অরাজ
প্রচ্ছদ » রুহুলানুর দপ্তর: উপক্রমণিকা

রুহুলানুর দপ্তর: উপক্রমণিকা

শহিদুল ইসলাম

কমলাকান্তকে চেনেন না, বঙ্গভাষায় শিক্ষিত এমন কোন মানুষ আছেন কিনা আমার জানা নেই। তার জন্মের সোয়াশ’ বছর পার হয়ে গেলেও সে রক্তমাংসের শরীর নিয়ে আজও আমাদের মাঝে জীবিত। স্বতন্ত্র পুস্তকাকারে কমলাকান্তের দপ্তর  প্রকাশিত হয় ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে। শিল্পাচার্য অবনীনাথ ঠাকুর কমলাকান্ত সম্পর্কে বলেছিলেন,‘বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্ত যদি একটি মানুষ হত, তাহলে এতকাল সে বেঁচে থাকতেই পারতো না—কিন্তু সে নাকি একটা ধূমকেতুর মতো, তাই থেকে থেকে আসে আর চলে যায় পৃথিবীর গায়ে আলোর ঝাঁটা বুলিয়ে দিয়ে। বঙ্কিমের যুগে এই ঝাঁটা একবার দেশের গায়ে পড়েছিল।’ (ভারতী; ফাল্গুন, ১৩৩৩, পৃষ্ঠা-১০৭৯)। শিল্পাচার্যের কলম দিয়ে আলোর ‘ছটা’ না বেরিয়ে, বেরিয়েছে ‘ঝাঁটা’। আমরা জানি অন্ধকার দূর করার জন্য আলোর ছটার প্রয়োজন হয়। যেমন রাতের অন্ধকার দূর করতে সূর্যদেব প্রত্যুষে আলোর ছটা নিয়ে পূর্ব দিগন্ত আলো করে উদিত হন।’( বঙ্কিম রচনাবলী ২য় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ সংশোধিত দ্বাদশ মুদ্রণ, ১৪০১; সাহিত্য-প্রসঙ্গ সতের/আঠার)। ঝাঁটা দিয়ে কি কাজ হয়, আশা করি পাঠক সমাজকে তা বলে দিতে হবে না। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস ‘কমলাকান্তের জন্মের ইতিহাস ‘আমাদের জানিয়েছেন অনেক আগেই। তাঁরা মনে করেন, ‘বঙ্কিমচন্দ্রের স্বভাবত রহস্যপ্রিয় মন প্রথমটা ‘লোকরহস্য’র সহজ পথে একটা মুক্তির উপায় আবিষ্কার করিয়া কতক সান্ত্বনা লাভ করিয়াছিল। কিন্তু মাসের পর মাস নিছক রহস্য সৃষ্টি করিয়া তৃপ্ত থাকিবার মত পল্লবগ্রাহী মন বঙ্কিমচন্দ্রের ছিল না। প্রবহমান সংসারস্রোতের উপরিভাগে আপাত মনোহর তরঙ্গভঙ্গে ভাসিতে ভাসিতে তীক্ষ্ণধী বঙ্কিমচন্দ্র কখনও গভীর রহস্যগহনে তলাইয়া যাইতেন, এবং মরণশীল মানবের, এবং বিশেষ করিয়া যে সকল হতভাগ্য জীব তাঁহার আশেপাশে চিন্তাহীন নিঃশঙ্কতায় ভাসমান, তাহাদের ভয়াবহ পরিণতির কথা আপন অন্তরে অনুভব করিয়া হাল্কা হাসির বুদ্বুদ-বিলাসে তাঁহার মন সায় দিত না। অর্ধোন্মাদ নেশাখোর কমলাকান্তের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া তখন তাঁহার উপায় ছিল না। সোজাসুজি সজ্ঞানে যে সকল কথা বলিতে তিনি সঙ্কোচ বোধ করিতেন, কমলাকান্তের মুখ দিয়া সেই সকল কথা তিনি অসঙ্কোচে বলিতে পারিতেন এবং এই রহস্যময় পাগলকে কেন্দ্র করিয়া মাসের পর মাস পাঠক ভুলাইতে তাঁহাকে বেগ পাইতে হইত না। এক আধারে ব্যঙ্গেরশর্করামণ্ডিত কাব্য, পলিটিক্স, সমাজবিজ্ঞান এবং দর্শন পরিবেশনের উপায় সৃষ্টি করিয়া সম্পাদক এবং প্রচারক বঙ্কিমচন্দ্র নিজের কাজ অনেকটা সহজ করিয়া লইলেন। কমলাকান্তের জন্মের ইহাই ইতিহাস।” ( কমলাকান্ত—বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-সংস্করণ, ভূমিকা) । শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার দাশগুপ্তের মতে ‘কমলাকান্ত একাধারে কবি, দার্শনিক, সমাজশিক্ষক, রাজনীতিজ্ঞ ও স্বদেশপ্রেমিক, অথচ তাহাতে কবির অভিমান, দার্শনিকের আড়ম্বর, সমাজশিক্ষকের অরসজ্ঞতা, রাজনৈতিক কল্পনাহীনতা, স্বদেশপ্রেমিকের গোঁড়ামি নাই।’(বঙ্কিমচন্দ্র’ ১৩২৭, পৃষ্ঠা-১৯৭; রচনাবলী ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৭)। তাই তো পাগল হোক আর যাই হোক কমলাকান্ত আজও বাঙালির হ্রদয়ে শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবেই বেঁচে আছে।

কমলাকান্তের চরিত্রাবিষ্কার নিয়ে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের মৌলিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। ‘De Quiencey’s Confession Of an Opium Eater কিংবা Pickwick Papers-এর Sam-এর সঙ্গে সাদৃশ্য থাকলেও অক্ষয়বাবুর বিশ্বাস ‘উহাতে কমলাকান্তের মৌলিকতা নষ্ট হয় নাই।’ (রচনাবলী, পৃষ্ঠা-১৭)। আমি সাহিত্য সম্রাট নই, একজন সাহিত্যিক পদবাচ্য ব্যক্তিও নই। তাই কেউ প্রশ্ন তোলার আগেই আমার স্বীকার করতে লজ্জা নেই যে ‘রুহুলানুর দপ্তর’ কমলাকান্তের আদর্শেই রচিত হয়েছে। শিল্পাচার্য তো বলেইছিলেন যে কমলাকান্ত “ধুমকেতুর মত থেকে থেকে আসে আর চলে যায় পৃথিবীর গায়ে আলোর ঝাঁটা বুলিয়ে দিয়ে।” কথাটা সত্যি। রুহলানুর জন্মের ইতিহাস জানলে সেই সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয়।

বঙ্কিমচন্দ্র কমলাকান্তের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেন এভাবে, ‘‘অনেকে কমলাকান্তকে পাগল বলিত। সে কখন কি বলিত, কি করিত, তাঁহার স্হিরতা ছিল না। লেখাপডা না জানিত, এমন নহে। কিছু ইংরেজি, কিছু সংস্কৃত জানিত। কিন্তু যে বিদ্যায় অর্থোপার্জন হইল না, সে বিদ্যা কি বিদ্যা? আসল কথা এই, সাহেব সুবোর কাছে যাওয়া আসা চাই। কত বড় বড় মুর্খ, কেবল নাম দস্তখত করিতে পারে—  তাহারা তালুক মুলুক করিল—আমার মতে তাঁহারই পণ্ডিত। আর কমলাকান্তের মত বিদ্বান, যাহারা কেবল কতকগুলি বহি পডিয়াছে, তাহারা আমার মতে গণ্ডমুর্খ।” কথাটা রুহুলানুর ক্ষেত্রে অন্যভাবে প্রযোজ্য। রুহুলানুর নামের পিছনে এমএ, বিএ, পিএইচডি, ইঞ্জিনিয়ারিং  কিংবা ডাক্তারির কোন লাঙ্গুল নাই। টেনেটুনে অনেক কষ্টে আইএ টা পাশ করেছিলেন। যখন তার স্কুলের সহপাঠী বন্ধুরা তাদের নামের পিছনে বড় বড় লাঙ্গুল জুডে নিয়েছে, তখন বলতেই হয় যে রুহুলানু তাদের তুলনায় মুর্খ। কিন্তু যারা তার সহপাঠী বন্ধু এবং যারা গত প্রায় সত্তর বছর তার সাহচর্যে এসেছেন তারা স্বীকার করবেন রুহুলানু একজন স্বশিক্ষিত ব্যতিক্রমি মানুষ। শম্ভুমিত্র ম্যাট্রিক পাশ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল তা’ও নন কিন্তু জ্ঞানতৃষা সারা জীবন তাঁদের তাড়া ক’রে নিয়ে বেরিয়েছে। ম্যাট্রিক পাশ করেও শম্ভু মিত্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। আর নন-ম্যাট্রিক রবীন্দ্র-নজরুলের ওপর গবেষণা ক’রে কত বিশ্ববিদ্যালয়ের কত শিক্ষক পেটের অন্ন সংস্হান করছেন তার কোন ইয়ত্তা নেই। না পাঠকবৃন্দ, আমি ওইসব ক্ষণজন্মা মানুষের সঙ্গে রুহুলানুর তুলনা করে তাঁদের ছোট করতে চাই না। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি তার ভিতর থেকে কিছু একটা বের হয়ে আসার জন্যে আঁকুবাঁকু করছে। তার কথাবার্তা ছিল অদ্ভুত, রহস্যময়, মোহনীয়—  মনে হত আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ওপার থেকে তিনি যেন কিছু বলতে চাইতেন। আমরা সবাই তাকে পাগল বলতাম। শুনে তিনি প্রাণখোলা হাসি হাসতেন। রুহুলানুর চালচলন, শংকাহীন জীবন-যাপন সবার মতে ‘বাবুয়ানা।’

কমলাকান্তের জ্ঞানবুদ্ধি দেখে কোন এক সাহেব তাকে তার কেরানীর কাজ দিয়েছিল। সেখানে সে বিভিন্ন ফাইল পত্রে তার পাণ্ডিত্য প্রকাশ করার ফলে তাকে চাকরিচ্যুত করতে বাধ্য হয়েছিল। রুহুলানুও কমলাকান্তের মত সুন্দর ইংরাজি বলতেন। ইংরেজ আমল তো আর নাই। ইংরেজ সাহেব না থাকলে কি হবে ইংরেজির সে কদর কমেনি। পাকিস্তানের উঠতি জনৈক বাঙালি শিল্পপতি রুহুলানুর ইংরেজি জ্ঞানের জন্যে নিজের পিএ করে নেন। ব্যবসায়ের স্বার্থে তাকে নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় যেতেন ইংরাজিতে কথা বলার জন্য। কিন্তু পাণ্ডিত্যের সে কদর দেশ থেকে বিদায় নিয়েছে। পাকিস্তান হয়েছে-শিক্ষিত হিন্দুদের তাড়িয়ে দিয়ে অশিক্ষিত ও শিক্ষিত নামধারী অশিক্ষিত আমরা, মুর্খরা রাষ্ট্রের সব চাকরি দখল করে নিয়েছি। দস্তখত করতে পারে না, এমনসব মানুষ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের পদগুলি দখল করে নিয়েছি। সে যুগ নেই— সে সময়ও নেই যে ম্যাট্রিক পাশ শম্ভুমিত্রের মত একজন নাটুকে-অভিনেতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন। তাছাড়া রুহুলানুর ওসবের প্রতি কোন আগ্রহও ছিল না কোনদিন। কমলাকান্তের মত তারও অর্থের কোন প্রয়োজন ছিল না বলে আমাদের মনে হয়েছে। যেটুকুনই প্রয়োজন হত, সেটুকুনই বা কোথা থেকে আসতো, তাই নিয়ে সবাই জল্পনা-কল্পনা করতো। তবে কমলাকান্তের সঙ্গে তার বড় এক পার্থক্য ছিল দারপরিগ্রহ করার ক্ষেত্রে। ইসলাম সংসার ধর্ম ত্যাগ করে বৈরাগ্যসাধন সমর্থন করে না। তাই যৌবনে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মানুসারে তিনি দারপরিগ্রহ করেছিলেন। সেখানেও ব্যতিক্রম। একটি সুন্দরি হিন্দু ললনাকে বিয়ে করে জেল-হাজতে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তার বন্ধুরা যখন তাদের দু’জনকে নিয়ে আসন্ন বিপদাশঙ্কয় কাতর, তখনও তিনি নির্লিপ্ত-ভাবলেশহীন, কৌতুকময়। সেই হিন্দু ললনা ১৯৬০ সালে ঢাকায় ‘রাজা এল শহরে’ ছবির জন্য মনোনীত হয়েছেন। চিত্রালী পত্রিকাসহ সমস্ত পত্র পত্রিকায় তার রঙিন ছবি দেশের যুব সমাজের ঘুম হারাম করে দেয়। কিন্তু মেয়েটি তার সম্ভাবনাময় জীবন ত্যাগ করে রুহুলানুর গলায় মালা দিয়ে এক অজানা ভবিষ্যতের মধ্যে ঝাঁপ দেয় এবং সারা জীবন বিশ্বস্ততার সঙ্গে সংসার ধর্ম পালন করেন। বঙ্কিমচন্দ্র কমলাকান্তকে পরিচয় করিয়ে দিতে মাত্র কুড়িটি লাইন খরচ করেছিলেন। কারণ কমলাকান্ত ছিলেন একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ। রুহুলানু তার তুলনায় অতি নগণ্য এক ব্যক্তি। তার ভিতরে যে সম্ভাবনা ছিল, তা তার পরিচিত সীমানার বাইরে ছডিয়ে পড়েনি। তার ঘনিষ্ঠ বা পরিচিতজনের মাঝেই রুহুলানুর অনন্যতা-অসাধারণতা সীমাবদ্ধ। তার সেই ক্ষুদ্র পরিচিত গণ্ডির বাইরে তাকে টেনে আনার এক দুরূহ কাজ আমি হাতে নিয়েছি। বন্ধু হাসান আজিজুল হক বা আখতারুজ্জামানের হাতে পড়লে আমার দৃঢ বিশ্বাস রুহুলানুও কমলাকান্তের মত অমরত্ব লাভ করতেন। আমার সে সাধ্য কোথায়? আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে কিছু রঙ্, কিছু রস যুক্ত করার ক্ষমতা কোথায়?  যা বঙ্কিমবাবুর ছিল। তাই তো বঙ্কিমবাবুর মত কমলাকান্ত অমর হয়ে আছেন।

রেল কোম্পানির চাকুরে এক রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত ঘরের জৈষ্ঠ সন্তান রুহুলানু। আমাদের দেশে বড় ছেলের কাছে মা-বাবা-সমাজের একটা চাহিদা থাকে। রুহুলানু সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। বিএ, এমএ পাশ দিয়ে মধ্যবিত্ত রেলের চাকুরে বাবা-মা’য়ের ডজনখানেক ছেলেমেয়েকে মানুষ করার দায়-দায়িত্ব কিছুটা হলেও নিজের কাঁধে তুলে নেবেন, রুহুলানুর মনে এমন কোন চিন্তার উদ্রেক হয়েছে, এমন কোন প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। যতদিন বাবার হোটেলে ছিলেন, ততদিন তার বাবুয়ানি ও বই-সিগারেট-প্রসাধনীর খরচ চুপিসারে তার মা’কেই সরবরাহ করতে হত। বাবার পকেট কখনও কাটতে হয়নি, একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কিন্তু হিন্দু অভিনেত্রীর পাণিগ্রহণের পর বাবার হোটেলের দরজা বন্ধ হয়ে গেলে, কিভাবে তিনি সংসারধর্ম পালন করার সাথে তার ঠাঁটবাট, জীবনধারণের সুপরিচিত ধরনটা বজায় রেখেছিলেন, তা আজও সবার কাছে দুরহ গবেষণার বিষয়। কখন কিভাবে টাকা রোজগার করতেন, সেটা যেমন মহারহস্যে ঘেরা, তিনি সারা জীবন বাবুগিরি করে কিভাবে কাটিয়ে দিলেন, সেটাও তাই।

আমরা একই স্কুলে পড়তাম। তিনি আমার তিন বছর আগে ম্যাট্রিক পাশ করেন (১৯৫৪)। তার দৈনন্দিন রুটিনের জন্য তিনি প্রায় শাস্তি ভোগ করতেন। দেরি করে স্কুলে আসার জন্য তাকে বহুদিন স্কুলের তিন বাহুর মাঝের মাঠে দুই কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। শীত গরম কোন কিছুই তাকে স্বভাবসিদ্ধ হাঁসি-ঠাট্টা-মশকরা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। আমরা জানলা দিয়ে তার সেসব কৌতুক উপভোগ করতাম। তার দৈনন্দিন রুটিনের কথা যখন উঠলই, তখন বলি আমাদের দিন রাত্রি, সকাল-দুপুর-সন্ধা নির্ধারিত হয় সূর্যের দ্বারা। কিন্তু রুহুলানুর কাছে সূর্যের অবস্হান ছিল গৌণ। তার কাছে ঘড়িই ছিল সর্বেসর্বা। ঘড়ির কাঁটা ধরে তার জীবনযাত্রার কাঁটা ঘুরতো। এক্ষেত্রে Around The World In Eighty Days-এর ফগের কথা মনে পড়ে। ফগের মত রুহুলানুর অঢেল টাকাপয়সা ছিল না সত্যি কিন্তু ফগের মত তার জীবনযাত্রা চলতো ঘড়ির কাঁটা ধরে। শুনি, আজ এত বছর পরও তার সামান্য রদবদল হয়নি। বেলা এগারটায় যখন সূর্যদেব পূর্ব দিগন্ত ছেডে অনেক ওপরে উঠে এসেছে, তখন রুহুলানুর সুবেহ সাদেক, শরীরের আড়মোড়া ভেঙ্গে হাতমুখ ধুয়ে নাস্তার জন্য পিড়ে পেতে বসতেন। সকাল দশটা থেকে আমাদের স্কুল শুরু। আমরা স্নান- খাওয়া সেরে যখন স্কুলমুখো, তখন রুহুলানু মশারির ভিতর নিশ্চিন্তে নিদ্রামগ্ন। তার মা যেদিন ঠেলেঠুলে তাকে তুলে দিতে পারতেন, সেদিন সঠিক সময়ে তাকে স্কুলের চারদেয়ালের মাঝে দেখা যেত। তা নাহলে স্কুলের রুটিন মেনে ক্লাসে উপস্হিত হওয়া ছিল তার পক্ষে অসম্ভব। সম্ভবত আইএ পাশ করার পর তার পক্ষে আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়নি। যেদিন স্কুলে যেতেন না, সেদিন তার ঘরের মধ্যে দিব্বি মনের সুখে সপ্তাহের News Week, Times, Reader’s Digest এর পাতাগুলির মধ্যে মুখগুঁজে আনন্দের সাথে সময় অতিবাহিত করতেন। ছুটির দিনগুলিতে আড্ডার জন্য আমরা প্রায় তার ঘরে যেতাম। কিন্তু কোনদিনই সাড়ে এগার/বারটার আগে যেতাম না। কারণ তার সময়ের হিসেবটা সবারই জানা। অনিয়মিত স্কুলে যাওয়া-আসা করলেও প্রতিটি পরীক্ষায় সে বেশ ভালভাবেই উত্তীর্ণ হয়ে পরবর্তী শ্রেণীতে উন্নীত হতেন। তাই শিক্ষকরা বলতেন, ’ছেলেটির মাথা ভাল।’ ইংরাজীতে ভাল করলেও অঙ্কে সে ভীষণ কাঁচা। অঙ্ককে তার ভীষণ ভয়। মাঝে মাঝে তিনি হেসে বলতেন, ’অঙ্কের মত বিশ্রী বিষয় আর নাই।’ সত্যিই তো, আমাদের হিসেবমত যার জীবনের চাকা ঘুরতো না, অঙ্ক তার ভাল লাগতে পারে না।

তার মুখেই শুনেছি যখন তিনি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়েন তখন বিড়ি দিয়ে তার নেশা শুরু। সে বিড়ি আজকের সিগারেট-মার্কা বিড়ি নয়—  রীতিমত তন্ডু পাতার বিড়ি। ধীরে ধীরে তার নেশার মান বিড়ি ছেড়ে উন্নতমানের বিদেশী সিগারেট হয়ে আধুনিকতম নেশার রাস্তা ধরে। ছোটবেলায় লুকিয়ে-সুকিয়ে নেশা করলেও বড় হয়ে প্রকাশ্যেই সিগারেট টানতেন। তবে বাবা-চাচাদের সমীহ করতেন। তাঁদের দেখে হাতটা লুকোতেন। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ দেবার পর Broun রঙের Passing Show সিগারেটের গোল টিনন, একটা সিগারেট লাইটার, Time, News Week ও Reader’s Digest ও পার্স হাতে সদ্য ভাঁজভাঙ্গা পাঞ্জাবি-পায়জামা গায়ে দিয়ে বাবু রুহুলানু সন্ধার পর সুগন্ধি ছড়াতে ছড়াতে ঈশ্বরদীর ওভার ব্রিজ পার হয়ে যখন রেলওয়ে ইনস্টিটিউটের দিকে আসতেন, তখন তাকে দেখে মনে হত এমন সুখি মানুষ বোধহয় পৃথিবীতে দ্বিতীয় আর একজন নাই। সঙ্গে থাকতেন অপুভাই। হরিহর আত্মা। সত্যি তার মত সুখি মানুষ আজ পৃথিবীতে আছে কিনা সন্দেহ হয়।

ও হ্যা, তার দৈনন্দিন রুটিনের কথা থেকে দূরে সরে এসেছি। আগেই জেনেছেন বেলা এগারটায় তার দিনের শুরু। সন্ধ্যা আটটার মধ্যে ‘লাঞ্চ’ খেয়ে, গায়ে প্রচুর পরিমানে বিদেশী সুগন্ধি মেখে তিনি ক্লাবের দিকে রওনা দিতেন। সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী অপু ভাই থাকতেন। ক্লাবে আড্ডা চলতো বেশ রাত পর্যন্ত। বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত তার মা’কেই দরজা খুলে দেবার জন্য রাত জেগে বসে থাকতে হত। তার রাশভারী বাবা মা’কে বকাবকি করতেন, ’তোমার জন্যেই ছেলেটি গোল্লায় গেল।’ বিয়ের পর সে কাজটির দায়িত্ব স্ত্রী তুলে নেয়। দরজা খুলে দিয়ে মা বা স্ত্রী’র আর কোন কাজ থাকতো না। বিছানায় গিয়ে তারা তন্দ্রার কোলে আশ্রয় নেন। রুহুলানু তখন জমিদার পুত্রের মত আরাম-আয়েশে, ধীরে-সুস্হে তার কাজে লিপ্ত হয়ে পরতেন। ঋতুর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঘড়ির কাঁটা ধরে শেভ করবেন। স্নান সমাপনান্তে রাত দু’টো থেকে তিনটের মধ্যে সন্ধ্যার ‘ডিনার’ পর্ব সমাপ্ত করে বিছানার কোলে নিজেকে সমর্পন করবেন। পরদিন এগারোটার আগে তার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুও তার সাক্ষাত পেতেন না।

আমার একান্ত ঘনিষ্ঠ রুহুলানুর জীবনযাত্রার প্রতিটি পদক্ষেপ, তার প্রতিটি কথা আমি গভীর মনোযোগের সাথে দেখতাম, শুনতাম। তিনি আমার তিন ক্লাস এবং অপু ভাই চার ক্লাস ওপরে পড়তেন। কিন্তু তারা উভয়েই আমাদের সহপাঠী সমবয়সী বন্ধুর মতই ব্যবহার করতেন। তিনি ছিলেন নাটক পাগল। নায়ক, ভিলেন কিংবা জোকার, সব চরিত্রেই তার দক্ষতা তাকে এ অঞ্চলের শীর্ষ স্হানে পৌঁছে দিয়েছিল। তার অভিনয় গুণই হিন্দু ললনাকে তার হাত ধরে নিজের বাড়ি ছেড়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। কিন্তু তিনি কখনও পরিচালকের দায়িত্ব নেন নি। পরিচালক ছিলেন অপু ভাই। এই দু’জন আমাদের মত নিচু ক্লাসের সংস্কৃতিমনা ছাত্রদের একত্র করে ঈশ্বরদীর সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে এভারেষ্ট শৃঙ্গে তুলেছিলেন। ছোটদের যার মধ্যে যে গুণ ছিল, তারা বাতাস দিয়ে তার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন।

কমলাকান্তের মত রুহুলানুও কিছু লিখতেন। ডায়েরি বলতে যা বোঝায়, ঠিকক সে ধরনের লেখা নয়। তার মনে যে বিষয়টা দাগ কাটতো, তাই নিয়েই লিখতেন। নিজে থাকতেন এত গুছিয়ে-বাবুয়ানা জীবনযাপন করতেন। কিন্তু তার ঘরটা ছিল সাংঘাতিক অগোছাল। মশারির দড়িগুলি না খুলে পা দু’টি বের করে দিয়ে তারপর সমস্ত শরীরটা গলিয়ে বেরিয়ে আসতেন। দিনের পর দিন মশারি এভাবে পাতাই থাকতো। ঢোকার সময় সামান্য একটু উঁচু করে ঢুকে পরতেন। কোনদিন যদি আমরা গিয়ে উপস্হিত হতাম, তখন তাড়াতাড়ি সামনের দু’পাশের দড়ি খুলে মশারিটা দেয়ালের দিকে ঠেলে দিতেন। বিছানার চাদর দিয়ে তোষকটা ঢাকার চেষ্টা করতেন। আমরা ‘থাক’ ‘থাক’ বলে ওই বিছানায় বসে পরতাম। কারণ তার পড়ার টেবিলের সামনে একখানা হাতলওয়ালা চেয়ার ছাড়া দ্বিতীয় আর কোন বসার কিছু ছিল না। টেবিলটা তথৈবচ। বই, পত্রিকা, কাগজপত্র এমনভাবে ছডিয়ে থাকতো যে তার মধ্যে থেকে কোন লেখা খুঁজে বের করা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। দু’চারটা লেখা আমাদের পডিয়ে শুনিয়েছেন। লেখার কনটেন্টের চাইতে তার পড়ার ঢংটা ছিল মজার। আমরা হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেতাম। বলতাম,’একটা বাঁধানো খাতায় লিখলেই তো পারেন? লেখাগুলি হারাবে না।’ হেঁসে বলতেন,’ হু! এগুলো কি হবে? অন্যে পড়ার জন্য লিখি না। ইচ্ছা হল লিখি। তার আবার যত্ন!’ আমরা কিছু লেখা চুরি করে এনেছি। সেগুলি সযত্নে দীর্ঘদিন কাছে রেখেছি। স্বাধীনতার পর তিনি নিয়মিত লেখেন। লেখার বিষয়-আশয় কোন ঠিকঠাক  ছিল না। রাজনীতি, সমাজনীতি, বুদ্ধিজীবী, লেখাপড়া, রাষ্ট্র-এহেন বিষয় নেই, তিনি লেখেন না। স্বাধীনতার পর ঢাকায় তার সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল। ঢাকার ক’টি ছবিতে তিনি মৃত সৈনিকের অভিনয় করেছিলেন। ১৯৯৭ সালে ভেড়ামারা কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগ কমিটির সদস্য হিসেবে যেতে হয়েছিল। ভেড়ামারার প্রাসাদসম গেস্ট হাউজে আমার থাকার ব্যবস্হা হয়েছিল। সেটা তৈরি হয়েছিল আইয়ুব খানের জন্য। তিনি ষাটের দশকে গঙ্গা কপোতাক্ষ প্রকল্প ভিজিটে গিয়ে ক’ঘন্টা সেখানে ছিলেন। আমি সেই খাটে একটা রাত কাটিয়েছলাম। রুহুলানু স্হানীয় শিল্পীদের নিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত গানবাজনার আয়োজন করেছিলেন। আমরা আবার ১৯৫০ এর দশকে ফিরে গিয়েছিলাম। তিনি গাইলেন বৈজু বাওরার দরবারি কানাড়া রাগে ‘ও দুনিয়া কো রাখওয়ালে।’ দরবারি কানাড়া তার প্রিয় রাগ। ১৯৫৬ সালে ইনস্টিটিউটে বৈজু বাওরার সব গান নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করেছিলেন।

আমার দীর্ঘ শিক্ষকতার জীবনে তিনি মাত্র দু’বার রাজশাহী এসে আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তিনি যে কাজ নিয়ে এসেছিলেন, সহজেই সকালের ট্রেনে এসে দুপুরের ট্রেনে ফিরে যেতে পারতেন। কিন্তু তার দৈনন্দিন জীবনের কথা আপনারা শুনেছেন। বেলা এগারটার আগে তার সকাল হয় না। তাই দুপুরের ট্রেনে এসে শহরে কোন হোটেলে উঠে আমাকে একটা ফোন করেন। পরদিনের আমার প্রোগ্রাম জেনে নিয়ে সময় মত আসেন। আসার উদ্দেশ্য মোটামুটি দু’বারই এক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে, যার কোন শত্রু থাকতে পারে কেউ ভাবতেই পারে না, তাকেও পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল। স্ত্রী হিন্দু, এক সময় ডাকসাইটে অভিনেত্রী ছিলেন এবং রুহুলানু নিজেও নাটকের লোক, এ সবই ইসলাম বিরোধী কাজ। রাজনৈতিক ইসলামপন্হীরা ছিল তার ওপর ভীষণ চটা। বিশেষ করে পরহেজগার মা-বাবার জৈষ্ঠ সন্তান।’ ধম্মো-কম্মো করবে না তো সারাদিন-রাত কেবল নাটক নাটক করে বেড়াবে?’ ‘খাঁটি’ মুসলমানের রাগ তো হবারই কথা। তাই মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষের ঘরবাড়ি পুরিয়ে দিয়েছিল। রুহুলানুর পর্ণকুটিরও ভস্মিভূত হয়। সেইসঙ্গে তাবৎ অস্থাবর শখের দ্রব্যাদি আগুনের গহ্বরে চলে যায়। পাকিস্তান আমলে তিনি গৌতম বুদ্ধের একটি পাথরের মুর্তি কিনেছিলেন সাত শ’ টাকায়। অসাধারণ সৌন্দর্যমণ্ডিত সে মুর্তি। আমরা চেয়ে দেখতাম আর মনে মনে তার অসাধারণ উঁচু রুচির তারিফ করতাম। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম মুর্তিটি কিনতে সাতশ’ টাকা তিনি কোথায় পেলেন? ‘ও জোগার হয়ে গেল’ স্বভাবগত হাসি হেসে বললেন। পরে বৌদির মুখে শুনেছিলাম তার ভরি চারেক সোনার গহনা বিক্রি করে তিনি ওটা কিনেছিলেন। ’তুমি দিলে?’-জিজ্ঞেস করলে হেসে বলেন, ’কি করবো ভাই! ওটা পছন্দ হবার পর প্রতিদিন অন্তত দশবার সেটা না-পাওয়ার দুঃখ প্রকাশ করতেন। একেবারেই ছেলেমানুষের মত।’ সেটাও একাত্তরে হারিয়ে যায়। এমনি আরো কত কি? কিন্তু সব কিছু হারাবার ব্যথা এক সময় ভুলে গেলেও যে জিনিসটি হারানোর শোক তাঁকে স্বধীনতার পর থেকে তাড়িয়ে নিয়ে বেরাচ্ছে, তাহল তার ‘এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা’। আজও তিনি তার জন্য হা-পিত্যেশ করছেন। সেই মহামূল্যবান জিনিসটি পুনরায় পাবার জন্য গত পঁচিশ-ত্রিশ বছর চেষ্টা-চরিত্রির পর আমার পরামর্শের জন্য তার আসা।
‘ তুমি তো কাগজে লেখ-টেখ। আমাকে একট এনসাইক্লোপেডিয়া জোগাড করে দিতে পারবে না? ‘
কিছুক্ষণ হা করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলি,’আমি?’
‘হ্যা, তুমি।’
‘ কিভাবে?’-জিজ্ঞেস করি।
‘তোমার লেখার মাধ্যমে ধনী দেশগুলোর সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পার। তাদের জানাতে পার জিনিসটা খোয়া যাওয়ায় বাংলাদেশের একজন অখ্যাত লোক মৃত্যুর মুখামুখি।’
আমি অবাক হয় বলি,’ কিন্তু আমি তো বাংলায় লিখি।’
‘আমি ইংরাজিতে অনুবাদ করবো।’ সহাস্যে বললেন।
কথায় কথায় জানা গেল দেশ স্বাধীন হবার পর ইউরোপের অনেক দেশের সরকার প্রধান, আমেরিকার প্রেসিডন্ট ও মধ্যপ্রাচ্যের শেখদের চিঠি দিয়েছেন। অনুরোধ করেছেন তারা ইচ্ছা করলে এই গরীবের জন্য এক সেট encyclopaedia কিনে দিতে পারেন সহজেই। কুয়েতসহ ইউরোপের দু’একটি দেশ থেকে তিনি চিঠিও পেয়েছেন। সবার এক কথা কোন ব্যক্তিকে ওটা তারা দেয় না। কোন সংগঠনের মাধ্যমে দরখাস্ত পাঠাতে বলেছে। সে চেষ্টাও করেছেন রুহুলানু। পাবলিক লাইব্রেরির নামে প্যাড ছাপিয়ে চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু কেউ আজ পর্যন্ত সাড়া দেয় নি। তিনি সেসব দেশ থেকে আসা চিঠিগুলি দেখালেন।
‘আর ক’দিন বাঁচবো! মৃত্যুর আগে যদি একসেট encyclopaedia পেতাম,তাহলে শান্তিতে মরতে পারতাম।’ এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন রুহুলানু। আমি অবাক হয়ে পাগলের মুখের দিকে চেয়ে রই। হাসবো না কাঁদবো? সেটা ১৯৯৭ সালের কথা।

দু’বছর পর তিনি দ্বিতীয়বার এলেন ওই একই কাজে। তার চরিত্র মাফিক কোন হোটেলে উঠে ফোনে জেনে নিলেন কখন আসবেন। পরদিন সময় মত এলেন। বসলেন। পাশের টেবিলের ওপর তার News Week ও সিগারেট লাইটার রাখলেন।
আমি জিজ্ঞেস করি ‘আপনার পার্স?’
হেসে বলে উঠলেন,’ ওটা গাড়িতে ফেলে এসেছি।’ যেন কিছুই হয়নি।
‘কত ছিল?’
‘ সামান্যই। একরাত ও একদিনে যা খরচ হয়।’
‘আপনি হোটেলে উঠলেন; ভাড়া দিতে হবে না?’
কোন কথা না বলে তিনি আমার হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিলেন। একরাত ও একদিনের হোটেলের বিল। সেইসঙ্গে আমার কাছে এক বিনম্র অনুরোধ ৩২০ টাকা আমি তাকে ধার দিতে পারবো কিনা! ফিরে গিয়েই মানি অর্ডারযোগে পাঠিয়ে দেবেন। আমি তাকে ৫০০ টাকার একটি নোট এগিয়ে দিলে তিনি বলে উঠলেন,’ এতো কি হবে?’
‘আপনি রাখেন’ আমি বলি।

আর কোন কথা নয়। সুন্দর করে ভাঁজ করে পাঞ্জাবীর পকেটে রেখে দিলেন। তারপর encyclopaedia’র কথা।
আমি বলি,’ দেখুন,আমার পক্ষে তো তা সম্ভব নয়। আমিও আপনার মতই একজন ছাপোষা মানুষ। আমারও সেই স্কুল জীবন থেকেই encyclopaedia কেনার ইচ্ছা ছিল। মানুষের সব ইচ্ছা কি পূরণ হয়? আপনি নিজেই তো আর একসেট কিনতে পারেন।’
‘আমি?’ হো হো করে হেসে উঠলেন,’ তুমি হাঁসালে! পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে আমি কিনবো encyclopaedia ?’ বলে ক্যালিফোর্নিয়ার থেকে জনৈক মহিলার চিঠি বের করে দিলেন। দেখি তিনি ক্যাবিনেটসহ  encyclopaedia’র জন্য একশ’ ডলার দাম চেয়েছেন।

তখন আমি বলি, ‘ভাই, প্রযুক্তির উন্নয়নে অনেক জিনিস উধাও হয়ে গেছে। কম্পিউটারের যুগে encyclopaedia ‘র আর সে মূল্য নাই। আপনি encyclopaedia’র থেকে অনেক বেশি তথ্য পাচ্ছেন।’
‘তুমি যা-ই বল, encyclopaedia’র কোন বিকল্প হয় না।’ বললেন রুহুলানু।
আমি বলি ’আপনার অনেক বন্ধু বাংলাদেশ হবার পর কোটিপতি হয়েছে। তারা কেউ আপনার এই দুঃখ দূর করতে পারেন না?’
‘তারা যদি নিজে কিনে আমাকে উপহার দেয়, আমার বলার কিছু নাই। কিন্তু আমি চাইতে জানি না। তাছাড়া, তারা encyclopaedia’র কী বোঝে? তারা আছে তাদের সম্পদ বৃদ্ধির ধান্দায়। আচ্ছা বলতে পার, মানুষের কত টাকার দরকার?’
বলি,’ তার জবাব তো টলস্টয় দিয়ে গেছেন।’
‘ ও, হ্যা, হ্যা, তাঁর সেই বিখ্যাত গল্পটির কথা বলছো? How Much Land a Man Required? দারুণ গল্প, তাই না?’ তিনি বলে চলেন, ‘সোভিয়েত বিপ্লবের পর মস্কো থেকে ৯০ খণ্ডে তাঁর সম্পূর্ণ রচনা সংগ্রহ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর মুদ্রিত বই-এর সংখ্যা দশ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন জাতির ৮২টি ভাষা ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় তাঁর রচনা প্রকাশিত হয়েছে। এমনি একজন লেখক নোবেল সাহিত্য পুরস্কার প্রদানকারীদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেল কি করে, বুঝি না। এমনি একজন লেখক এক অখ্যাত রেলওয়ে স্টেশনে মরে পড়ে থাকলেন, কেউ দেখার নাই, ভাবা যায়? যাই বল, আমরা যতই গর্ব করি লেখাপডা, জ্ঞানবিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতি-দর্শনের, পৃথিবী কখনই এঁদের দ্বারা শাসিত হয়নি। প্লেটো স্বপ্ন দেখেছিলেন একদিন দার্শনিকরা পৃথিবী শাসন করবে। তাঁর সে স্বপ্ন, স্বপ্নই রয়ে গেছে।’

রুহুলানু যখন এ রকম কথা বলে, তখন তাঁর চেহারায় দার্শনিকের গাম্ভীর্য, বিজ্ঞানীর অনুসন্ধিৎসা, আর সাহিত্যিকের সৃজনশীলতার এক মোহময় স্বপ্নীল আলো ফুটে ওঠে। তখন তাকে প্রশ্ন করে বাধা না দিয়ে পরবর্তী কথার জন্য অপেক্ষা করাই শ্রেয়। তিনি বলে চলেন, ‘‘তুমি তো সক্রেটিসের জবানবন্দি পডেছো। সমগ্র এথেন্সে একজন জ্ঞানীলোকের খোঁজে দীর্ঘ অভিযানের শেষে সারমেয়রের নামে শপথ করেই বলেছিলেন ’আমার এই অভিযানের ফল এই যে আমি দেখলাম যারা জ্ঞানী বলে খ্যাত, তাঁরাই সবচেয়ে অজ্ঞ বই আর কিছু নয়। অন্যদিকে, যারা কম জ্ঞানী বলে পরিচিত, তাঁরাই বরং অনেক উত্তম এবং সত্যিকারভাবে জ্ঞানী। আমার মনে হয় সক্রেটিস শেষ সত্য কথাটিই বলে গেছেন। কই, আজও স্থায়ীভাবে কোন জ্ঞানীলোকের শাসন কায়েম হল না। এই সত্য উচ্চারণের জন্যই সেদিন এথেন্সের শাসক ও অন্তঃসারশুন্য জ্ঞানপাপীদের বিচারে তাঁর প্রাণদণ্ড
হয়েছিল। তাঁর কাছে জিজ্ঞাসাশুন্য জীবন অর্থহীন বৈ কিছু নয়।’ তাইতো তাঁর আসন্ন মৃত্যুশোকাচ্ছন্ন কাতর বন্ধুদের প্রতি সহাস্যে বলতে পেরেছিলেন, ‘তোমরা কাঁদছো কেন? আমি এমন এক রাজ্যে যাচ্ছি, মৃত্যুর রাজ্য, যেখানে প্রশ্ন করার অপরাধে কেউ কাউকে হত্যা করে না।’ বলেছিলেন,’মৃত্যুর পরে তো মরণ নেই। মৃত্যুকে পার হয়ে আমি অমর হয়ে যাব।’
কী অসাধারণ ভবিষ্যতদ্রষ্টা? তাই না? ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মৃত্যুর পর থেকে তিনি আজও আমাদের কাছে কেবল জীবন্তই নন, তাঁকে ভাঙ্গিয়ে আমরা আজও জ্ঞানী-পণ্ডিত বলে পরিচিত হচ্ছি।
সত্যি কথা বলতে কি ১৯৫০ দশকে আমি প্লেটোর ডায়ালগ পড়েছিলাম। তেমন কিছু মনে থাকার কথা নয়।’’

কিন্ত রুহুলানু কথা প্রসঙ্গে স্বচ্ছতার সাথে সক্রেটিসের জবানবন্দি সম্পর্কে টানা বলে গেলেন। এই হচ্ছে রুহুলানু। কেউ তার জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের কথা বললে তিনি আড়ষ্ট হয়ে পড়েন, সংকুচিত হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেন। বলেন,’ না না, আমি তো একজন মুর্খ মানুষ।

সেদিন রুহুলানু তার encyclopaedia ফিরে পাবার কোন আশা নিয়ে যেতে পারেননি। ফিরে গিয়েই ফেরত ডাকে ৫০০ টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর বেশ কিছুদিন তার কোন খোঁজখবর পাইনি। নানা কাজে আমিও তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। ছোট্ট এক মফস্বল শহরে তিনি থাকেন। স্হানীয় সবাই তাকে চেনেন। স্কুল-কলেজের শিক্ষক, বাজারের প্রত্যেক দোকানদার, প্রতিটি রিক্সাওয়ালা, পোস্ট-অফিসের পিওন তো বটেই। তাই তার নাম ও শহরের নাম লিখে দিলে চিঠিটা ঠিক তার বাড়িতে পৌঁছুবে। সেখানে গিয়ে যেকোন রিক্সায় উঠে তার নাম বললেই সোজা নিয়ে যাবে। চিঠি লিখবো ভেবেছি। হয়ে ওঠেনি। এরই মধ্যে একদিন সন্ধায় আবার ফোনে ভেসে এল রুহুলানুর কন্ঠ। প্রথামত appointment করে বাসায় হাজির। হাতে পলিথিন ব্যাগ। একটু অবাকই হলাম। এভাবে আসা তার স্বভাব দুরস্ত নয়। ঘেমে গেছেন। জোরে ফ্যানটা চালিয়ে দিলাম। আরাম করে হাত-পা ছড়িয়ে বসে যেন হাঁফ ছেডে বাঁচলেন। ক্লান্ত দেখলাম তাকে।
জিজ্ঞেস করি,’শরীর ভাল তো?’ ঘাড় নেডে জানাল সুস্হ।
আবার জিজ্ঞেস করি’ পার্স ট্রেনে ফেলে আসেন নি তো?’

হো, হো করে হেঁসে উঠলেন। দেখি হাতে Time, Gold Flake সিগারেট, সিগারেট লাইটার ও পার্স। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। মনে হল নিজেকে গুছিয়ে নিতে কিছু সময় নিলেন। বৌদি ও ছেলেমেয়ের খবরাখবর নেবার পর তিনি পলিথিন ব্যাগ থেকে একটা সীলগালা করা প্যাকেট বের করলেন এবং বললেন, ’কিছু মনে করো না, তোমার জন্য আমার সারা জীবনের সন্চয় নিয়ে এলাম।’ আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
বললেন,’ দেখ, বয়স তো হয়ে গেল। বন্ধুরা সব একে একে এ জগতের পালা শেষ করে বিদায় নিতে শুরু করেছে। আমি পাইপ-লাইনে আছি। তাই ভাবলাম এগুলো কাকে দেয়া যায় যে এর মর্যাদা বুঝবে। সবদিক চিন্তা করে তোমাকে দেব বলে নিয়ে এলাম।’
আমি অবাক হলাম; সেইসাথে গর্বিত।

তিনি বললেন, ‘একাত্তরে এগুলো বুকে করেই পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি। এখন দুঃখ হয় encyclopaedia টাও যদি নিয়ে যেতাম।’
আমি বলি, ’ওগুলো তো অনেক ভারি হত।’
‘তাই ওগুলো চলে গেছে। এগুলো হারাতে দি নি। বুকের সঙ্গে আঁকডে রেখেছিলাম। তুমি এগুলো রাখ। ঠিক ডায়েরি নয়। আমার চিন্তার এলোমেলো, বিক্ষিপ্ত চিন্তার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। কিছু হয়নি। তবু নিয়ে এলাম। তোমার ভাষা দিয়ে যদি পার শুদ্ধ করে নিও। তবে একটা কথা আমার মৃত্যুর পর এগুলো বের করবে।’ বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন।
‘আমি আজ যাই। বাস ধরবো।’
আমি বলি, ’তা কি করে হয়? খাওয়া-দাওয়া করে যাবেন।’
‘না, না, তুমি তো জান আমি এ সময় কিছু খাই না।’

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেলা বারটা। মানে তিনি হোটেল থেকে এগারোটায় নাস্তা করেই বেরিয়েছেন। এখন তারে কিছুই খাওয়ানো যাবে না। তিনি চলে গেলেন। দরজার কাছে আমার হাতটা ধরে বললেন ’কিছু মনে করো না। আবার দেখা হবে।’ উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। তার মধ্যেও তার গলাটা যেন জডিয়ে এলো। তিনি নেমে গেলেন। তারজন্য নিচে দণ্ডায়মান রিক্সায় উঠে হাত নেড়ে বিদায় জানালেন। আমি তার অপসৃয়মান রিক্সার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলাম।

রিক্সা চোখের আড়ালে চলে গেল। আমি সিলগালা করা প্যাকেটটার দিকে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইলাম। মনে অন্তহীন প্রশ্ন আর অনুসন্ধিৎসা।” কী আছে এর ভিতর?”

রুহুলানু ৮৪ বছরে আজও বেঁচে আছেন। অতি যত্নে প্যাকেটটা রেখেছি।

শহিদুল ইসলাম

বাংলাদেশের যে মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবী জীবননিষ্ঠ মননের সদনুশীলনে আত্মনিয়োজিত, শহিদুল ইসলাম নিরলস চর্চার মধ্য দিয়ে নিজেকে সেই গোষ্ঠীর অন্যতম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে নিতে পেরেছেন। গত পাঁচ দশক ধরে তিনি লিখছেন। সমাজনীতি, রাষ্ট্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বিজ্ঞানমনস্কতা, শিক্ষা, শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে অনবরত লিখে চলেছেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।

তিনি স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন এক সমাজব্যবস্থার, অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থার যেখানে মানুষ পাবে মানুষের অধিকার। বিষয়গুলো নিয়ে তাঁর গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে। তিনি বিজ্ঞানের দর্শন নিয়েও গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করেন।

শহিদুল ইসলামের জন্ম ১৯৪০ সালে ১০ ফেব্রুয়ারি, পাবনার ঈশ্বরদীতে। তিনি সাঁড়া মাড়োয়ারি উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা, পাবনা এওয়ার্ড কলেজ থেকে আইএসসি, রাজশাহী কলেজ থেকে বিএসসি (অনার্স) এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করেন।

তিনি ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত রসায়ন বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষকদের একজন ছিলেন। ২০০০-২০০৩ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নবপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। ২০১৩-১৫ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু ইনস্টিটিউট অব লিবারেশন ওয়ার অ্যান্ড বাংলাদেশ স্টাডিজ এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। সম্পাদনা করেছেন 'সমাজ ও প্রগতি জার্নাল'।

তাঁর উল্লেখযোগ্য বই: শিক্ষাভাবনা, প্রসঙ্গ শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় ও স্বায়ত্তশাসন, আমরা কি ধরনের শিক্ষা চাই?, বিজ্ঞানের দর্শন, চিন্তার স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস, একাত্তরে বাংলাদেশের অভ্যুদয়, দেশভাগ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, জাতীয়তাবাদ: সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, সাম্প্রদায়িকতা রাষ্ট্র ও রাজনীতি, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ: মিথ ও বাস্তবতা, মৃত্যুহীন প্রাণ, শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধ।

২০১৩ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান।

বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি নিজকে নিয়োজিত করেছেন জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক নানা গবেষণায়।