অরাজ
প্রচ্ছদ » মুক্তিমুখিন নারীবাদী ইশতেহার

মুক্তিমুখিন নারীবাদী ইশতেহার

অনুবাদ: বর্ণা তারানা

মুক্তিমুখিন নারীবাদী ইশতেহার প্রণীত হয় নরওয়েতে। ১৯৮২ সালের ১ থেকে ৭ জুন নরওয়ে তে অনুষ্ঠিত হয় অ্যানার্কিস্ট ফেডারেশনের তৃতীয় কংগ্রেস। সেই কংগ্রেসে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত নারীবাদী রাজনৈতিক কর্মসূচির সারসংক্ষেপ এই ইশতেহার।

ইশতেহারটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালে। নরওয়েজীয় ভাষার সংবাদপত্র  Folkebladet এ। এর পরপরই ইশতেহারটি ফরাসি ভাষায় CRIFA এর মার্চ-এপ্রিল বুলেটিনে প্রকাশিত হয়। পরে ফরাসি ভাষা থেকে ইংরেজিতে রূপান্তর করে ইন্টারনেটে প্রকাশ করা হয়। ইশতেহারটি অন্যান্য ভাষাতেও অনুবাদ করা হয়েছে।

মুক্তিমুখিন নারীবাদী ইশতেহারের সহ-লেখক আনা কুইস্টের পক্ষ থেকে মুক্তিমুখিন নারীবাদী শুভেচ্ছা। CRIFA বুলেটিনে প্রকাশিত ফরাসি ভাষায় লেখা ইশতেহারের ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় রূপান্তর করা হয়েছে।

আর্টওয়ার্ক: টর্চ কমপাইল
আর্ট ব্লগ

ইশতেহার

সারাবিশ্বে অধিকাংশ নারীরই তাদের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো অধিকার নেই। নারীরা দুই ধরনের নিপীড়নের শিকার হন: ১) মানুষ হিশেবে সাধারণ সামাজিক নিপীড়ন এবং ২) দ্বিতীয়ত, লিঙ্গবাদ (sexism)-তাদের লৈঙ্গিক পরিচয়ের কারণে নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হন।

নিপীড়নের রূপ পাঁচটি:

  • মতাদর্শিক নিপীড়ন: নির্দিষ্ট সাংষ্কৃতিক ঐতিহ্য, ধর্ম, বিজ্ঞাপন এবং অপপ্রচার দ্বারা মগজ ধোলাই। বিভিন্ন ধারণার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিকৃত উপস্থাপন এবং নারীদের অনুভূতি ও সংবেদনশীলতা নিয়ে খেলা। সর্বব্যাপী পিতৃতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী মনোভাব এবং পুঁজিবাদী মানসিকতার বিস্তৃতি।
  • রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন: সাংগঠনিক কাঠামোর কর্তৃত্ব-ক্রমতান্ত্রিক বিন্যাস অর্থাৎ উপর থেকে নিচের দিকে প্রবাহিত হুকুম-আজ্ঞা; এমনকি তথাকথিত ব্যক্তিগত পরিসরের বেশিরভাগ আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও।
  • অর্থনৈতিক শোষণ ও পীড়ন: ঘরে ভোক্তা ও কর্মী হিশেবে এবং বাইরে একই কাজ [পুরুষের সমান মাত্রায়] করেও স্রেফ নারী হওয়ায় কম পারিশ্রমিক পাওয়ার মাধ্যমে।
  • সংহিসতা: সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত সহিংসতা এবং ব্যক্তিগত পরিসরে সাধারণত বিকল্পহীনতার দরুণ পরোক্ষ বলপ্রয়োগ ও শারীরিক অত্যাচারের শিকার হন নারীরা।
  • সংগঠনের অভাব: কাঠামোহীনতার অত্যাচার যা দায়বোধকে বিচূর্ণ করে দেয় এবং তৈরি করে দুর্বলতা ও নিষ্ক্রিয়তা।

এই বিষয়গুলো একইসাথে কাজ করে এবং একে অন্যকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে যুগপৎভাবে দুষ্টচক্রের ন্যায় ক্রিয়া করে। এই দুষ্টচক্র ভাঙার এখনো কোনো সর্বরোগহরা দাওয়াই নেই, আবার এটা ভাঙা যায় না এমনও নয়।

অর্টওয়ার্ক: ওমেন ফিলিং
শিল্পী: এনা গডেসি
সূত্র: আর্ট প্রজেক্ট

মুক্তিমুখিন নারীবাদ চেতনার বিষয়। এমন চেতনা, যা কাজের ক্ষেত্রে মুরুব্বিয়ানার ইতি টানে। ফলে সমাজকে মুক্ত করার নীতি- আমাদের কাছে পুরোপুরি উন্মোচিত হয়।

মুক্তিমুখিন-নারীবাদ মানে, পুরুষের সাথে সমানতালে তাল মিলিয়ে নারীর স্বাধীনতা ও মুক্তি। এমন এক সামাজিক সংগঠন এবং এমন এক সামাজিক জীবন যেখানে কেউ কারোর চেয়ে উৎকৃষ্ট কিংবা নিকৃষ্ট নয়। নারী ও পুরুষ নয় পরস্পরের অধীন। সামাজিক জীবন, এমনকি ব্যক্তিগত জীবনের সকলক্ষেত্র এই নীতি দ্বারা পরিচালিত হবে।

মুক্তিমুখিন নারীবাদ মানে, নারীরা নিজেরাই নিজেদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও দায়িত্ব নেবে। ব্যক্তিগত বিষয়ে নিজেই নিজের সিদ্ধান্তগ্রহীতা হবে এবং নারীর সমষ্টিগত বিষয়ে অন্যান্য নারীদের সাথে মিলে দলগতভাবে সিদ্ধান্ত নেবে। আর উভয় লিঙ্গের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়ের ক্ষেত্রে, নারী ও পুরুষ মিলে সমানভাবে সিদ্ধান্ত নেবে।

নিজের শরীর বিষয়ে নারীর অবশ্যই নিজের সিদ্ধান্ত থাকতে হবে। জন্মনিরোধ এবং সন্তান জন্ম দেয়ার মতো গুরুতর সিদ্ধান্ত নারীর নিজেকেই নিতে হবে।

পুরুষাধিপত্য, নারীর ওপর মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণের মনোভাব, দমনমূলক প্রতিক্রিয়াশীল আইনের বিরুদ্ধে এবং নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধীনতার জন্য- অবশ্যই ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক উভয় লড়াই জারি রাখতে হবে।

সংকট কেন্দ্র, দিবাযত্ন কেন্দ্র, পাঠ ও পর্যালোচনার দল, নারীদের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ইত্যাদি অবশ্যই গড়ে তুলতে হবে এবং নারীদের নিজস্ব ব্যবস্থায় তা পরিচালিত হতে হবে।

সম-অধিকারের ভিত্তিতে পুরুষ ও নারীর সিদ্ধান্তে গঠিত মুক্ত সংঘ দ্বারা প্রথাগত পিতৃতান্ত্রিক একক পরিবার প্রতিস্থাপিত হতে হবে। এই মুক্ত সংগঠন ব্যক্তির স্বায়ত্তশাসন ও পূর্ণতার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাবে।

শিক্ষা, গণমাধ্যম এবং কর্মক্ষেত্রে যৌনতা সম্পর্কে গতানুগতিক ধারণাসমূহের অবশ্যই নির্মূল করতে হবে। গড়পড়তা কাজ, গৃহস্থালি জীবন এবং শিক্ষায় উভয় লিঙ্গের মধ্যে বৈপ্লবিক সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্ব একটা উপায় হতে পারে।

আর্টওয়ার্ক: ফিয়ার
সূত্র: জ্যাঁ কুইক

আরও খন্ডকালীন কাজ এবং বাড়িতে ও সমাজে সুসংহত সহযোগিতার মাধ্যমে কর্ম জীবনের কাঠামোয় অবশ্যই আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। পুরুষ ও নারীর কাজের পার্থক্যকরণ বিলোপ করতে হবে। নার্সিং ও শিশুর যত্ন নেয়া নারীর মত পুরুষেরও বিষয় হতে হবে।

নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারী প্রধানমন্ত্রী কখনোই অধিকাংশ নারীর উদ্দেশ্য চরিতার্থ করবে না এবং নারীর ওপর নিপীড়নও বন্ধ হবে না। মার্কসবাদী ও বুর্জোয়া নারীবাদ- নারীমুক্তি সম্পর্কে বিভ্রান্তি তৈরি করছে। অধিকাংশ নারীর জন্য নৈরাজ্যবাদ ছাড়া নারীবাদ অর্থহীন। অন্যভাবে বলা যায়, মুক্তিমুখিন নারীবাদ- নারীর ক্ষমতায়ন বা নারী প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে ওকালতি করে না, এটা এমন এক সংগঠনপ্রণালী চায় সেখানে ক্ষমতা থাকবে না, প্রধানমন্ত্রী থাকবে না।

নারীর প্রতি দ্বৈত নিপীড়ন আসলে দ্বৈত লড়াই ও দ্বৈত জোটবদ্ধতা দাবি করে: এক দিকে নারীবাদী ফেডারেশন, অন্য দিকে নৈরাজ্যবাদের নীতিতে সংগঠিত হওয়া। মুক্তিমুখিন নারীবাদ এই দ্বৈত সংগঠনের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে।

নারীবাদ ছাড়া নৈরাজ্যবাদ আগাগোড়া পিতৃতান্ত্রিক আধা-নৈরাজ্যবাদ এবং সত্যিকারের নৈরাজ্যবাদ নয়। নৈরাজ্যরাদে নারীবাদী বৈশিষ্ট্য নিশ্চিত করা‌ই মুক্তিমুখিন নারীবাদীদের কাজ। নারীবাদ ছাড়া কোনো নৈরাজ্যবাদ নয়।

মুক্তিমুখিন নারীবাদের অপরিহার্য বিষয় হলো, পরিবর্তন আজ থেকেই শুরু হতে হবে, আগামিকাল নয় অথবা বিপ্লবের পর নয়। বিপ্লব হতে হবে স্থায়ী। দৈনন্দিন জীবনে নিপীড়ন চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে আমরা অবশ্যই আজই শুরু করবো এবং এই ছাঁচ ভাঙতে এখানে এবং এখনই কিছু করবো।

আমাদেরকে অবশ্যই স্বায়ত্তশাসিতভাবে কাজ করতে হবে; আমরা কি চাই এবং আমরা কি করবো সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার কোন নেতার হাতে অর্পন করা ছাড়াই। ব্যক্তিগত বিষয়গুলোতে আমরা অবশ্যই নিজেই সব সিদ্ধান্ত নেবো। একেবারেই নারীর একান্ত নিজস্ব বিষয়গুলো অন্য নারীদের সাথে মিলে সিদ্ধান্ত নেবো এবং সাধারণ বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে পুরুষ সহযাত্রীর সাথে মিলে সিদ্ধান্ত নেবো।

অরাজ