অরাজ
আর্টওয়ার্ক: রুলস অব সোসাইটি শিল্পী: স্যামুয়েলস গিলস সূত্র: সাৎসি আর্ট
প্রচ্ছদ » মিখাইল বাকুনিন।। মানুষ, সমাজ এবং স্বাধীনতা

মিখাইল বাকুনিন।। মানুষ, সমাজ এবং স্বাধীনতা

  • সহুল আহমদ

ভূমিকা:

মিখাইল বাকুনিনের জন্ম রাশিয়ায়, ১৮১৪ সালে। বাকুনিন ছিলেন একজন অ্যানার্কিস্ট, একজন দৃঢ়চেতা বিপ্লবী। বিপ্লবে তাঁর ছিল প্রগাঢ় আস্থা, বিশ্বাস করতেন ঘুরানো-পেঁচানো ঠুনকো কোনো নীতি দিয়ে বিদ্যমান শ্রেণি সংঘাতের প্রশ্নের সমাধান হবে না। এই বিশ্বাস থেকেই তাঁর জীবনের বিপুল কর্মশক্তির সমস্তটাই নিয়োজিত করেছিলেন বিপ্লবের কাজে। রুডলফ রকার এক মন্তব্যে বাকুনিনকে আধুনিক অ্যানার্কিস্ট আন্দোলনের স্রষ্টা বলে অভিহিত করেছিলেন। সকল অ্যানার্কিস্টের মতো তারও ছিল ‘সকল জবরদস্তিমূলক রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান থেকে মুক্ত একটা সমাজের আকাঙ্ক্ষা’। সমাজকে তাঁরা দিয়েছেন সর্বোচ্চ প্রাধান্য। নিচের প্রবন্ধটি বাকুনিন লিখেছিলেন ১৮৭১ সালে। সমাজের মধ্যে ব্যক্তির স্বাধীনতার স্বরূপ কি হবে তা-ই মূল বিষয়। বাকুনিন লিবারেল তাত্ত্বিকদের যুক্তি খণ্ডনের মাধ্যমে এগিয়েছেন। লিবারেল তাত্ত্বিকরা ব্যক্তি স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ব্যক্তিকে সমাজের পূর্ববর্তী ধরে নিয়েছিলেন, আর, বাকুনিন বলছেন যে, ব্যক্তি মূলত সমাজেরই সৃষ্টি। বাকুনিনের মতে, এই চিন্তাধারাই লিবারেল তাত্ত্বিকদের দিনশেষে রাষ্ট্রের রক্ষক বানিয়ে দেয়। রাষ্ট্রের খবরদারি সীমিত রাখার ব্যাপারে লিবারেলরা খানিকটা অ্যানার্কিস্টদের পাশে অবস্থান নিলেও, বাকুনিনসহ অন্য অ্যানার্কিস্টরা  এটিকে আরো এগিয়ে নিয়ে যান। তাঁরা চান সকল রাজনৈতিক ক্ষমতার সকল প্রতিষ্ঠানের বিলুপ্তি। তাই, লিবারেলরা যখন বলেন, সেই সরকারই ভালো যে সরকার শাসন করে কম, বিপরীতে অ্যানার্কিস্টরা বলেন, সেই সরকারই ভালো যে সরকার কোনো শাসনই করে না।

মিখাইল বাকুনিন
(১৯১৪-১৮৭৬)

বাকুনিন বলেন, ব্যক্তি যেহেতু সমাজেরই সৃষ্টি, সেহেতু মানুষ ব্যক্তিস্বাধীনতা উপলধ্বি করতে পারে কেবল সমাজের মধ্যে থেকেই। সমাজের তাঁর মতো অন্যান্যদের স্বীকৃতির মাধ্যমেই সে পাবে চূড়ান্ত স্বাধীনতা। সমাজের একটা বিরাট অংশকে পদানত ও দাসত্বের মধ্যে রেখে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব না।  সমাজে বসবাস করার মাধ্যমেই মানুষ তাঁর নিজের ও মানবিকতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। সমাজের বাদবাকি সকলের উপস্থিতিতে ও পারষ্পরিক সম্পর্কের মাধ্যমেই ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায়। এই যে স্বাধীনতার কথা বলা হচ্ছে সেটির মধ্যে বাকুনিন দুইটা উপাদানের কথা উল্লেখ করেন। প্রথম উপাদান হচ্ছে, এটি সম্পূর্ণ সামাজিক, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, এই স্বাধীনতা নেতিবাচক। নেতিবাচক হচ্ছে এই অর্থে যে, এটি সকল ধরনের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। সকল রকম কর্তৃত্বকে নাকচ করে দেয়। এই কর্তৃত্ব যেমন ধর্মের, মানে ঈশ্বরের স্বৈরশাসনের , তেমনি মানুষের স্বৈরশাসনের। চার্চকে যেমন বাতিল করে দেয়, তেমনি রাষ্ট্রকেও। অ্যানার্কিস্টদের মতে, রাষ্ট্র তা সে যে তন্ত্রীই হোক না কেনো, স্বৈরতন্ত্রকে আঁকড়ে থাকুক বা সংবিধানকে বুকে রাখুক, তবু তার কার্যাবলী সর্বদা একই থেকে যায়। খারাপ মানুষের স্থলে ভালো মানুষ চলে এলেই রাষ্ট্র বিষয়টা ‘নিপাট ভদ্রলোক’ হয়ে যায় না। রাষ্ট্র সবসময় টিকে থাকে গণশোষণ ও অল্প কিছু মানুষের বিশেষাধিকারের মাধ্যমেই।

আলোচ্য প্রবন্ধে বাকুনিন সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে একটা ফারাক করেন, একটিকে তিনি স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক হিসেবে হাজির করেন, অন্যটিকে রাজনৈতিক ও আরোপিত রূপে। তবে এই প্রবন্ধে তাঁর আলোচনা যতটা না এই ভেদকে কেন্দ্র করে ছিল, তাঁর চেয়ে বেশি ছিল সমাজ কীভাবে ব্যক্তির ওপর তাঁর স্বাভাবিক ও সহজাত প্রভাব বিস্তার করে সে দিকে। একেবারে সহজ-সরল ভাষায় সমাজের গতিপথ নির্ণয় করেছেন। বাকুনিন বলেন, রাষ্ট্র যেখানে কাজ করে জোরজবরদস্তি ও একচেটিয়া ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে, সমাজ সেখানে কাজ করে মমত্ববোধ ও পারষ্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে। এমনকি রাষ্ট্র যখন ভালো কিছু করার জন্যে আইনত বাধ্য করে সেটার ফলও খারাপই হয়, কেননা, মানুষ কোনো ধরনের চাপে ভালো কাজ করে না, বরং, সে ভালো কাজ করে কারণ সে তা স্বাধীনভাবেই পছন্দ করে, সে তা চায় বলেই, সে তা ভালোবাসে বলেই। বাকুনিনের মতে, ব্যক্তির বস্তুগত, বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক সকল ধরনের উন্নতির চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে সমাজের মধ্যে। ব্যক্তির স্বাধীনতার মূল জমিনই হচ্ছে সমাজ।

দুনিয়াজুড়ে যে পরিস্থিতি বর্তমান সেটাই বোধহয় রাষ্ট্র-সমাজ-স্বাধীনতা বিষয়ে অ্যানার্কিস্টদের দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করতে আমাদের উৎসাহ দিচ্ছে। বাকুনিনের এই  প্রবন্ধের অনুবাদ খুব সম্ভব সেই তাগিদ থেকেই। প্রবন্ধের হদিস পেয়েছি মার্ক্সিস্ট অনলাইন আর্কাইভ থেকে। অনুবাদ বিষয়ক যে কোনো মতামত কাম্য।

মূল প্রবন্ধ 

লিবারেল তাত্ত্বিকরা, যারা ব্যক্তিস্বাধীনতার জমিনে দাঁড়িয়ে যুক্তি দেখিয়ে থাকেন, তারা নিজেদেরকে রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ হিসেবে জাহির করেন। তাদের মধ্যে যারা মানেন যে সরকার, মানে, রাষ্ট্রের কাজ সম্পাদনের জন্যে মনোনীত এবং সুসংগঠিত একটি কার্যনির্বাহী দেহ হচ্ছে প্রয়োজনীয় মন্দ (necessary evil), এবং মানেন যে রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যাবলী ও অধিকারগুলোকে ক্রমাগত কমানোর মধ্যেই সভ্যতার অগ্রগতি নিহিত, তাদের মধ্যে অসংগতি আছে। তত্ত্ব তো এমন, কিন্তু চর্চার ক্ষেত্রে এই একই লিবারেল তাত্ত্বিকরা যখন দেখেন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বা স্থিতিশীলতা মারাত্মক হুমকির মুখে, তখন তারা রাজতন্ত্রী এবং জ্যাকোবিনদের মতো রাষ্ট্রের গোঁড়া রক্ষাকর্তা হিসেবে হাজির হোন।

রাষ্ট্রের প্রতি তাদের এই যে আনুগত্য, যা তাদের লিবারেল নীতির সাথে সুনির্দিষ্ট-রূপে সাংঘর্ষিক, তা দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। বাস্তবে,  তাদের শ্রেণি স্বার্থগুলি  প্রচুর সংখ্যক লিবারেল তাত্ত্বিককে বুর্জোয়া দলের সদস্যে পরিণত করে। এই শ্রেণি শুধু নিজেদের জন্যেই একচেটিয়া অধিকার এবং পূর্ণ ক্ষমতার বিশেষাধিকার দাবি করে। তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের আর্থসামাজিক ভিত্তি laissez faire এবং  laissez aller – এই দুই বিখ্যাত বাক্যাংশে প্রকাশিত অবারিত স্বাধীনতার যে নীতি তার চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। কিন্তু তারা এই নৈরাজ্য শুধু তাদের জন্যেই চায়, জনগণের জন্যে নয়। কেননা, তাদের মতে জনগণকে রাষ্ট্রের কঠোর শৃঙ্খলার অধীনেই রাখা উচিৎ কারণ অপব্যবহার না করে এই নৈরাজ্য উপভোগ করতে জনগণ একেবারেই অজ্ঞ। এটি বলা হয় কারণ, যদি জনসাধারণ অন্যের জন্যে কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বিদ্রোহ করে, তাহলে সমগ্র বুর্জোয়া কাঠামোই ভেঙ্গে পড়বে। সবসময় এবং সবজায়গাতেই, যখন জনসাধারণ অস্থির হয়ে ওঠে, তখন এমনকি সবচেয়ে উৎসাহী লিবারেলও অবিলম্বে বিপরীত দিকে  হাটা শুরু করেন এবং সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের সবচেয়ে গোঁড়া রক্ষক বনে যান।

এই বাস্তবিক কারণের পাশাপাশি, এখানে আরেকটা তাত্ত্বিক দিকও আছে যা কিনা সবচেয়ে আন্তরিক লিবারেলকে রাষ্ট্র-পূজার দিকে ঠেলে দেয়। তারা নিজেদেরকে লিবারেল দাবি করেন কারণ সমাজ উদ্ভবের তাদের তত্ত্ব ব্যক্তিস্বাধীনতার নীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ঠিক এই কারণেই তারা অবধারিতভাবে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব মেনে নেন।

তাদের মতে ব্যক্তিস্বাধীনতা সমাজের ঐতিহাসিক ফসল নয়। বিপরীতে তারা মনে করেন যে, ব্যক্তিস্বাধীনতা সকল সমাজের পূর্ববর্তী এবং সবাই   ঈশ্বর প্রদত্ত এক অমর আত্মা দ্বারা অধিষ্ঠিত। তদনুসারে মানুষ সমাজ থেকে আলাদা এবং সমাজের বাইরের এক সম্পূর্ণ সত্ত্বা, একেবারেই স্বাধীন। একজন  মুক্ত প্রতিনিধি (agent)  হিসেবে এবং সমাজের পূর্ববর্তী ও সমাজ থেকে আলাদা একজন হিসেবে মানুষ নিজের সমাজ গঠন করে একধরনের চুক্তির মাধ্যমে; তা সেই চুক্তি স্বতঃস্ফূর্ত হোক বা সচেতনই হোক, মৌনসম্মতিতে হোক বা আনুষ্ঠানিকই হোক। সংক্ষেপে, এই তত্ত্বানুসারে, ব্যক্তি সমাজের ফসল নয়, বরং উল্টো ব্যক্তিই বিভিন্ন কাজ বা যুদ্ধের মতো কিছু প্রয়োজনীয়তার খাতিরে এই সমাজ তৈরি করেছে।

এই তত্ত্ব অনুযায়ী এও মেনে নেয়া হয় যে, সমাজের অস্তিত্ব নেই। স্বাভাবিক মানব সমাজ, সকল সভ্যতার সূতিকাগার ও একমাত্র প্রতিবেশ হিসেবে যেখানে ব্যক্তিত্ব এবং ব্যক্তির স্বাধীনতা গড়ে ওঠে ও বিকশিত হয় তা তাদের জন্যে অস্তিত্ব-মান নয়।  একদিকে, এই তত্ত্ব শুধু বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বসবাস করা স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যক্তিকেই স্বীকৃতি দেয়। অন্যদিকে এই তত্ত্ব ব্যক্তির ইচ্ছায়, এবং আনুষ্ঠানিক অথবা মৌনসম্মতির ভিত্তিতে সৃষ্ট সমাজকে, অর্থাৎ, রাষ্ট্রকেই স্বীকৃতি দেয়। (তারা খুব ভালো করেই জানে যে ইতিহাসে এমন কোনো রাষ্ট্র নেই যা চুক্তির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে, এবং তারা এও জানে যে সকল রাষ্ট্রই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দখলবাজি ও সহিংসতার মাধ্যমে।)

যেসব ব্যক্তিদের নিয়ে এই রাষ্ট্র গঠিত তাদেরকে এই তত্ত্ব যেভাবে দেখে তা পুরোপুরি পরষ্পরবিরোধিতায় ভর্তি। একদিকে বিবেচনা করা হয় যে, প্রত্যেকের মধ্যে স্বাধীন ইচ্ছার (free will) একটি অমর আত্মা প্রোথিত আছে। সবাই স্বয়ংসম্পূর্ণ অ-শৃঙ্খলিত সত্ত্বা এবং তাদের কারো দরকার নেই, এমনকি ঈশ্বরেরও দরকার নেই। আত্মার অমরত্বের জন্যে তারা নিজেরাই নিজেদের ঈশ্বর। অন্যদিকে, তারা নিষ্ঠুর, দুর্বল, অসম্পূর্ণ, সীমাবদ্ধ, এবং প্রকৃতির শক্তির সম্পূর্ণ অধীন যা তাদের পরিবেষ্টন করে এবং ধীরে ধীরে তাদেরকে কবরের দিকে নিয়ে যায় …

জনসাধারণের পার্থিব অস্তিত্ব তাদের এতো হীন ও দুর্দশাগ্রস্থরূপে হাজির করে, উদ্দীপনায়, ইচ্ছায় এবং উদ্যোগে এতো দুর্বলরুপে হাজির করে যে তাদের মধ্যে কোনো অমর আত্মা বা স্বাধীন ইচ্ছার ন্যূনতম কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তারা সম্পূর্ণ নির্ধারিত (determined) রূপে হাজির হয়। তারা বহিরাগত শক্তি, নক্ষত্র, এবং তাদের জীবনের সকল বস্তুগত শর্ত দ্বারা নির্ধারিত; তারা আইন দ্বারা এবং বিগত শতাব্দীর যাবতীয় চিন্তা ও কুসংস্কার দ্বারা নির্ধারিত; এসব তার জন্মের পরপরই তার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে প্রস্তুত থাকে। এই বিপুল সংখ্যক ব্যক্তি, শুধু অজ্ঞ জনসাধারণই নয় বরং তাদের মধ্যে সবচেয়ে সভ্য ও সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির ব্যক্তিও ঠিক তাই চিন্তা করে ও চায় যা তাদের চারপাশের সবাই চিন্তা করে ও চায়। তারা সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বাস করে যে তারা তাদের জন্যে চিন্তা করছে, কিন্তু তারা আসলে অন্যান্য অনুগামীদের যে চিন্তা ও লক্ষ্য যা তারা ক্রমশ গ্রহণ করেছে তা-ই হালকা অদলবদল করে দাসোচিত পুনরাবৃত্তিই করছে। এই গোলামি, এই নিত্যকর্ম, বিদ্রোহ করার ইচ্ছার এই দীর্ঘ অনুপস্থিতি এবং উদ্যোগ ও স্বাধীন চিন্তার অভাবই হচ্ছে মানবতার মন্তর ঐতিহাসিক বিকাশের মূল কারণ। আমরা যারা বস্তুবাদী (materialists) এবং বাস্তববাদী (realists), যারা কোনো আত্মার অমরত্ব বা স্বাধীন ইচ্ছার উপর বিশ্বাস রাখি না, আমাদের জন্যে এই মন্থরতা – তা যতোই ধ্বংসাত্মক হোক – একটা প্রাকৃতিক বাস্তবতা (natural fact)। গরিলা অবস্থা থেকে উত্থানে মানুষ প্রচুর বাধা ডিঙিয়ে তার মানবতার চেতনা এবং স্বাধীনতা অর্জন করেছে। … তার জন্ম হয় একটি বন্য পশু ও দাসরূপে, এবং ক্রমান্বয়ে সে নিজেকে মানবিক (humanized) এবং মুক্ত (emancipated) করে কেবল সমাজের মধ্যেই যা অপরিহার্যভাবে তার চিন্তা, ভাষা এবং ইচ্ছারও পূর্ববর্তী। সে এই মুক্তি অর্জন করতে পারে কেবল সমাজের বর্তমান ও অতীতের সকল সদস্যের সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে। এই সমাজই তার মানব অস্তিত্বের সহজাত সূচনার উৎস।

আর্টওয়ার্ক: ম্যান
শিল্পী: মকবুল ফিদা হুসেন
সূত্র: পিনটারেস্ট

মানুষ তার ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্বকে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারে কেবল তার চারপাশের ব্যক্তিদের মাধ্যমে, এবং সেটা শ্রম ও সমাজের যৌথ ক্ষমতার কারণেই। সমাজ না থাকলে সে সকল বন্য পশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকুব ও দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় থাকতো … সমাজ, তার স্বাধীনতা কমানো দূরে থাক, বরং উল্টো সমস্ত মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা তৈরি করে দেয়। সমাজ হচ্ছে মূল, গাছ। স্বাধীনতা হচ্ছে তার ফল। তাই, প্রত্যেক যুগেই, মানুষকে তার স্বাধীনতা খুঁজতে হয়েছে শুরুতেই নয়, বরং, ইতিহাসের শেষে। এটা বলা যায়, ইতিহাসের প্রকৃত, মহান, সর্বোচ্চ লক্ষ্য হচ্ছে প্রত্যেক ব্যক্তির সম্পূর্ণ মুক্তি …

আদর্শবাদীদের ধারণার বিপরীতে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার বস্তুবাদী (materialistic), বাস্তববাদী (realistic) এবং যৌথতাবাদী (collectivist) মতটি হচ্ছে এই: মানুষ নিজের ও তার মানবতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে কেবল সমাজের মধ্যেই এবং কেবল সমগ্র সমাজের যৌথ কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে। সে নিজেকে বহিরাগত প্রকৃতির জোয়াল থেকে মুক্ত করে কেবল যৌথ এবং সামাজিক শ্রমের মাধ্যমে, যা একাই পৃথিবীটাকে মানবতা  বিকাশের উপযোগী আবাসস্থলে রূপান্তর করতে পারে। এমন বস্তুগত মুক্তি ব্যতীত ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক মুক্তি অসম্ভব। সে নিজেকে তার নিজ-স্বভাবের জোয়াল থেকে মুক্ত করতে পারে, যেমন, মনের ইচ্ছানুযায়ী  নিজের সহজাতপ্রবৃত্তি ও নিজ শরীরে গতিবিধিকে অধীন করতে পারবে; এই মনের  বিকাশ আবার প্রতিপালিত হয় কেবল শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই। কিন্তু, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রধানত এবং একচেটিয়াভাবে সামাজিক… তাই বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি সম্ভবত তার স্বাধীনতা সম্পর্কে সচেতন হতে পারেনা।

মুক্ত হওয়া… মানে সহকর্মীদের দ্বারা অনুরূপ স্বীকৃতি এবং আচরণ পাওয়া। প্রতিটি ব্যক্তির স্বাধীনতা কেবল তার নিজস্ব মানবতার প্রতিফলন, অথবা তার ভাই ও তার মতো সমান সকল মুক্ত মানুষের চেতনার মাধ্যমে অর্জিত নিজস্ব মানবিক অধিকারের প্রতিফলন।

আমি স্বাধীনতা উপলব্ধি করতে পারব কেবল অন্যান্য মানুষের উপস্থিতি ও তাদের সাথে সম্পর্কের মাধ্যমে। নিকৃষ্ট প্রজাতির কোনো প্রাণীর উপস্থিতিতে আমি না নিজেকে মুক্ত বলতে পারব না মানুষ বলতে পারব, কারণ এই প্রাণী আমার মানবতা চিনতে এবং স্বীকৃতি দিতে অক্ষম। আমি নিজে মুক্ত হতে পারবো না যতক্ষণ না পর্যন্ত আমার সকল সহকর্মীর স্বাধীনতা ও মানবতাকে স্বীকার করতে পারি।

তাদের মানবিক চরিত্রকে সম্মান জানিয়েই কেবল আমি আমাকে সম্মান জানাই। যে রাক্ষস তার বন্দিকে খেয়ে ফেলে … সে মানুষ নয়, পশু। একজন দাস-মালিক মানুষ নয়, বরং প্রভু। দাসের মানবতাকে অস্বীকার করার মাধ্যমে সে আসলে নিজের মানবিকতাকেই বাতিল করে দেয়, যেমন সকল প্রাচীন সমাজের ইতিহাস তাই প্রমাণ করে। গ্রীক এবং রোমানরা স্বাধীন মানুষের মতো অনুভব করতে পারে নাই। তারা মানবিক অধিকারের দ্বারা নিজেদের এমনভাবে চিন্তা করে নাই। গ্রীক ও রোমানরা যখন অপরাজেয় ছিল এবং অন্যান্য দেশ জয় করছিল তখন তারা বিশ্বাস করতো তাদের এবং তাদের নিজেদের দেশের বিশেষাধিকারে ।  কারণ তারা বিশ্বাস করেছিল তারা নিজেদের জাতীয় দেবতার বিশেষ সুরক্ষার আওতায় আছে। তারা ভাবতেই পারেনি যে তাদের বিদ্রোহ করার অধিকার ছিল … এবং নিজেদেরকে দাসত্বের মধ্যেই ফেলেছিল…

আমি প্রকৃতপক্ষে তখনই মুক্ত হবো যখন সকল মানুষ, পুরুষ ও নারী, সমানভাবে মুক্ত হবে। অন্য মানুষের স্বাধীনতা, আমার স্বাধীনতাকে বাতিল করা বা সীমিত করা দূরে থাক, উল্টো বরং এটাই আমার স্বাধীনতার আবশ্যিক পূর্বানুমান এবং নিশ্চিতকরণ। অন্যের দাসত্ব আমার স্বাধীনতায় প্রতিবন্ধকতা প্রতিষ্ঠা করে, অথবা সমানভাবে বলা যায়, অন্যের পাশবিকতা আমার মানবিকতাকে বাতিল করে দেয়।  আমার মানবিক অধিকার অন্যের গোলামি করাকে প্রত্যাখ্যান করার মধ্যে এবং দৃঢ়তার সাথে নিজের কাজ নির্ধারণ করার মধ্যে নিহিত।  তাই, আমার মানবিক মর্যাদা  সকলের অবিশেষ মুক্ত চেতনা ও সকল মানুষের সম্মতিক্রমে নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। সবার স্বাধীনতার দ্বারা স্বীকৃত আমার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অনন্ত প্রসারিত।

সুতরাং, মুক্তির বস্তুগত ধারণাটি খুবই ইতিবাচক, অনেক বেশি জটিল এবং সবচেয়ে বড় কথা, অতিরিক্ত পরিমাণে সামাজিক, কারণ একে শুধুমাত্র সমাজের মধ্যে থেকেই মানুষের মাঝে বিরাজমান কঠোর সাম্য ও সহযোগিতার মাধ্যমে বুঝা সম্ভব। মুক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে মূল উপাদানগুলোকে পৃথক করা সম্ভব। প্রথমটি অতিরিক্ত সামাজিক। আর তা হচ্ছে শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ, এবং বস্তুগত উন্নতির মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের সমস্ত শক্তি ও ক্ষমতার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ। যেই জিনিসগুলো সাধারণত সমাজের প্রতিটি ব্যক্তি-মানুষ পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব কেবল সমাজের সামষ্টিক, বস্তুগত, বুদ্ধিবৃত্তিক, দৈহিক ও অদৈহিক শ্রমের দ্বারা।

স্বাধীনতার দ্বিতীয় উপাদান হচ্ছে নেতিবাচক। এটি সকল প্রকার ঐশ্বরিক, যৌথ ও একক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে ব্যক্তির বিদ্রোহ।

প্রথম বিদ্রোহ হচ্ছে ধর্মতত্ত্বের সর্বোচ্চ স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে, ঈশ্বরের অলীক ধারণার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। যতক্ষণ বেহেশতে আমাদের একজন প্রভু থাকবেন, ততক্ষণ আমরা দুনিয়াতে তার দাস থাকবো। আমাদের যুক্তি এবং আমাদের ইচ্ছা সমানভাবে বাতিল হয়ে যাবে। যতক্ষণ আমরা বিশ্বাস করবো যে আমাদের নিঃশর্ত গোলামি করতে হবে – এবং,  ঈশ্বরের  মতো আর কারো আনুগত্য সম্ভব নয় – ততক্ষণ আমাদের কোনো ন্যূনতম সংরক্ষণ ছাড়াই তার পবিত্র ও অপবিত্র  এজেন্ট, মসিহ, পয়গম্বরগণ, ঐশ্বরিক আইন-প্রণেতা, সম্রাট এবং রাজাদের পবিত্র কর্তৃত্বের কাছে নিজেকে সপে দিতে হবে। নিজেকে সপে দিতে হবে চার্চ ও রাষ্ট্র নামক দুইটা বিশাল প্রতিষ্ঠানের সকল মিনিস্টার, প্রতিনিধি  এবং পবিত্র পরিচারকদের কাছে, যা ঈশ্বরকর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মানুষকে শাসন করার নামে এবং আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। সমস্ত সাময়িক অথবা মানব কর্তৃত্বের ডালপালা সরাসরি আধ্যাত্মিক এবং/অথবা ঐশ্বরিক কর্তৃত্ব থেকে গজায়। কিন্তু, কর্তৃত্ব মানেই স্বাধীনতার অস্বীকৃতি। ঈশ্বর অথবা ঈশ্বরের কল্পনাই হচ্ছে পৃথিবীর সকল দাসত্বের বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক এবং জায়েজীকরণের উৎস। মানবজাতির স্বাধীনতা কখনোই সম্পূর্ণ হবে না যদি না এই ধ্বংসাত্মক ও ছলনাপূর্ণ প্রভুকে বিলুপ্ত করা হয়।

এই বিদ্রোহ স্বাভাবিকভাবে অনুসৃত হয় মানুষের-স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দ্বারা; সেই স্বৈরশাসন যেমন ব্যক্তির হতে পারে, তেমনি হতে পারে সমাজের, হতে পারে রাষ্ট্র কর্তৃক বৈধ প্রতিনিধিত্বকারীর। এই স্থলে, রাষ্ট্র হিসেবে সংগঠিত সমাজের অফিসিয়াল ও  স্বৈরাচারী বিশেষ ক্ষমতা এবং নন-অফিসিয়াল, অকৃত্রিম সমাজের সদস্যদের সহজাত প্রভাব ও ক্রিয়া –  এই দুয়ের মধ্যে একটা সুনির্দিষ্ট পার্থক্য তৈরি করতে হবে।

রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিকভাবে সংগঠিত সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার তুলনায় এই প্রাকৃতিক সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ব্যক্তির পক্ষে অনেক বেশি কঠিন।  সামাজিক স্বৈরশাসন প্রায়শই অপ্রতিরোধ্য ও সর্বনাশা হলেও সে আইনসম্মত ও  বৈধ স্বৈরতন্ত্রের সহিংস বাধ্যতামূলক চরিত্র গ্রহণ করে না, যা মূলত রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের চিহ্ন বহন করে। এটি আইনের রূপে আরোপিত হয় না যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি বিচার-বিহিত দণ্ডের যন্ত্রণায় নিজেকে সমর্পণ করতে হয়। সামাজিক স্বৈরশাসনের কর্মকাণ্ড তুলনামূলক-ভাবে নমনীয়, আরো বেশি কুটিল এবং সূক্ষ্ম হলেও রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের চেয়ে কোন অংশে কম শক্তিশালী ও ব্যাপক নয়।  এটি মানুষকে শাসন করে প্রথা, আচার-আচরণ, জনসাধারণের পূর্বধারণা, প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যাস দ্বারা, যাকে একসাথে জনমত (Public Opinion) বলে অভিহিত করা হয়।

এটি ব্যক্তিকে জন্ম থেকেই আচ্ছন্ন করে রাখে,  জীবনের প্রতিটি দিকে প্রবেশ করে, যাতে প্রত্যেক ব্যক্তিই প্রায় অজ্ঞাতসারেই নিজের বিরুদ্ধেই একধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এর থেকে এটাই বোঝা যায় যে, সমাজ প্রাকৃতিক-ভাবে যে প্রভাব ব্যক্তির উপর বিস্তার করে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে হলে তাকে অন্তত কিছুটা হলেও নিজের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করতে হবে। তার সকল সহজাত প্রবণতা এবং বস্তুগত, বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক আকাঙ্ক্ষার কারণেই সে সমাজের ফসল ছাড়া আর কিছুই নয়। সমাজ যে ব্যক্তির উপর অপরিমেয় ক্ষমতা খাটায় তা এতেই নিহিত থাকে।

পরম নৈতিকতার  দৃষ্টিকোণ থেকে, যেমন মানব মর্যাদা, সমাজের এই ক্ষমতা যেমন হিতকর হতে পারে তেমনি ক্ষতিকরও হতে পারে। এটি তখনই উপকারী যখন তার ঝোঁক বিজ্ঞান, বস্তুগত সমৃদ্ধি, স্বাধীনতা, সাম্য ও সংহতির ক্রমবিকাশের প্রতি থাকে। এটা ক্ষতিকর তখনই যখন তার ঝোঁক বিপরীত দিকে থাকে। যে ব্যক্তি বর্বর জন্তুদের মাঝে জন্মায় তার ঝোঁক থাকে বর্বরতার দিকেই; যে যাজক শাসিত সমাজে জন্মায় সে নির্বোধ ভণ্ড ধর্মধ্বজীই হয়; যে চোরদের দলে জন্মায় সে বোধহয় চোরই হয়ে থাকে; এবং যদি দূর্ভাগ্যবশতভাবে সে রাজা-বাদশাহর মতো উপদেবতার (demigods) সমাজে জন্মে যারা পৃথিবীকে শাসন করে, তাহলে সে সমাজের ঘৃণ্য অত্যাচারী শাসকই হবে। এই সকল ক্ষেত্রেই যে সমাজে তার জন্ম হয়েছে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাটা ব্যক্তির মানবীকরণের জন্যে অপরিহার্য।

কিন্তু, আমি আবারো বলছি, সমাজের বিরুদ্ধে ব্যক্তির বিদ্রোহ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের চেয়েও কঠিন। রাষ্ট্র তার ভাতৃপ্রতিম সংগঠন চার্চের মতো একটি ক্ষণস্থায়ী, ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান যে একটি সংখ্যালঘুর বিশেষাধিকারের নিয়ন্ত্রক এবং অধিকাংশের গোলামীর জন্যে দায়ী।

রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা অনেক কম কঠিন কারণ রাষ্ট্রের চরিত্রের মধ্যেই এমন কিছু আছে যা বিদ্রোহে প্ররোচিত করে। রাষ্ট্র হচ্ছে কর্তৃত্ব, শক্তি। শক্তির সাথে থাকে দম্ভ এবং প্রমত্ততা। এটি নিজেকে ধীরে ধীরে সুকৌশলে প্রবেশ করায় না। এটি পরিবর্তিত হতে চায় না। সময়ে সময়ে এটি যদি নিজের শাসনের উন্নতি ঘটাতে চায় তাহলে সেটা খারাপভাবেই করে। পটানো তার চরিত্রে নেই, বরং, সে নিজেকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমেই চাপিয়ে দেয়। নিজেকে মুখোশ পরাতে যতই কষ্ট হোক না কেনো, এটি স্বভাবতই মানুষের ইচ্ছার বৈধ লঙ্ঘনকারী. তাদের স্বাধীনতাকে স্থায়ীভাবে নাকচ করে দেয়। এমনকি যখন রাষ্ট্র ভালো কিছু আদেশ দেয়, সে আসলে খারাপকে নিয়ে আসে। এর প্রতিটি আদেশ স্বাধীনতার গালে চপেটাঘাত-স্বরূপ। কারণ যখন ভালোকে আইন জারি করে আদেশ দেয়া হয়, তখন মানবিক নৈতিকতা ও স্বাধীনতার পরিপ্রেক্ষিতে এটি খারাপে পরিণত হয়।  ব্যক্তির স্বাধীনতা, নৈতিকতা এবং মানবিক মর্যাদা এর মধ্যে নিহিত থাকে যে, সে ভালো কাজ করে এই জন্যে না যে সে এটি করতে বাধ্য, বরং এই জন্যে করে যে সে স্বাধীনভাবে এটি ধারণ করে, এটি চায় এবং এটিকে ভালোবাসে।

সমাজের কর্তৃত্ব ইচ্ছামত বা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রয়োগ হয় না, বরং স্বাভাবিকভাবে হয়। এবং এই বাস্তবতার কারণে ব্যক্তির উপর এটির প্রভাব রাষ্ট্রের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। এটি তার মধ্যেই সকল ব্যক্তিকে তৈরি করে এবং তার ছাঁচে গড়ে তোলে। ব্যক্তির জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত সমাজ তার সকল বস্তুগত, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নৈতিক বৈশিষ্ট্য ব্যক্তির মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। সুতরাং, একরকমভাবে বলতে গেলে প্রত্যেক ব্যক্তির মাঝে সমাজ তার নিজেকেই স্বতন্ত্র-রূপে প্রকাশ করে।

ব্যক্তি তার মায়ের গর্ভে থাকাকালীন অবস্থা থেকেই ভৌগলিক, জলবায়ু, জাতিগত, স্বাস্থ্যগত এবং অর্থনৈতিক প্রভাবের মিলনের ফলে পূর্বনির্ধারিত ও বিশেষায়িত হয়ে যায় যেগুলো তার পরিবার, তার শ্রেণি, তার জাতি, তার বর্ণ গঠন করে। এসব বহিরাগত ও ভৌত প্রভাবের মিলনের ফলে সৃষ্ট তাঁর প্রবণতা অনুসারে সে গঠিত হয়।

তাছাড়া, মানব মস্তিষ্কের তুলনামূলক-ভাবে  উচ্চতর গঠনের ফলে, প্রতিটি ব্যক্তি জন্ম থেকেই বিভিন্ন মাত্রায় কিছু বিষয় উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে থাকেন। সেটা কোনো চিন্তা ও সহজাত অনুভূতি নয় যেমন আদর্শবাদীরা দাবি করে থাকেন, বরং ব্যক্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে থাকেন অনুভব করার শক্তি, ইচ্ছাশক্তি, চিন্তা করার শক্তি এবং কথা বলার শক্তি। কোনো সারবস্তু ছাড়াই অবিকশিত ব্যক্তি থাকে । তাদের সারবস্তু কোথা হতে আসে? সমাজ থেকে … চিন্তার প্যাটার্নে সমবেত হওয়া ধারণাসমূহ, তথ্যাবলি এবং ঘটনাসমূহ, ভালো অথবা মন্দ, এইসব এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তির মধ্যে প্রেরিত হয়। সমাজের সকল ব্যক্তি সদস্য ও গোষ্ঠী দ্বারা এইসব সংশোধিত, সম্প্রসারিত, পারষ্পরিকভাবে প্রশংসিত ও সংহত হয়ে এমন একটা অনন্য ব্যবস্থা গড়ে উঠে যা পরিশেষে একটি সমাজের সাধারণ চেতনা ও যৌথ চিন্তাকে গঠন করে।  এই সব কিছু চিরায়ত উপায়ে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে প্রেরিত হয়ে, শত বর্ষের বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম দ্বারা বিকশিত ও বর্ধিত হয়ে একটা জাতির, একটা শ্রেণির এবং একটা সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নৈতিক পরম্পরা গঠিত হয়।

আর্টওয়ার্ক: আইডিওলজি
শিল্পী: ভ্লাদেমির কাজানেভস্কি
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

প্রত্যেক প্রজন্মই চিন্তার পরিপক্বতায় পৌঁছানোর পর নিজের ও নিজের সমাজের মধ্যে প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠিত ধারণা ও চিন্তাসমুহ এটির যাত্রাবিন্দু হিসেবে কাজ করে থাকে, যেন এটি নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক শ্রমের কাঁচামাল … এগুলো হচ্ছে প্রকৃতি সম্পর্কে, মানুষ সম্পর্কে, ন্যায্যতা সম্পর্কে, ব্যক্তি ও শ্রেণির দায়িত্ব ও অধিকার সম্পর্কে, সামাজিক সম্মেলন সম্পর্কে, পরিবার সম্পর্কে, সম্পত্তি সম্পর্কে এবং রাষ্ট্র সম্পর্কে ধারণা সমূহ এবং মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক প্রভাবিত করে এমন আরো অনেক ফ্যাক্টর সমূহ। এসব ধারণাসমূহ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দ্বারা শর্তায়িত হয়ে ব্যক্তির মনে অঙ্কিত হয়ে যায় যা ব্যক্তি নিজেকে একটা সত্তা হিসেবে আবিষ্কার করার পূর্বেই গ্রহণ করে ফেলেন ।  অনেক পরে তিনি এগুলো পুনরাবিষ্কার করেন, প্রতিষ্ঠাপিত করেন, ব্যাখ্যা করেন, এবং তত্ত্ব দ্বারা বিস্তৃত করেন। এগুলোই তিনি যে সমাজে বসবাস করেন সে সমাজের ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সর্বজনীন চেতনা বা সমষ্টিগত পূর্বানুভূতি (Prejudice) প্রকাশ করে। এইসব পূর্বানুভূতিতে (Prejudice)  তিনি এতই সিক্ত থাকেন যে তিনি তার সকল বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক অভ্যাসের কারণেই, অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও, এইসব পাপাচারের সমর্থক হয়ে উঠেন; এমনকি তিনি ব্যক্তিগতভাবে এগুলো রক্ষা করতে আগ্রহী না হলেও।

এটি মোটেও বিস্ময়কর নয় যে, যে ধারণাসমূহ সমাজ সমষ্টিগতভাবে জারি রাখে জনসাধারণের ওপর সেগুলোর প্রভাব এত দৃঢ়। বরং বিস্ময়কর এটি যে, এই জনসাধারণের মধ্যেও এমন কিছু ব্যক্তি থাকেন যাদের প্রথার স্রোতের বিরুদ্ধে যাওয়ার মতো চিন্তা, ইচ্ছা এবং সাহস থাকে। ব্যক্তির ওপর সমাজের চাপ এত দৃঢ় যে এর কারণে কেউই, তিনি যতই দৃঢ় চরিত্রের বা যতই প্রগাঢ় বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হোন না কেনো, সমাজের এই স্বৈরচারী ও দুর্নিবার প্রভাব থেকে পুরোপুরি রেহাই পাবেন না।

এই প্রভাবের চাইতে ভালো করে করে আর কিছুই মানুষের সামাজিক চরিত্রকে স্পষ্ট করে না। বলা যেতে পারে যে, সমাজের সমষ্টিগত চেতনাই, যা কিছুই বড়ো বড়ো পাবলিক প্রতিষ্ঠানসমূহে এবং ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটিতে খোদাই করা আছে, সকল তত্ত্বের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে থাকে। এটি এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নৈতিক  আবহ গড়ে তোলে। এই আবহ খারাপ হতে পারে, তবু তার সকল সদস্যের অস্তিত্বের জন্যে পুরোপুরি আবশ্যক। এই আবহ তাকে শাসন করলেও ধরে রাখে, এবং গতানুগতিকতা ও রুটিনকে জোরদার করে যা বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণকে একত্রিত করে।

অধিকাংশ মানুষ, শুধু সাধারণ মানুষই না বরং বিশেষাধিকার প্রাপ্ত ও আলোকিত শ্রেণির মানুষরাও আরো বেশি অস্বস্তি-বোধ করেন যদি না তারা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রথা ও রুটিন বিশ্বস্তভাবে মেনে চলেন ও  অনুসরণ করেন । তারা যুক্তি দেখান যে, ‘আমাদের পূর্বপুরুষরা এইভাবে চিন্তা ও কাজ করেছেন, তাই আমরাও একইভাবে চিন্তা ও কাজ করবো। প্রত্যেকেই একইভাবে চিন্তা ও কাজ করে। আমরা কেনো আলাদাভাবে চিন্তা ও কাজ করবো?’

বইপত্রের হদিস
১) মিখাইল বাকুনিন, অরাজ রাষ্ট্রহীন সমাজতন্ত্র, অনুবাদ: নুরে আলম দুর্জয়, স্বাধীনতা প্রকাশন।
২) রুডলফ রকার, নৈরাজ্যবাদ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, অনুবাদ: সেলিম রেজা নিউটন, স্বাধীনতা প্রকাশন।

সম্পাদকীয় নোট: রচনাটি অরাজের বাকুনিন রচনা সংকলনের জন্য অনুবাদ করা হয়। এরই মধ্যে অনুবাদটি রাষ্ট্রচিন্তা জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

সহুল আহমদ

সহুল আহমদ, লেখক, অনুবাদক ও অ্যক্টিভিস্ট। গবেষণার পাশাপাশি সমকালীন বিষয়াবলীর বিশ্লেষক। জন্ম সিলেটে, ১৯৯১ সনে। পড়াশোনা করেছেন শাবিপ্রবিতে, পরিসংখ্যান বিভাগে। একাধিক জার্নাল সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত। প্রকাশিত বই: মুক্তিযুদ্ধে ধর্মের অপব্যবহার; জহির রায়হান: মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক ভাবনা; সময়ের ব্যবচ্ছেদ (সহ-লেখক সারোয়ার তুষার)। অনুবাদ: ইবনে খালদুন: জীবন চিন্তা ও সৃজন।