প্যানিশ ফ্লু বলি এবং এর ফলে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছিল। জনস্বাস্থ্য খাতেও সর্বাধিক বিপ্লব ঘটে তখনই।

বিশ শতকের প্রথম দশকে পৃথিবী অন্যরকম ছিল। বিশেষত, স্বাস্থ্যসেবার সম্পর্কে তখনও কোন নির্দিষ্ট চিন্তা-ভাবনা ছিল না। শিল্পোন্নত বিশ্বে বেশিরভাগ ডাক্তার হয় স্বাধীনভাবে কাজ করতেন নয় বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দ্বারা অনুদান পেতেন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের আওতার বাইরে থাকত তারা।

জনস্বাস্থ্য নীতি যেমন অভিবাসন নীতিগুলি ধার্য করত ইউজেনিক্সরা। সুবিধাপ্রাপ্ত এলিটরা কর্মীদের এবং গরিবদেরকে নিম্নমানের মানুষ হিসেবে গণ্য করত। তারা মনে করত, প্রাকৃতিক অবক্ষয়ের ফলে গরিবদের মধ্যে রোগব্যাধি লেগে থাকে। এলিটরা এটা বুঝত না যে দরিদ্রদের অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, অত্যাধিক শ্রম এবং নিম্নমানের খাদ্যাভ্যাসের কারণে তাদের অসুস্থতা দেখা দিত। কলেরা বা টাইফয়েড অথবা অন্যান্য প্রাণঘাতী রোগে নিম্ন শ্রেণির মানুষদের মৃত্যু ঘটলে ইউজেনিসিস্টরা দায়ী করতো তাদেরই কারণ দরিদ্র মানুষের মধ্যে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিল না। মহামারীর সময়ে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা বোঝাতে অভিজাতদের জীবন রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু পদক্ষেপকে বোঝান হত।

স্প্যানিশ ফ্লু এর প্রথম তরঙ্গটির উদ্ভব হয়েছিল ১৯১৮ সালের বসন্তে যদিও এর সাথে স্পেনের কোন সম্পর্ক ছিল না। একে স্প্যানিশ ফ্লু বলা হয় কারণ অন্যান্য যুদ্ধরত দেশগুলির পক্ষপাত যুক্ত সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে গিয়ে স্পেনের নিরপেক্ষ সংবাদপত্রগুলি এই রোগের গতিবিধি সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। ফ্লুটি অন্যান্য সংক্রামক জ্বরের মত কাশি এবং হাঁচির মাধ্যমে ছড়ায়। এটি অত্যন্ত সংক্রামক এবং খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ে যখন অনেক মানুষ এক জায়গায় একত্রিত হয়, উদাহরণস্বরূপ বস্তি অথবা যুদ্ধক্ষেত্রে। অতএব এই রোগকে ভিড়ের অসুখ (ক্রাউড ডিজিজ) বলেও উল্লেখ করা হয়।

১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লুয়ের প্রথম তরঙ্গটি তুলনামূলকভাবে হালকা ছিল, মৌসুমী সংক্রামক জ্বরের মতই প্রায়। কিন্তু  যখন মহামারীটির দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে মারাত্মক পর্যায় ১৯১৮ সালের শরৎকালে শুরু হল তখন জনগণ বিশ্বাস করতে পারছিল না যে এটি একই রোগ। উদ্বেগজনকভাবে এর আগের মহামারী সংক্রামক জ্বরের চেয়ে এই সময় ২৫ গুণ বেশি মানুষ মারা গিয়েছে। যদিও প্রাথমিকভাবে তারা সংক্রামক জ্বর, গলা ব্যথা, মাথা ব্যথাকেই গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু শীঘ্রই আক্রান্ত ব্যক্তিদের মুখ নীল হয়ে উঠছিল, শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিল, এমনকি তাদের নাক এবং মুখ থেকে রক্ত ঝরছিল। মুখ নীল থেকে কালো হয়ে গেলে তাদের আর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকত না। আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্কুচিত ফুসফুসগুলোতে এত বেশি পানি জমেছিল যে তারা শ্বাস নিতে পারত না এবং কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক দিনের মধ্যে মৃত্যুবরণ করতো। ঐ বছরের দ্বিতীয় প্রান্তে এসে দ্বিতীয় তরঙ্গটি দেখা দিয়েছিল, তবে ১৯১৯ সালের প্রথম দিকে তৃতীয় এবং চূড়ান্ত তরঙ্গ দেখা দেয় যেটি অন্য দুটোর চেয়েও অত্যাধিক তীব্র ছিল।

আর্টওয়ার্ক: ডেথ অ্যান্ড দ্য মেইডেন
শিল্পী: এগন শেইলি
সূত্র: পিনটারেস্ট

সংক্রামক জ্বরটি একটি ভাইরাসের কারণে হয়। বিশ্বের বেশিরভাগ চিকিৎসকই ধরে নিয়েছিলেন যে তারা ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ নিয়ে কাজ করছেন। অর্থাৎ সকলে স্প্যানিশ ফ্লুর বিরুদ্ধে প্রায় সম্পূর্ণ নিরস্ত্র ছিল। তাদের কাছে কোনও সংক্রামক জ্বরের ভ্যাকসিন বা  অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ ছিল না, এমনকি কোনও অ্যান্টিবায়োটিকও ছিল না যেটি সেকেন্ডারি ব্যাকটিরিয়া সংক্রমণের বিরূদ্ধে কার্যকর হতে পারে। ফলে বেশিরভাগ আক্রান্ত মানুষই মারা যায় (নিউমোনিয়ার মত)। জনস্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণ যেমন- আক্রান্তদের পৃথকীকরণ বা জনসভার স্থানগুলি বন্ধ কার্যকর করা হয়েছিল কিন্তু অনেকটা দেরিতে, যেহেতু ১৯১৮ সালের এই ইনফ্লুয়েঞ্জা কোন নির্ণয়যোগ্য রোগ ছিল না। এর অর্থ হল চিকিৎসকরা কর্তৃপক্ষের কাছে কেসগুলি রিপোর্ট করতে বাধ্য ছিলেন না, যার ফলস্বরূপ কর্তৃপক্ষ এই মহামারীটির প্রাদুর্ভাব আন্দাজ করতে ব্যর্থ হয়।

বর্তমান অনুমান অনুযায়ী এই রোগটি ৫০ থেকে ১০০ কোটি মানুষের মধ্যে অর্থাৎ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২.৫ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে ছড়িয়েছিল। এই সংখ্যাগুলির সাথে বিশ্বযুদ্ধে নিহত মানুষের সংখ্যা তুলনা করলে দেখা যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত হয়েছিল প্রায় ৬ কোটি মানুষ। এরপর বিশ্বজুড়ে অসুস্থতা এবং মৃত্যুর হার নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে বহুবিধ কারণে, মহামারীবিদরা তখন থেকেই সেগুলো নিয়ে কাজ করছেন। বিভিন্ন মহামারীতে ব্যাপকভাবে দরিদ্র মানুষেরাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সবচেয়ে বেশি তবে অভিজাতরাও কোনভাবে রেহাই পায়নি। স্বাস্থ্য বিভাগ এই বিপর্যয় থেকে যে শিক্ষা গ্রহণ করেছিল, সেটা হল সংক্রামক রোগের জন্য কোনও ব্যক্তিকে দোষ দেওয়া যুক্তিসঙ্গত না বা তাকে একঘরে করে রাখাও উচিৎ না।

১৯০০ শতকের বিশের দশকে বহু সরকার সামাজিক চিকিৎসার ধারণাকে গ্রহণ করেছিল- সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা, প্রয়োজনীয় স্থানে বিনামূল্যে ঔষধ প্রদান করা হত। রাশিয়াই প্রথম দেশ যেখানে একটি কেন্দ্রীভূত জনস্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল, যা রাষ্ট্রায়ত্ত বীমা প্রকল্পের মাধ্যমে কার্যকর করা হয় এবং পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্যরাও এটা অনুসরণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়োগকর্তা-ভিত্তিক বীমা স্কিমগুলিকে অগ্রাধিকার দিয়ে আলাদা পথ গ্রহণ করে, তবে সেখানেও সংক্রামক জ্বর মহামারী পরবর্তী বছরগুলিতে সমন্বিত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

১৯২৪ সালে সোভিয়েত সরকার চিকিৎসার ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত লক্ষ্য নির্ধারণ করে। এর মাধ্যমে তারা পেশাগত এবং সামাজিক অবস্থা যা রোগ সৃষ্টি করে তা নিয়ে গবেষণা করার সামর্থ্য অর্জন করে এবং শুধুমাত্র রোগ নিরাময় নয় তারা রোগ প্রতিরোধের উপায়গুলোও জানতে পারে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে বিশ্বজুড়ে এই নীতিই গৃহীত হয়েছিল। নতুন এই চিকিৎসা পদ্ধতি কেবল জৈবিক এবং পরীক্ষামূলক নয়, সমাজবিদ্যাগতও। জনস্বাস্থ্য এখন প্রায় এরকম পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।

সোভিয়েত পোস্টার

জনস্বাস্থ্যবিদ্যার মূল ভিত্তি হল মহামারী সম্পর্কে অধ্যায়ন। যেখানে রোগের ধরণ, কারণ এবং রোগের প্রভাবগুলির অধ্যায়ন যা এখন পুরোপুরি বিজ্ঞান হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। মহামারী সংক্রান্ত বিদ্যার জন্য তথ্য প্রয়োজন। ফলে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ আরও নিয়মতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯২৫ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত রাজ্য একটি জাতীয় রোগ প্রতিবেদন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। ১৯১৮ সাল থেকে যে সকল প্রাথমিক সতর্কতা নির্ণয় যন্ত্রের অভাব মারাত্মকভাবে দেখা দিয়েছিল সেগুলো নিয়ে কাজ শুরু হয়। দশ বছর পরে, জনগণের প্রাথমিক স্বাস্থ্যের প্রতি কর্তৃপক্ষ নজর দেয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রথম জাতীয় স্বাস্থ্য জরিপ করা হয়।

১৯২০ এর দশকে অনেক দেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তৈরি বা সংস্কার করেছিল এই মহামারীর প্রত্যক্ষ ফলাফল হিসাবে। এ সময় জনস্বাস্থ্য নেতারা হয় পুরোপুরি মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে বাদ পড়েছিলেন অথবা শুধুমাত্র অন্যান্য বিভাগের তহবিল এবং ক্ষমতাগুলির জন্য অবেদন করতে পারতেন। তবে আন্তর্জাতিক স্তরে জনস্বাস্থ্যের সমন্বয় করার প্রয়োজনীয়তার স্বীকৃতিও ছিল, কারণ স্পষ্টতই সংক্রামক রোগগুলি কোন দেশের সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ থাকে না। ১৯১৯ সালে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় মহামারী নিয়ে লড়াইয়ের জন্য একটি আন্তর্জাতিক ব্যুরোর উদ্বোধন করা হয়েছিল, একে আজকের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রাথমিক কাঠামো বলা চলে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গড়ে তোলার আগে ইউজানিকদের নাকচ করে দেওয়া হয়েছিল এবং নতুন সংগঠনটির সংবিধান স্বাস্থ্যের প্রতি সমান গুরুত্ব দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। এতে বলা হয় ‘জাতি, ধর্ম, রাজনৈতিক বিশ্বাস, অর্থনৈতিক বা সামাজিক অবস্থা নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে’। যদিও এই দর্শন সংক্রামক জ্বরের মত মহামারীগুলির হুমকিকে দূর করতে পারেনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) গড়ে ওঠার পর এরকম তিনটি মহামারী এসেছে এবং ভবিষ্যতে নিশ্চয় আরও আসবে, তবে মানুষ আগে যেভাবে এর মোকাবেলা করত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আসার পর এগুলোর মোকাবেলায় অনেকগুলো বদল এসেছে। এর দ্বারা এটা বোঝা গেছে যে, মহামারী কোনো ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিষয় নয় বরং সামষ্টিক কেন্দ্রিক।

 

নাঈমা নুসরাত যূথীকা