অরাজ
আর্টওয়ার্ক: ফ্রিডম এন্ড পাওয়ার শিল্পী: হিসাম সাত্তা সূত্র: রুয়া
প্রচ্ছদ » মিখাইল বাকুনিন।। কর্তৃত্ব কী?

মিখাইল বাকুনিন।। কর্তৃত্ব কী?

অনুবাদ: খন্দকার তুর আজাদ

রুশ বিপ্লবী মিখাইল বাকুনিনের মুক্তিমুখিন চিন্তার আকর রচনার মধ্যে অন্যতম What is Authority?। ১৮৭১ সালে রচিত God and The State গ্রন্থের অংশ হিসেবেই এই রচনাটি পরিচিত। বইটি ১৮৮২ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। কিন্তু বাকুনিনের The Knouto-Germanic Empire and the Social Revolution নামক অসমাপ্ত গ্রন্থের পাণ্ডলিপি হিসেবে এই রচনাটি পাওয়া যায়। প্রবহমান বাংলা সংস্করণটি শন পি উলবারের ইংরেজি সংস্করণকে অনুসরণ করে ভাষান্তর করা হয়েছে।-সম্পাদক

মিখাইল বাকুনিন

কর্তৃত্ব কী? এটি কি কোনো প্রাকৃতিক বিধানের অবিসম্ভাবী ক্ষমতা, যা ভৌত ও সামাজিক দুনিয়ায় পারস্পারিক জরুরি-সংযোগ আর পরম্পরায় নিজেদের সূত্রবদ্ধ করে? প্রকৃতপক্ষে, এসব বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুধু নিষিদ্ধই নয়,এটি  অসম্ভবও বটে। আমরা এগুলো ভালোভাবে না বুঝতে পারি, বা সেগুলো সম্পর্কে একেবারে নাও জানতে পারি। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই আমরা সেগুলো অমান্য করতে পারি না। কেননা এগুলো  আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি ও মৌলিক শর্তাবলী গড়ে তুলে। এগুলো আমাদের ঘিরে রাখে। আমাদের সকল গতিবিধি, চিন্তা, কার্যকলাপে নিয়ন্ত্রণ করে, হস্তক্ষেপ করে। এমনকি যখন আমরা বিশ্বাস করি যে, আমরা এগুলোকে অমান্য করছি, তখনও আমরা শুধুমাত্র তাদের স্বয়ম্ভর ক্ষমতার প্রতিই আনুগত্য দেখাই।

হ্যাঁ, আমরা এসকল প্রাকৃতিক বিধানের চূড়ান্ত দাস।কিন্তু এরকম দাসত্বে কোন অপমান নেই, আসলে এটি কোনভাবে দাসত্বই নয়। কারণ দাসত্বের জন্য বাহিরের একজন প্রভু লাগে, নিজের বাহিরে একজন বিধানপ্রণেতা লাগে, যে কিনা আদেশ দেয়। যেখানে এসব প্রাকৃতিক বিধান আমাদের বাহিরের কিছু না;  এগুলো আমাদের ভেতরেই থাকে। এগুলোই গড়ে তোলে আমাদের সত্ত্বা, আমাদের সম্পুর্ন সত্ত্বা। শারিরীক,বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নৈতিক। আমরা বেঁচে থাকি, নিশ্বাস নিই, কাজ করি, চিন্তা করি, আকাঙ্ক্ষা করি শুধুমাত্র এসব বিধানের মধ্যেই। এগুলো ছাড়া আমাদের অস্তিত্বই থাকে না। তাহলে কিভাবে আমরা এসব বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ক্ষমতা বা ইচ্ছা অনুভব করলাম?

প্রাকৃতিক বিধানের ক্ষেত্রে মানুষের জন্য শুধুমাত্র একটি স্বাধীনতাই সম্ভব। তা হলো: সে যে সামগ্রিক ও ব্যক্তিগত মুক্তি খুঁজছে, তা অর্জনের লক্ষ্যর সাথে সংগতি রেখে এসব বিধানকে সব সময় আরো বেশি করে চেনা ও প্রয়োগ করা। এসব বিধান একবার চেনা হলে, তা এমন কর্তৃত্বের চর্চা করবে যা কখনো গণমানুষ দ্বারা বিতর্কিত হবে না। উদাহরণস্বরুপ, যে বিধান ২ গুণ ২ কে ৪ করে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে হলে একজনকে হয় বোকা না হয় ধর্মতাত্ত্বিক অথবা কমপক্ষে অধবিদ্যাবিৎ,আইনবিদ বা বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ হতে হবে। আগুন পুড়াবে না বা পানি ডুবাবে না এরকম কল্পনার জন্য তো একজনকে অবশ্যই বিশ্বাসী হতে হবে যদি না সে অন্য কোন চাতুরীর আশ্রয় নিতে পারে যার ভিত্তিও আসলে অন্য কোন প্রাকৃতিক বিধান। কিন্তু এসব বিদ্রোহ বা আরো যথাযথভাবে বলতে গেলে  অসম্ভব দ্রোহের চেষ্টা বা অলীক কল্পনা শুধু বিরল কিছু ব্যতিক্রম তৈরি করে। কারণ সাধারণভাবে বলা চলে যে, গণমানুষ তার প্রতিদিনের জীবনে নিজেদের সাধারণ বোধশক্তি দিয়েই অর্থাৎ সাধারণভাবে স্বীকৃত প্রাকৃতিক বিধানসমূহ দিয়েই নিজেদের জীবন পরিচিলিত করে। এবং প্রায় সব ক্ষেত্রেই আসলে এমনই ঘটে।

কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, এরই মধ্যে বিজ্ঞান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত- এমন অনেক প্রাকৃতিক বিধান জনসাধারণের কাছে অজানা রয়ে গেছে। এমনটা হয়েছে রক্ষাকারী সব সরকারের বদৌলতে, যারা কিনা আবার আমাদের জানামতে শুধুমাত্র জনতার মঙ্গলের জন্যই টিকে আছে! এখানে আরেকটা যে বাধা আছে, তা হলো: প্রাকৃতিক বিধানের একটি বড় অংশ সে অর্থে বিজ্ঞান দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃতই হয়নি। অথচ এসব বিধান মানব সমাজের বিকাশের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। যেসব প্রাকৃতিক বিধান ভৌত দুনিয়াকে পরিচালিত করে, সেগুলোর মতোই প্রয়োজনীয় , অপরিবর্তনযোগ্য ও গুরুতর।

একবার এসব প্রাকৃতিক বিধান বিজ্ঞান দ্বারা স্বীকৃত হলে এবং তারপর সর্বজনের শিক্ষার ও নির্দেশনার বিস্তৃত ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সকলের চেতনায় পৌছে গেলে স্বাধীনতা প্রশ্নের নিঁখুত সমাধান আসবে। সবচেয়ে গোঁয়ার কর্তৃত্ববাদীদেরও তখন স্বীকার করতে হবে যে, এরকম হলে আর কোন রাজনৈতিক সংগঠন, পরিচালনা ব্যবস্থা বা আইনের দরকার হবে না। এই তিনটা জিনিস, তা সার্বভৌমের ইচ্ছা থেকেই আসুক বা সার্বজনীন ভোটে নির্বাচিত সংসদ থেকেই আসুক বা প্রাকৃতিক বিধানের অনুগামী (যা কখনোই হয়নি এবং কখনোই হবে না) হিসেবে আসুক; সাধারণ মানুষের স্বাধীনতার জন্য এসব কিছুই হবে বিরূপ ও ভয়ানক, কেননা এগুলো জনতার উপর বাহ্যিক এবং সে কারণে জবরদস্তির বিধান চাপিয়ে দেয়।

মানুষ প্রাকৃতিক বিধান মানে। কারণ এগুলোকে সে স্বীকৃতি দিয়েছে। এখানে বাহিরের কোন স্বর্গীয় বা মানবিক; সামষ্টিক বা ব্যক্তিগত; কোনো ধরনের বাহ্যিক ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপার থাকে না। শুধুমাত্র এই ব্যাপারটির মধ্যেই মানুষের মুক্তি নিহিত।

ধরে নিই বিজ্ঞানের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ প্রতিনিধিদের দিয়ে একটি বিজ্ঞ একাডেমি গড়ে , এটিকে সমাজের আইন প্রণয়ন ও সংগঠিত করার দ্বায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এবং শুধুমাত্র বিজ্ঞানের প্রতি বিশুদ্ধ ভালোবাসা থেকে এটি শুধুমাত্র বিজ্ঞানের সর্বশেষ বিধানের সাথে সর্বোচ্চ সংহতি রেখে আইন প্রণয়ন করে। আচ্ছা, আমি নিজের জন্য বলতে পারি: এমন আইনসভা বা সংগঠন পৈচাশিকতায় পরিণত হবে। দুটি কারণে এমনটা ঘটবে। প্রথমত, মানবিক বিজ্ঞান সবসময় এবং প্রয়োজনবশতই ত্রুটিপূর্ণ, এখন পর্যন্ত যা আবিস্কৃত হয়েছে এবং আগামীতে যা হতে যাচ্ছে, তার বিচারে বলা চলে যে: এটি মাত্র হামাগুড়ি দেয়া শিখছে। তো আমরা বিজ্ঞানের সর্বশেষ তথ্যের সাথে কঠোর ও একচেটিয়া সঙ্গতি রেখে মানুষের ব্যবহারিক জীবন অর্থাৎ ব্যক্তিগত ও সামগ্রিক জীবন চালাতে গেলে ব্যক্তি ও সমাজ দুটোকেই প্রোক্রাস্টেসের শয্যায় আত্ম বিসর্জনের দণ্ডে দণ্ডিত করবো। এ দশার দ্রুতই সমাপ্তি ঘটবে তাদেরকে বিচ্যুত ও বিচ্ছিন্ন করে ফেলবার মধ্য দিয়ে। কারণ জীবন, বিজ্ঞানের চেয়ে সীমাহীনভাবে বিশাল।

*প্রোক্রাস্টেস: গ্রীক পুরাণে প্রোক্রাস্টেস ছিল এমন এক দস্যু যে পথিকদের দাওয়াত দিয়ে এনে তার বিছানার মাপের করে তুলবার জন্য অত্যাচার চালাতো । বেশি ছোট হলে টেনে লম্বা করতো ,বেশি লম্বা হয়ে গেলে পা কেটে ফেলত । উভয় প্রক্রিয়াতেই প্রোক্রাস্টেসের বিছানাই হতো অতিথিদের মৃত্যু শয্যা।

আর্টওয়ার্ক: দ্য সান এন্ড গড
শিল্পী: হিসাম সাত্তা
সূত্র: রুয়া

দ্বিতীয় কারণটা হলো: সমাজ এমন একটি বৈজ্ঞানিক একাডেমি থেকে আসা আইন মান্য করবে, এ কারণে নয় যে তারা নিজেদেরকে ঐ আইনের যৌক্তিক চরিত্র বুঝাতে সক্ষম হয়েছে। ( যে ক্ষেত্রে আসলে একাডেমির অস্তিত্বই অদরকারি হয়ে ওঠে) বরং তারা এসব আইন ভালোমতো বুঝতে না পেরেই সেগুলো ভক্তি করবে বিজ্ঞানের নামে, একাডেমি থেকে আরোপিত হয়েছে বলে। এমন  সমাজ, মানুষের সমাজ হতে পারে না, তা হয়ে উঠে বর্বরদের সমাজ । এধরনের সমাজ দীর্ঘদিন যিশু সমাজ দ্বারা নিজেকে পরিচালিত করা প্যারাগুয়ের হতভাগা প্রজাতন্ত্রের দ্বিতীয় সংস্ককরণে পরিণত হবে। এবং তা দ্রুতই নির্বুদ্ধিতার নিম্নতম স্তরে অধঃপতিত হতে বাধ্য।

তবে এসবের পরেও একটি তৃতীয় কারণ আছে যা এরকম সরকারকে অসম্ভব পরিণত করে। তা হলো:  সবচে কৃতী ব্যক্তিদের দিয়ে তৈরী করা সর্বোচ্চ সার্বভৌমত্বপ্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক একাডেমিও দ্রুতই নৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে নিজেকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলবে। আজকের দুনিয়ার সব একাডেমিরই ইতিহাস এমন। যদিও তারা অল্প বিশেষাধিকারই পেয়ে থাকে। মহোত্তম বৈজ্ঞানিক প্রতিভা একাডেমিশিয়ানে অর্থাৎ সরকারি সনদপ্রাপ্ত পন্ডিতে পরিণত হওয়া মাত্রই অবশ্যম্ভাবীভাবে অধঃপতিত এবং নিষ্কৃয় হয়ে পড়ে। সে  হারিয়ে ফেলে তার স্বতঃস্ফূর্ততা,বৈপ্লবিক স্পর্ধা। হারিয়ে ফেলে তার শ্রেষ্ঠ প্রতিভার সহজাত প্রলয়ংকারী শক্তি যা সব সময় তাকে জরাজীর্ণ দুনিয়া ভেঙে নতুন পৃথিবী তৈরীর ভিত নির্মানের আহবান জানায়। অবশ্য কোন দ্বিধা ছাড়াই বলা চলে যে,  চিন্তা শক্তিতে যা  হারায় তা সে আদব- কায়দা, উপযোগিতা আর ব্যবহারিক জ্ঞানে লাভ করতে পারে । সোজা কথায় সে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

বিশেষ সুবিধা এবং প্রতিটি বিশেষ সুবিধার পদের বৈশিষ্ট্যই হল মানুষের শরীর ও  মনকে হত্যা করা।  রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক যে কোন ভাবে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষ হল এমন মানুষ যে কিনা বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নৈতিকভাবে অধঃপতিত।এ এমন এক সামাজিক বিধান যার কোন ব্যতিক্রম নেই। এটি সব জাতি, শ্রেণী, গোষ্ঠী এবং ব্যক্তির  ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এটি সাম্যের বিধান। মুক্তি ও মানবতার চরম শর্ত ।এই চুক্তির প্রধান লক্ষ্য হলো: এটিকে বিস্তৃত করা, যাতে মানব জীবনের সব জায়গায় এর সত্য দেখানো যায়।

সমাজ পরিচালনার ভার পাওয়ার পর কোন বৈজ্ঞানিক পরিষদ শুধু বিজ্ঞান নিয়েও ব্যস্ত থাকবে না। দ্রুতই আরেকটা ব্যাপার তাদের ধ্যান-জ্ঞান  হয়ে পড়বে। অন্যসব প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার মতই, তাদের কাজ হবে নিজেদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য তাদের সেবার উপর, তাদের পরিচালনা ও দিকনির্দেশনার প্রতি সমাজকে আরো বেশি নির্ভরশীল বানানো।

একটি বৈজ্ঞানিক একাডেমির মতো, এই কথাগুলি সকল প্রকারের সাংবিধানিক ও আইনপ্রণয়নকারী পরিষদের জন্যও সত্য। এমনকি যদি তারা সার্বজনীন ভোটাধিকারের ফলাফল হয় তারপরও সত্য। সার্বজনীন ভোটাধিকার হয়ত পরিষদের চেহারা পাল্টাতে পারে। কিন্তু এর মাধ্যমে কয়েক বছরের জন্য গঠিত সুবিধাপ্রাপ্ত  (অধিকার প্রাপ্ত নয়) রাজনীতিবিদদের পরিষদ শুধুমাত্র গণসংশ্লিষ্ট বিষয় পরিচালনার দ্বায়িত্বে নিয়োজিত হওয়ার মাধ্যমেই শেষমেষ একধরনের রাজনৈতিক অভিজাততন্ত্র বা গোষ্ঠীশাসন গড়ে তুলে। যুক্তরাষ্ট্র বা সুইজারল্যান্ডের দিকেই তাকালেই তা বুঝা যায় ।

তাই বাহিরের আইনপ্রণেতা এবং কর্তৃত্ব একই, কারণ তারা একে অন্যের থেকে অবিচ্ছেদ্য এবং সমাজকে দাসত্বের এবং নিজেদের অধঃপতিত করার দিকেই ধাবিত হয়।

এটা কী এমন বুঝায় যে আমি সব কর্তৃত্বকে অস্বীকার করি? এমন চিন্তা কখনোই আমার মাথায় আসবে না। জুতোর প্রশ্নে আমি  মুচির কর্তৃত্বের কাছে যাই; বাড়ি, খাল বা সেতুর প্রশ্নে আমি স্থপতি বা প্রকৌশলীর কথা শুনি। জ্ঞানের প্রতিটি বিশেষ ক্ষেত্রর জন্য আমি সেই বিষয়ের জন্য উপযুক্ত দক্ষ লোকের সাথে কথা বলি। কিন্তু আমি মুচি, প্রকৌশলী বা বিজ্ঞানী কাউকেই আমার উপর কিছু চাপিয়ে দেয়ার অনুমতি দিই না। তাদের বুদ্ধিমত্তা ,চরিত্র, জ্ঞানের জন্য প্রাপ্য সম্মান দিয়েই আমার সমালোচনা আর খতিয়ে দেখার প্রশ্নাতীত অধিকার রেখে মুক্তভাবে তাদের কথা শুনি। শুধু একটি নির্দিষ্ট কর্তৃত্বের পরামর্শ নিয়ে আমি সন্তুষ্ট হই না বরং বহুজনের সাথে আলাপ করি। তাদের মতামতের তুলনা করে আমি সেটিই বেছে নিই যেটি আমার কাছে সবচাইতে ঠিক বলে মনে হয়। কিন্তু আমি কোন অভ্রান্তিযোগ্য কর্তৃত্বের স্বীকৃতি দিই না, এমনকি খুব ব্যতিক্রমী প্রশ্নের ক্ষেত্রেও। এমন কারো প্রতি-  তার সততা বা আন্তরিকতার প্রতি যতটা শ্রদ্ধাই থাকুক না কেন- পূর্ণ বিশ্বাস নেই। এমন বিশ্বাস আমার যুক্তি ,স্বাধীনতা এমনকি আমার কাজের সাফল্যের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠবে, তাৎক্ষণিকভাবে আমাকে একজন নির্বোধ দাসে পরিণত করবে, পরিণত করবে আরেকজনের ইচ্ছা আর স্বার্থপূরণের হাতিয়ারে।

আমি যদি বিশেষজ্ঞদের কোন কর্তৃত্বের প্রতি অনুগত হই এবং আমার প্রয়োজনমত তাদের দিক নির্দেশনা এবং পরিচালনা মেনে চলি, তবে তা শুধুমাত্র আমার নিজের আরোপিত কর্তৃত্বের কারণেই করব। কোন মানুষ বা ঈশ্বরের আরোপিত কর্তৃত্বের কারণে নয়। সেরকম না হলে আমি ভয়ের সাথে তাদের বিতড়িত করব। আর শয়তানকেই তাদের উপদেশ , দিক –নির্দেশনা , বিজ্ঞান নিতে দিব যা তারা আমার মুক্তি আর মানবিক মর্যাদা কেড়ে নিয়ে অসংখ্য মিথ্যাকে একটু সত্যের মোড়কে সাজিয়ে দিতে চেয়েছিল।

আমি পারদর্শী মানুষদের কর্তৃত্বের প্রতি অনুগত হই কারণ তা আমি নিজ যুক্তিতেই আমার উপর আরোপ করি। আমি এটা জানি যে মানবিক বিজ্ঞানের খুটিনাটি বিবরণ আর ইতিবাচক বিকাশের খুব সামান্যই আমি বুঝতে পারি। পুরোপুরি তা বুঝা সর্বোচ্চ বুদ্ধিমত্তার পক্ষেও সম্ভব হবে না। এই জায়গা থেকেই বিজ্ঞান এবং শিল্পের ক্ষেত্রে শ্রমের বিভাজন আর সংগঠনের ব্যাপারটি আসে। আমি নিই এবং দিই- মানব জীবন তো এমনই। প্রত্যেকেরই কিছু জায়গায় নিজের কর্তৃত্ব আছে এবং অন্য জায়গায় সে অপরের কর্তৃত্বও স্বীকার করে নিচ্ছে। এতে করে কোন বাঁধাধরা কর্তৃত্বের ব্যাপার থাকে না ,বরং থাকে পারস্পরিক,ক্ষণস্থায়ী এবং সর্বোপরি ঐচ্ছিক কর্তৃত্ব আর আনুগত্যের এক চলমান বিনিময়।

এই কারণে আমি একটি বাঁধাধরা, নির্দিষ্ট ও সার্বজনীন কর্তৃত্ব হিসেবে কাউকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাই। কারণ এমন কোন সার্বজনীন মানব নেই, যিনি কিনা সব কিছু একেবারে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রভাবে বুঝতে পারে। অথচ এসব ছাড়া জীবনে বিজ্ঞানের বা সামাজিক বিজ্ঞানের ব্যবহার অসম্ভব। এমনকি যদি কোন মানুষের মধ্যে এরকম সার্বজনীন রূপ আবিষ্কারও করা যায় এবং সে আমাদের উপর কর্তৃত্ব চাপিয়ে দেয়ার জন্য এর ব্যবহার করতে চায় তাহলেও এরকম মানুষকে সমাজ থেকে বিতাড়িত করার প্রয়োজন পড়বে। কারণ তা না হলে তার কর্তৃত্ব অবশ্যম্ভাবীভাবে অন্য সবাইকে দাসত্ব আর নির্বুদ্ধিতায় পর্যবাসিত করবে। আমি এমনটা মনে করি না যে সমাজের উচিত প্রতিভাদীপ্ত মানুষদের প্রতি বিরুদ্ধসুলভ আচরণ করা যেমনটি কিছু ক্ষেত্রে ঘটেছে। কিন্তু আমি এমনটিও মনে করি না যে, সমাজের তাদেরকে খুব বেশি কিছু দেয়া দরকার। সবার উপরে তাদের কোন অতিরিক্ত সুবিধা বা বিশেষাধিকার দেয়ার পক্ষে আমি নই। তিনটি কারণে আমি এমনটা মনে করি। প্রথমত, এক্ষেত্রে অনেক সময় আমরা কোন ভণ্ড লোককে প্রতিভাবান ভেবে ভুল করতে পারি, দ্বিতীয়ত অতিরিক্ত সুযোগ – সুবিধার এমন ব্যবস্থা  সত্যিকারের প্রতিভাবান ব্যক্তিকেও ভন্ডতে পরিণত করতে পারে, তার নৈতিক অবক্ষয় ঘটাতে পারে এবং তাকে  নির্বোধ ব্যক্তিতে পরিণত করতে পারে , এবং শেষ পর্যন্ত এটা একধরনের স্বৈরশাসকে পরিণত করতে পারে।

সংক্ষেপে বলা চলে আমরা বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব মেনে নিই। কারণ বিজ্ঞান ভৌত ও সামাজিক জগত দুটো মিলে গড়া একক প্রাকৃতিক জগতের বস্তুগত , বুদ্ধিবৃত্তিক আর নৈতিক জীবনের অন্তর্নিহিত প্রাকৃতিক বিধানের সুচিন্তিত এবং যতটা সম্ভব নিয়মবদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক পুনঃউৎপাদন ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে মাথা ঘামায় না। এটাই একমাত্র ন্যায্য কর্তৃত্ব কারণ তা যৌক্তিক এবং মানুষের মুক্তির সাথে সংহতিপূর্ণ। এই কর্তৃত্ব ছাড়া অন্য সকল কর্তৃত্বকে আমরা মিথ্যা, যুক্তিহীন, স্বৈরতান্ত্রিক এবং ভয়ানক ঘোষণা করি।

আর্টওয়ার্ক: শিরোনামহীন
শিল্পী: হিসাম সাত্তা
সূত্র: রুয়া

আমরা বিজ্ঞানের পরম কর্তৃত্ব স্বীকার করি কিন্তু বিজ্ঞানের প্রতিনিধিদের সর্বময়তা এবং অভ্রান্তিযোগ্যতা অস্বীকার করি। যদিও চার্চ আর রাষ্ট্র- এই দুইটিই আমার দুই চোখের বিষ, তারপরও যদি আমাকে বিজ্ঞানকে এগুলোর সঙ্গে তুলনা করে বলতে হয়, তাহলে বলবো: প্রোটেস্ট্যান্টদের চার্চের মতই আমাদের চার্চে আছে একটি মাথা বা এক অদৃশ্য যিশু; আর তা হলো বিজ্ঞান। এবং প্রোট্যাস্ট্যান্টদের মতই (বা তার চেয়েও বেশি ধারাবাহিকভাবে) আমরা এড়িয়ে চলতে চাই পোপ, কাউন্সিল, যাজক, বা এমনকি পাদ্রীর খপ্পড়। আমাদের যিশুর সাথে খ্রিষ্ঠানদের যিশুর ভিন্নতা এখানে যে, তাদের যিশুর  ব্যক্তি হিসেবে অস্তিত্ব আছে যেখানে আমাদের যিশু স্বাভাবিকভাবেই অব্যক্তিক। তাদের যিশু নিজেকে এক নিখুঁত সত্ত্বা হিসেবে উপস্থাপন করে এবং চিরন্তন অতীতেই তাকে সম্পূর্ণভাবে অনুধাবন করা যায়। অথচ আমাদের যিশু অর্থাৎ বিজ্ঞানের পুর্ণাঙ্গতা এবং খুঁতহীনতা সবসময় ভবিষ্যতে থাকে , অর্থাৎ বলা চলে যেসব কখনোই সম্পূর্নরূপে অনুধাবন করা যাবে না। এই কারণে পরম বিজ্ঞান ছাড়া আর কোন পরম কর্তৃত্ব না মানাতে আমরা কোনভাবেই আমাদের স্বাধীনতার সাথে আপোষ করছি না ।

‘পরম বিজ্ঞান’ কথাটি দিয়ে আমি সত্যিকারের সার্বজনীন বিজ্ঞা্নের কথা বুঝাচ্ছি যা কিনা প্রতিনিয়ত বিকাশমান। এবং এটি  পৃথিবীর মধ্যে থাকা সব প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নীতি ও সমন্বয়কে যতটা সম্ভব বিস্তৃত পরিসরে এবং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বর্ণনায় নতুনভাবে তৈরী করবে। বুঝাই যায় যে, এরকম বিজ্ঞান , মানব মনের সব প্রচেষ্টার এই মহিমান্বিত বস্তু, কখনোই নিখুঁত রুপে বুঝা যাবে না। আমাদের খ্রিষ্ট তাহলে চিরকাল অসম্পূর্ণ থাকবে , এ কারণেই আমাদের মধ্যে তার অনুমোদন প্রাপ্ত প্রতিনিধিদের গৌরব সংযত থাকার কথা। পুত্ররূপের যে ঈশ্বরের নামে তারা তাদের উদ্ধত এবং গোঁড়া কর্তৃত্ব খাটাতে চায়, তার বিরুদ্ধে আমরা পিতা রূপ ঈশ্বরের কাছে প্রতিবাদ জানাই। এই পিতা রূপ ঈশ্বর হল  সত্যিকারের দুনিয়া, বাস্তব জীবন । যে দুনিয়ায় আমরাবেঁচে আছি,  সংগ্রাম করছি, ভালবাসছি, স্বপ্ন দেখছি, আনন্দ করছি,  আঘাত পাচ্ছি, কষ্ট করছি।

বিজ্ঞানের মানুষদের চরম, সর্বময় এবং অভ্রান্তযোগ্য কর্তৃত্বকে আমরা প্রত্যাখান করি কিন্তু আমরা স্বেচ্ছায় বিশেষায়িত বিজ্ঞানের প্রতিনিধিদের সম্মানিত কিন্তু পরিবর্তনশীল, অল্প সময়ের জন্য, সীমিত কর্তৃত্বকে মেনে নিই। আমরা সময়সাপেক্ষে তাদের পরামার্শ নেয়ার চেয়ে বেশি কিছু আশা করি না। তারা যে মূল্যবান তথ্য দিতে চায় তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ থাকি । এবং এর জন্য যদি শর্ত থাকে যে আমরা নিজেরা তাদের চেয়ে যে সকল বিষয়ে শিক্ষিত সে সকল বিষয়ে তাদের  তথ্য দিব , তবে তা সাগ্রহে মেনে নেয়া যায়। সাধারণভাবে মহা জ্ঞান, সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা, মহান চিত্ত এবং সবার উঁপরে বিশাল হৃদয়ের অধিকারী মানুষদেরকে আমাদের উপর প্রকৃতগত এবং বৈধ প্রভাব প্রয়োগ করাই তো আমরা দেখতে চাই , যদি তা মুক্তভাবে গ্রহণ করা যায় এবং কখনোই কোন জাগতিক বা মহাজাগতিক প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্বের নামে না হয়। কারণ এভাবে প্রয়োগ করা প্রতিটা কর্তৃত্ব বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রদত্ত অধিকারের প্রভাব সরাসরি অত্যাচার এবং মিথ্যাচারে পরিণত হয়। এবং আমার মতে আমি ইতোমধ্যে যথেষ্টভাবে দেখিয়েছে যে তা অবশ্যই আমাদের উপর দাসত্ব এবং নির্বুদ্ধিতা চাপিয়ে দিবে।

এক কথায় আমরা সব ধরনের আইন , সকল  কর্তৃত্ব এবং প্রতিটি সুবিধাপ্রাপ্ত , প্রাতিষ্ঠানিক এবং আইনগত প্রভাব, এমনকি সার্বজনীন ভোটাধিকার থেকে তৈরী হওয়া কর্তৃত্বও প্রত্যাখান করি। কারণ আমরা বুঝতে পারি যে, এরকম কর্তৃত্ব বাধ্যগত বেশিরভাগ মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে ক্ষমতা খাটানো, অত্যাচারী অল্প মানুষের হাতিয়ারে পরিণত হবে ।

এবং এ অর্থেই আমরা সত্যিকারের অরাজবাদী।

খন্দকার তুর আজাদ