অরাজ
এনার্কিস্ট পোস্টার
প্রচ্ছদ » নোয়াম চমস্কি।। পারস্পরিকতা বাড়ছে এবং এটাই আমাদের বেঁচে থাকার চাবিকাঠি

নোয়াম চমস্কি।। পারস্পরিকতা বাড়ছে এবং এটাই আমাদের বেঁচে থাকার চাবিকাঠি

  • অনুবাদ: ইফতেখার রুমি

‘নৈরাজ্যবাদ ও নৈরাজ্যবাদীদেরকে ঐতিহাসিকভাবে দুনিয়ার সামনে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। নৈরাজ্যবাদীরা অনিয়ন্ত্রিত সংবেদনশীল, নিজ স্বার্থের জন্য ধ্বংসকামী সহিংস ব্যক্তি এবং সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিরোধী –  এই ধরনের উপস্থাপন আজ পর্যন্ত বহাল আছে।  এছাড়াও, নৈরাজ্যবাদ মানেই বিশৃঙ্খলা, বিভ্রান্তি, হত্যা ও ধর্ষণের রাজত্ব … এমন ভ্রান্ত ধারণাও সাধারণ জনগণ ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করে। লোরেঞ্জ কমবুয়া এর ‘এনার্কিজম এ্যান্ড ব্ল্যাক রেভুলেশন’ বই থেকে।

কভিড-১৯ এর এই সময়ে পারস্পরিকতা (mutual aid) শব্দটিকে দুনিয়াজুড়ে ব্যাপক আন্দোলিত হতে দেখা যাচ্ছে। ‘ইন্ডিজেনাস মিউচাল এইড নেটওয়ার্ক’ এর মত অনেক সংগঠন বর্তমানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে; হারিকেন ক্যটরিনার পরপর ‘কমন গ্রাউন্ড রিলিফ কালেক্টিভ’ এর উদ্যোগে এমন পারষ্পরিকতা, সহয়তা প্রদানের নজির দেখা গিয়েছিল।

ক্রিস স্টীলের সাথে চমস্কির এই  সাক্ষাতকারটি গত ২৮ মে, ২০২০ ‘Truthout’ এর ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে। নৈরাজ্যবাদের অব্যাহত কাজ, জনমনে নৈরাজ্যবাদ নিয়ে ভুল ধারণা ও তৃনমূল পর্যায়ের কাজ গুলোতে কিভাবে নৈরাজ্যবাদ ছড়িয়ে আছে, পারষ্পরিকতা বা মিচুয়াল এইডের কার্যকারিতা ইত্যাদি বিষয়  নিয়ে চমস্কি এই সাক্ষাতকারে আলাপ করেছেন ।

নোম চমস্কি

আমার প্রথম প্রশ্ন নৈরাজ্যবাদ নিয়ে আমরা জানি আপনি অল্প বয়সেই নৈরাজ্যবাদের সংস্পর্শে এসেছিলেন আমি জানতে চাচ্ছিলাম, নৈরাজ্যবাদ কিভাবে অগ্রসর হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আপনি এর ভূমিকা কীরকম দেখছেন ?

প্রথমত, আমাদের মনে রাখা উচিৎ যে ‘নৈরাজ্যবাদ’ শব্দটি বেশ বিস্তৃত চিন্তাভাবনা ও কার্যকলাপকে ধারণ করে থাকে। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা দুনিয়ার প্রপাগান্ডা-ব্যবস্থার কারণেই এই শব্দটি নিজেই একটি অবমাননাকর ধারণায় পর্যবসিত হয়েছে। নৈরাজ্যবাদ শব্দটি বলতে মানুষ এখন বুঝে সহিংসতা ও সন্ত্রাস, ধ্বংস, সমস্ত শৃঙ্খলা ও সংস্থার নির্মূলকরণ ইত্যাদি । কিন্তু নৈরাজ্যবাদের মূল ধারাটি এই রকম ছিল না ।

নৈরাজ্যবাদ একটি অত্যন্ত সংগঠিত সমাজের কথা বলে যেখানে অন্যায্য শ্রেণিবিন্যাস (heierarchy) এবং আধিপত্য ছাড়াই অংশগ্রহণকারীরা সংগঠিত হতে পারে। এটি সংহতি, পারস্পরিক উদ্বেগ, সহযোগিতা, তথ্যের অবাধ আদান-প্রদান,  বোঝাপড়া ইত্যাদির ভিত্তিতে উন্নত মাত্রার সংগঠনের কথা বলে। এটি কীভাবে বদলে গেলো? এসব মানবজীবনে সর্বদাই বিদ্যমান ছিল কিন্তু কখনো সমাজের স্বীকৃত উপাদান হিসেবে ছিল না । ষাট এর দশকে এটি পরিবর্তিত হতে শুরু করেছিল কারণ নৈরাজ্যবাদ শব্দটি ব্যবহৃত না হলেও  রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সক্রিয় কর্মীরা এই রূপগুলো গ্রহণ করা শুরু করেছিল ।

দক্ষিণের ফ্রিডম রাইডার্সরা (১৯৭১) বলবেন যে, আমরা এমন এক সমাজে বাস করি যা তৈরি হয়েছিল পারস্পরিকতা, সহযোগিতা,  এবং সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো এই জাতীয় কিছুর মাধ্যমে । প্রথমদিককার নারীবাদী আন্দোলনের একই রকম কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল, এবং এই জমানাতেও এটি বিদ্যমান, বিশেষত তরুণদের মধ্যে পরিবেশবাদী আন্দোলনের উত্থানে। তবে এর বাইরেও পুরো বিশ্বে এমন কিছু পরিবর্তন চোখে পড়ছে যাকে আমরা নৈরাজ্যবাদ না বললেও এতে সম্ভাব্য নৈরাজ্যবাদী সমাজের উপাদান নিহিত রয়েছে।

ওহাইওর ইয়ংস্টাঊনের বড় ইস্পাত মিলগুলোর বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে উদাহরণ হিসাবে দেখতে পারেন। এগুলো কমিউনিটি বা সম্প্রদায় কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল এবং তারা কেবল শ্রমশক্তিই ছিলেন না, বরঞ্চ তাদের অবদানই প্রধান ছিল। প্রকৃতপক্ষে এসব মিল বৃহৎ পরিমাণে সম্প্রদায় দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল বিধায় মিলগুলো বন্ধ হবার দরুন যেমন শ্রমশক্তির ক্ষতি হয়েছিল তেমনিভাবে সম্প্রদায়গুলো ভেঙ্গেও পড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছিল।  কিন্তু  পরবর্তীতে তারা বিশৃঙ্খল ও অদৃশ্য হওয়ার পরিবর্তে অংশগ্রহণমূলক আকারে সংগঠিত হতে শুরু করেছিল। আর এটা ঘটাতে সাহায্য করেছিলেন শ্রম কর্মী স্টাফডন ও আইনজীবী গার আল্পেরবভিটাস মত আগ্রহী বুদ্ধিজীবীরা। উনারা দীর্ঘদিন ধরে এসব ধারণাগুলো নিয়ে কাজ করছিলেন এবং সেসবের বিকাশ করছেন এখন ইয়ংস্টাউনে । আসলে,  ক্লিভল্যান্ডসহ প্রাক্তন রুসবেল্ট এলাকাগুলোতে শ্রমিক-মালিকানাধীন ও শ্রমিক-পরিচালিত উদ্যোগগুলোর একটা নেটওয়ার্ক ছিল যা কিনা অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল। যদিও এসব উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত বিস্তৃত রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী সমাজে গেঁথে গেছে, কিন্তু এ ধরনের উদ্যোগ স্বভাবে বেশ নৈরাজ্যবাদী ছিল।

আর্টওয়ার্ক: ডেট্রোয়েট ম্যুরাল

উনিশ শতকের ব্যক্তিত্ব মিখাইল বাকুনিন (যখন তিনি ‘ভবিষ্যতের জীবাণু’ বা germs of the future প্রসঙ্গে আলাপ করছিলেন) বিদ্যমান সমাজের মধ্যে ভবিষ্যতের উপাদানগুলো সম্পর্কে বলেছিলেন এবং আমি মনে করি নানা উপায়ে এসব ধারণা এখন এখানে বেশ উঠে আসছে, অতীতের চেয়েও বেশি  (অন্তত সাম্প্রতিকতম অতীতের তুলনায়)।

অবশ্যই, এখানকার কিছু স্বাধীন বিকাশ বেশ আশাব্যঞ্জক ছিল, যেমন সাম্প্রতিক কালে, সিরিয়ার কুর্দি ও রোজাভা অঞ্চলে, মুরে বুকচিনের কাজের উপর ভিত্তি করে সেখানকার মানুষজন দৃঢ়ভাবে একটি নারীবাদী ও সম্প্রদায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। যদিও সে সমাজ এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক তাদের সবচেয়ে নিকৃষ্ট শত্রুদের নিকট বেইমানির শিকার হয়েছে। আমার ধারণা  সেই সমাজের কিছু হয়ত বেঁচে যাবে ।

বর্তমানে যে পারস্পরিকতার কার্যক্রম চলছে, সরকারি সংস্থা থেকে নয়, বরং সম্প্রদায়গুলো একে অপরকে যেভাবে সহায়তা করছে তা নিয়ে আপনার কোনো মত আছে? এবং কভিডের যুগে নৈরাজ্যবাদী উপায়ে সংগঠিত করার জরুরত নিয়ে কিছু বলবেন?

গবেষণামূলক কাজ এখনো করা হয়নি, কিন্তু বিশ্বজুড়ে বেশ কিছু প্রতিবেদন এসেছে এ ব্যাপারে। প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে কিভাবে বিশ্বজুড়ে সম্প্রদায়গুলো নিজস্ব আয়জনে এই সংকট মোকাবিলা করছে, যেমন অভাবীদের সহায়তা করছে, সম্প্রদায়গুলোকে সক্রিয় রাখছে, যখন কিনা একই সময়ে সরকারগুলো কিছুই করছে না বা আরো খারাপ করছে।

উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসেবে ব্রাজিলে রিও এর বস্তিগুলোর কথা বলা যায়। ভয়াবহ ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি এলাকা, পানির মজুত সীমিত। সরকারের অবস্থাও ভয়াবহ। অবশেষে একটা সংগঠিত অপরাধী গোষ্ঠী (ক্রাইম গ্যাং) এলাকায় দখল করে লকডাউন আরোপ করে এবং কিছু প্রাথমিক পরিষেবা দেয়া শুরু করে। স্পষ্টতই তারা ভাল কাজ করছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বহু লোককে মারতে শুরু করে।

আমি আন্তর্জাতিকতা ও পারস্পরিকতার গুরুত্ব, এবং কীভাবে এগুলো ফিলিস্তিনকে সাহায্য করতে পারে তা নিয়ে কথা বলতে চাই আমরা প্রায়ই দেখি যে আন্তর্জাতিকতা উল্টো দিকে চলছে যেমন, দমন কৌশলগুলো শিখানোর জন্য ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে আসছেন তবে দৃশ্যটা প্রায় সময়ে উল্টে যায় যখন ফিলিস্তিনিদের এর সাথে ফার্গুসন, মিসৌরি, ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংহতি ও কৌশলের একাত্মতা পাওয়া যায় ফিলিস্থিনের এই ধরনের আন্তর্জাতিকতা নিয়ে আপনার কি মত ?

আপনার কথা ঠিক আছে। দু ধরনের আন্তর্জাতিকতা রয়েছে। একটা হচ্ছে শক্তিশালীদের ও জুলুমকারীদের আন্তর্জাতিকতা, আরেকটা হচ্ছে স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের জন্য লড়াইরত মজলুমদের আন্তর্জাতিকতা। সব সময়ের জন্য এটি সত্য। যেমন, আমেরিকান বিপ্লবের সময়ের দিকে ফিরে দেখতে পারেন। ব্রিটিশদের পক্ষ হয়ে জার্মান থেকে হেসিয়ান সেনাবাহিনী লড়াই করছিল। অন্যদিকে আমেরিকার পক্ষ নিয়েছিল ফ্রান্স থেকে আসা লাফায়েতরা। এই রকম উদাহরণ আরো দেয়া যাবে। ইতিহাসজুড়েই আমরা উভয় প্রবণতা দেখতে পাই। ধনী ও শক্তিশালীদের মধ্যে সাধারণ স্বার্থ থাকত যেগুলো তারা একে অপরকে সহযোগিতার মাধ্যমে কায়েম করতে চাইত।

আর্টওয়ার্ক: রিমেমবার
শিল্পী: লুকা গ্যারোঞ্জি
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

যুক্তরাষ্ট্র যখন লাতিন আমেরিকার কিছু দেশে ডানপন্থী সামরিক ষড়যন্ত্রে মদদ দেয় তখন সেটা ছিল ধনী ও শক্তিশালীদের পারস্পরিকতা। ১৯৮০ এর দশকে আমরা একটা দুর্দান্ত আশ্চর্য রকমের উন্নতি দেখেছি । যদিও এটা নিয়ে আলোচনা হয় নাই কেননা এটা ভয়ংকর ছিল। ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত মূলধারার সহস্রাধিক সাধারণ মানুষ এমন একটি দেশে গিয়েছিল যা কিনা ভুল রাষ্ট্র দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল কেবল কিছু সহায়তা দেয়ার জন্যই না, এমনকি তাদের জীবনযাপনে অংশ নেয়ার চেষ্টা করার জন্য। অথচ যখন যুক্তরাষ্ট্র ইন্দোচিন ধ্বংস করছিল এবং ফ্রান্স আলজেরিয়াকে পিষে ফেলছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র বা ফ্রান্সের প্রায় কেউ ভাবেনি ভিয়েতনাম বা আলজেরিয়ার কোনো গ্রামে যাওয়ার কথা। এসব ধারণা তখন কারও মাথায়ে আসেনি। কিন্তু  ৮০ এর দশকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে দশ হাজারের মত মানুষ কর্তৃক এটি ঘটেছিল এবং সারা দেশ জুড়েই এটা ছড়িয়ে পড়েছিল; যেমন, গ্রামীন কন্সাসের ইভাঞ্জেলিকাল চার্চও এতে অংশগ্রহণ করেছিল। স্যান্ডিনিসতাস নামে বিদ্রুপের শিকার হওয়া যুবকদের অংশগ্রহণই কেবল ছিল না; আন্তর্জাতিকতা এবং পারস্পরিকতার এক আশ্চর্যজনক ঘটনা ছিল সেটি। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল বিধায় একে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেয়ার দরকার পড়েছে। এটা মানুষের ভাবার কথা ছিল না, কিন্তু এটা ছিল এবং চলেও এসেছে। কেউই এটার পূর্বাবাস দিতে পারেনি। হুট করেই চলে এসেছিল। আমার মনে হয় এটা সবসময়ই উপরিতলের নিচেই থাকে।

আপনি ন্যায়সংগতভাবেই আ্যারিজনার টুসকান অঞ্চলকে ‘দখলকৃত অঞ্চল’ এবং উত্তর ও দক্ষিন আমেরিকার সমস্ত অঞ্চলকে ‘আদিবাসী ভুমি’ বলে উল্লেখ করেছেন বর্তমানে সীমান্ত এলাকাতে শিশুরা মারা যাচ্ছে, অনেকেই বন্দিত্বের শিকার হচ্ছেন এগুলোকে আপনি কীভাবে উপনিবেশবাদ ও গণহত্যার চলমান উত্তরাধিকারের অংশ বলবেন? এবং দখলকৃত ভূমিতে ন্যায়বিচার স্থাপন এবং উপনিবেশবাদের সংশোধনে কী করা যায় বলে আপনি মনে করছে?

এটি আরেকটা চমকপ্রদ ঘটনা। মোটের উপর আ্যারিজনা আসলে বামপন্থীদের জন্য স্বর্গ নয়। কিন্তু আপনি যদি অ্যারিজনার অন্তর্গত টুসকান এলাকার দিকে তাকান, যেখানে আমরা থাকি, সেখানে সর্বাধিক নিন্দিত লোকদের প্রতি সংহতিটা বেশ অসাধারণ বলা যায়। আমরা দক্ষিণের যে দেশগুলো ধ্বংস করেছি, সেখান থেকে পালিয়ে আসা শরনার্থীদেরকে আমেরিকার প্রোপাগান্ডা- ব্যবস্থার কাছ থেকে প্রচুর গালি শুনতে দেখা যায়। নতুন করে এই সম্বন্ধে আপনাকে কিছু বলতে হবে না, আপনি জানেন সব। এটি খুবই মর্মান্তিক একটা ব্যাপার। কিন্তু টুসকানে ‘নো মোর ডেথস’ নামে একটা গ্রুপ আছে, যাদের বেশিরভাগই বয়সে তরুণ। তাদের মধ্যে অনেকে রুক্ষ ও নিষিদ্ধ মরুভুমি এলাকায়ে গিয়ে শরনার্থীশিবির স্থাপন করে শরনার্থীদের জন্য সামান্য চিকিৎসা সহায়তা, সামান্য খাবার ও বিশ্রামের জন্য সামান্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে থাকেন। তারা মরুভূমিতে পানির বোতল ফেলে আসেন, এবং এটা একটা অপরাধ; এই অপরাধে অনেককে আদালতে বিচারের সম্মুখীন করা হয়।

সম্প্রতি বেশ কয়েকটা ফেডারেল ট্রায়াল হয়েছে, একটা এখনও চলছে। আসামীদের পক্ষে বেশ জোরালো সমর্থন রয়েছে। শহরে ঘুরতে বের হলে আপনি দেখবেন অনেকের উঠানে প্ল্যাকার্ড রাখা এবং তাতে লেখা যে মানবিক সহায়তা কোনো  অপরাধ নয়। যেমন, কয়েক মাস পূর্বে স্কট ওয়ারেন নামে একজনের বিরুদ্ধে ফেডারেল কোর্টে একটা অভিযোগ আনা হয়েছিল যার সাজা ছিল  সম্ভাব্য ২০ বছরের জেল। অভিযোগটা ছিল এই রকম যে ওয়ারেন মরুভুমিতে পালিয়ে থাকা লোকজনকে বাঁচতে সহায়তা করেছিল। এটি একটি জুরি ট্রায়াল ছিল এবং ২:১ জুরি ভোটে ওয়ারেন অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়েছিল। সুতরাং আপনার কাছে যেমন এইরকম মামলা – মোকাদ্দমার উদাহরণ রয়েছে, ঠিক তেমনি ভাবে বিপরীত দিকে রয়েছে স্বতস্ফুর্ত, আন্তরিক ও অত্যন্ত সাহসী আন্তর্জাতিক সংহতির উদাহরণ। সীমান্ত রক্ষীবাহিনী কর্তৃক মরুভুমির শরনার্থী শিবিরগুলো ভেঙ্গে দেয়ার কয়েক মাস আগে আমি ও আমার স্ত্রী সেখানকার শিবিরগুলো দেখতে গিয়েছিলাম। উদ্যোগগুলো খুবই সাদামাটা, কিন্তু হৃদয়স্পর্শী। হতাশাগ্রস্ত মানুষজনের জন্য সহায়তা ও মুক্তির যথেষ্ট সম্ভাবনা ছড়িয়ে আছে সেসব উদ্যোগে।

ইরান নিয়ে সাম্প্রতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে মানুষ ইরাক যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ এর স্মৃতিচারণ করছে, যা কিনা ইতিহাসের বৃহত্তম বিক্ষোভ ছিল এবং সেটা যুদ্ধকে থামাতে পারে নি আপনি বলেছিলেন যে পেন্টাগন পেপারসের একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু উপেক্ষিত অংশ শেষের দিকে রয়েছে যেখানে পরামর্শদাতারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন যে  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিক্ষোভ বাড়তে থাকলে সেনাবাহিনীকে বিক্ষোভকারীদের সাথে লড়াই করতে বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘শান্তি’ বজায় রাখতে ভিয়েতনাম ছেড়ে আসতে হবে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই জমানাতে একটি কার্যকর যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ কী রকম হওয়া উচিৎ?

হ্যাঁ, আমি মনে করি পেন্টাগন পেপারের এই অংশগুলো আসলে কখনোই উল্লেখ করা হয় নি। পেপারের একেবারে শেষ দিকে, দক্ষিন ভিয়েতনামে টেট আক্রমণের পর লিন্ডন জন্সনের সরকার আরো ১,০০,০০০ সেনা পাঠানোর কথা ভাবছিলেন এবং যুগ্ম প্রধানরা এর বিরোধিতা করেছিলেন। যুগ্ম প্রধানরা উদ্বিগ্ন ছিল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেসামরিক বিশৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রনের জন্য তাদেরকে এই সেনাদের প্রয়োজন পড়তে পারে । এই বিষয়ের বেশ কিছু প্রমান ড্যান এলসভার্গ প্রথমে সবার নজরে এনেছিলেন। এখন আরও প্রমাণ সামনে এসেছে যে নিক্সন প্রশাসন সেই সময়ে পরমাণু অস্ত্র নিয়ে গুরুত্বের সাথে ভাবছিল কিন্তু তা থেকে বেরিয়ে এসেছিল মূলত টেট আক্রমণের পর ওয়াশিংটনে বিশাল যুদ্ধ বিরোধী বিক্ষোভ এর কারণে। ওই বিক্ষোভের পরেই সরকার ইন্দোচিনের অপরাধ থেকে ধীরে ধীরে নিজেদেরকে দূরে সরাতে শুরু করে। কিছু এখনো অব্যাহত রয়েছে তবে তারা ধীরে ধীরে এর প্রকোপ হ্রাস করা শুরু করেছিল।

আর্টওয়ার্ক: ভিয়েতনাম-২
শিল্পী: লিওন গোলুব
সূত্র: পিবিএস

১৯৮০ এর দশকের মধ্যে, [জনপ্রিয়] যে আন্দোলনের কথা আমি বর্ণনা করেছি তা আমি মনে করি [আসলে] ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের একটা স্বাভাবিক ফল  ছিল। ১৯৭৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এই যুদ্ধ সম্পর্কে জনগনের মতামতকে বহু বছর ধরে অনেক সতর্কতার সাথে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। আপনি এটা দেখলে খুবই আশ্চর্য হবেন। দেখা যাচ্ছে, ৭০ শতাংশ জনগন এই যুদ্ধকে বিবেচনা করছেন, আমি উদধৃত করছি ‘ভুল নয়, পুরোপুরি অন্যায় এবং অনৈতিক’ হিসেবে। এই তথ্য আপনি বামপন্থী মহল ব্যতীত অন্য বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায় এর কাছ থেকে বা অন্য  একাডেমিক জার্নালগুলোতে খুঁজে পাবেন না। জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমে আপনি এটা পাবেন না তবে এটাই জনমত ছিল এবং ৮০ ‘এর দশক ধরে চলছিল; অন্ততপক্ষে জরিপগুলো তাই বলে। এবং আমি মনে করি সেট্রাল আমেরিকায় বিভিন্ন জনপ্রিয় আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া ও সংহতি প্রকাশ এই মনোভাব তৈরিতে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিল। এটি রিগানের প্রোগ্রামগুলোর রাশ টেনে ধরেছিল। তার প্রাথমিক প্রোগ্রামগুলো ছিল ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যা করেছে তা বজায় রাখা কিন্তু তারা দ্রুত পিছু হটে এসেছিল। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল যে ঐ সময়ের [জনগণের] মেজাজের সাথে তারা পেরে উঠতে পারবে না।

ইরাক প্রসঙ্গে, আপনি যেমনটা বলেছেন, সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভটা হয়েছিল মূলত আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার আগেই। যদিও একে ‘ব্যর্থতা’ হিসেবে দেখা হয়, আমি ঠিক তা বিশ্বাস করি না। আমি মনে করি, সরকার যা করতে পারত, বিক্ষোভ তাতে একটা বাধা সৃষ্টি করেছিল। যথেষ্ট খারাপ কিছু ঘটলেও প্রতিবাদ তৈরি হওয়ার আগে কেনেডি এবং জনসন ভিয়েতনামে যা করেছিলেন, তার মতোই কিছু ইরাকে ছিল না। তাই আমি মনে করি বিক্ষোভটা আংশিক সফল ছিল এবং এইটাই এখন প্রমাণিত হচ্ছে। দেশে অনেক প্রতিবাদের তরঙ্গ দেখা যাচ্ছে – এর কিছু বিক্ষোভ আকারে দৃশ্যমান। তবে বেশিরভাগই মানুষের সাধারণ মনোভাব আকারে প্রকাশ পাচ্ছে। মনোভাবগুলো বার্তা দিতে চায় যে তারা মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধ চায় না। সম্ভবত এটির একটি প্রভাব ভবিষ্যতে দেখা যাবে। এটি মূলত আমাদের মত লোকের, নেতাকর্মীদের ও সংঘটকদের উপর নির্ভর করে যারা বিরোধিতা ও অসন্তুষ্টির সাধারণ মনোভাবকে আরেকটি পরিবর্তনকামী সক্রিয় আন্দোলনে পরিণত করতে পারবে কিনা।

অরাজ প্রচ্ছদ পাতায় প্রথম প্রকাশ: ২০ শে জুন, ২০২০

ইফতেখার রুমি

ইফতেখার রুমি লেখক ও অনুবাদক। কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ উইন্ডসরে অর্থনীতি বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী। এর আগে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিষয়ের ছাত্র ছিলেন। ইমেইল: fakhrudi@uwindsor.ca