অরাজ
আর্টওয়ার্ক: হেড ইন ক্লাউডস শিল্পী: ইমানুয়েল দেল রসো সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট
প্রচ্ছদ » নাওমি ক্লেইন।। দুর্যোগ পুঁজিবাদের জন্য মোক্ষম সুযোগ করোনা ভাইরাস

নাওমি ক্লেইন।। দুর্যোগ পুঁজিবাদের জন্য মোক্ষম সুযোগ করোনা ভাইরাস

অনুবাদ: সারোয়ার তুষার 

আর্টওয়ার্ক: নাওমি ক্লেইন
সূত্র : ডিপি

অনুবাদকের ভূমিকা: কানাডিয়ান লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট নাওমি ক্লেইন ২০০৭ সালে Shock Doctrine : The Rise of Disaster Capitalism নামে একটি বই লেখেন। যেখানে তিনি দেখিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কীভাবে নয়া-উদারবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা টিকে থাকে মূলত সংকট তৈরি করে এবং সংকটকে কাজে লাগিয়ে। তিনি দেখিয়েছেন ১৯৭৩ সালের চিলি থেকে শুরু করে ইরাক পর্যন্ত কীভাবে মিল্টন ফ্রিডম্যানের ‘মুক্ত-বাজার অর্থনীতি’র প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব বাস্তবায়ন করা হয়েছে ‘শক থেরাপি’র মাধ্যমে। বিশ্বের উন্নত, অনুন্নত দেশ নির্বিশেষে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-প্রাকৃতিক দুর্যোগকে কাজে লাগিয়ে (কোন কোন ক্ষেত্রে দুর্যোগ সৃষ্টি করে) নয়া উদারবাদী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এলিট ও আন্তর্জাতিক কর্পোরেট মহল তাদের প্রতিক্রিয়াশীল, আরোপিত নীতি গ্রহণে বিশ্বের জনপদগুলোকে বাধ্য করে এবং একের পর এক অঞ্চলের নিজস্ব রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি সহ গোটা জীবনযাপন মুখ থুবড়ে পড়ে। ক্লেইন একে বলছেন ‘দুর্যোগ পুঁজিবাদ’ (Disaster Capitalism)। স্থানিক রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতির স্বচ্ছন্দ বিকাশকে শক থেরাপির মাধ্যমে স্তব্ধ করাই যার মূল্য লক্ষ্য। এইভাবে বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এলিটদের আরোপিত প্রতিক্রিয়াশীল নীতি চাপিয়ে দেয়ার মতবাদই ‘শক ডক্ট্রিন’ (Shock Doctrine)।

গোটা পৃথিবী করোনা ভাইরাসের থাবায় পর্যুদস্ত। ইতোমধ্যেই অসংখ্য মানুষ নিহত ও আরো বেশি সংখ্যক মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। থমকে গেছে গোটা পৃথিবী। সমস্ত রকমের সামাজিক-রাজনৈতিক তৎপরতা ব্যাহত হচ্ছে। ক্লেইন এই সাক্ষাতকারে দাবি করছেন, তাঁর দুই দশকের গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি আঁচ করতে পারছেন, এ রকম একটা নজিরবিহীন সংকট ও সংকট-পরবর্তী সময়কে কীভাবে বিশ্বের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এলিটরা তাদের ফায়দা লোটার কাজে লাগাতে পারে।

যে নীতিগুলো হয়তো স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে গ্রহণ করলে প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হতো রাষ্ট্রসমূহকে, সেই নীতিগুলোই এখন দুর্যোগের অজুহাতে অনায়াসে চাপিয়ে দেয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক সুরক্ষা খাতগুলোকে সংকুচিত করে কর্পোরেট শিল্পখাতগুলোকে বিশেষ আর্থিক ভর্তুকি দেয়ার পাঁয়তারা চলছে, যে কর্পোরেশনগুলো আসলে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এই রকম সংকটের জন্য দায়ী। অন্যদিকে সবেতন ছুটির অধিকার না থাকায় শ্রমজীবী মানুষকে অসুস্থতা নিয়েও কাজে যেতে হচ্ছে। আবার চীনা সরকার ঘোষণা দিয়েছে, সংকট ‘কাটিয়ে উঠতে’ তারা যেসব পরিবেশগত মান ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে মানতে হত, তা শিথিল করবে।

বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাসের আতঙ্ককে কাজে লাগিয়ে ‘জরুরি অবস্থা’ জারির পাঁয়তারা চলছে। অথচ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসনাত কাইয়ূম বলছেন, ‘মেডিকেল ইমার্জেন্সি’ আর ‘প্রক্লেমেশন অব ইমার্জেন্সি’ এক কথা নয়। আমাদের একদিকে ‘মেডিকেল ইমার্জেন্সি’ ঘোষণা করা দরকার এবং অন্যদিকে মানুষ যাতে সরকারের উপর নজরদারি এবং সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ঘাটতি নিয়ে আরো বেশি কথা বলতে পারে তার জন্য স্বাধীনতাও দরকার । মেডিকেল ইমার্জেন্সির অজুহাতে ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করে মানুষের যতটুকু বাক স্বাধীনতা আছে তাও কেড়ে নিলে, এ বিপর্যয় থেকে এখানকার মানুষদের রক্ষা করা যাবে না। ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করার অর্থ হচ্ছে সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকারসমূহ রদ করা যাবে এবং এ নিয়ে আদালতে চাইলেই রিট করা যাবে না। করোনার মত দুর্যোগে আমাদের দরকার নিরাপদ থেকে পারস্পরিক সহযোগিতা বজায় রাখা। সামাজিক সংহতিকে সুদৃঢ় করা। কোনভাবেই এমন কোন দাবি জানানো উচিত নয় যা আদতে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকে আরো সুসংহত করে। করোনার কালে আমাদের দরকার শারীরিক দুরত্ব ও সামাজিক সংহতি। আমাদের দরকার আতঙ্ককগ্রস্ত না হয়ে সর্বোচ্চ সক্রিয়তা ও সতর্কতা। ভিন্নভাবে সমাজকে সংগঠিত করতে পারার মত একাগ্রতা ও রূপকল্প।

নিশ্চিতভাবেই করোনা পূর্ববর্তী পৃথিবী ও করোনা-উত্তর পৃথিবী এক রকম থাকবে না। খুব ভালো কিংবা আরো খারাপ দুই সম্ভাবনাই আছে। মহামারির মত এরকম জরুরি পরিস্থিতি কিন্তু রাষ্ট্রের জন্য বেশ ভালো ছুতা। ক্ষমতা আরো কেন্দ্রীভূত করা, ‘জনকল্যাণ’ এর নামে যেকোন ডিক্রি জারির করতে পারার পক্ষে একটা জনসম্মতি তৈরি হয়ে থাকে এই সময়ে। আবার যারা ভিন্নভাবে সমাজকে সংগঠিত করতে চায়, তাদের যদি পরিস্কার বোঝাপড়া থাকে, পরিস্থিতি সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকে; তাহলে মহামারির সুযোগে রাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক এলিট কর্তৃক সমাজকে আরো সংকুচিত করার বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার হতে পারবে।

এই প্রেক্ষিতেই নাওমি ক্লেইনের শক ডক্ট্রিন ও দুর্যোগ পুঁজিবাদের পাঠ করা দরকার আমাদের। চিন্তা ও তৎপরতার মাধ্যমে নয়া উদারবাদী রাজনৈতিক-অর্থনীতির ‘শক’ এর বিরুদ্ধে গণমানুষকে সংগঠিত করা দরকার। তাহলেই কেবল আমরা বর্তমান ‘দুর্যোগ’ এবং ভবিষ্যত ‘দুর্যোগ’ এর সম্ভাবনাকে নাকচ করতে পারব।

আর্টওয়ার্ক: কোভিড- ১৯
শিল্পী: আন্দ্র পেসিয়া
সূত্র : কার্টুন মুভমেন্ট

বৈশ্বিক মহামারির সংকট থেকে সরকার ও বৈশ্বিক এলিটদের ফায়দা লুট সংক্রান্ত নাওমি ক্লেইনের বিশ্লেষণ

করোনাভাইরাস আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত একটি বৈশ্বিক মহামারি যা এ পর্যন্ত সার্সের (Severe acute respiratory syndrome) চেয়ে ১০ গুণ বেশি লোককে সংক্রমিত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, যাদুঘর এবং থিয়েটারগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এবং সম্ভবত খুব শীঘ্রই, সবগুলো শহরও একই পরিণতির দিকে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন যে কিছু লোক যাঁরা আশংকা প্রকাশ করেছেন যে তারা COVID-19 নামে পরিচিত ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন, তারা তাদের প্রাত্যহিক কার্যক্রম চালিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন, কারণ আমাদের বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবায় সিস্টেমেটিক ব্যর্থতার কারণে বেতনভুক্ত অবসরের সুবিধা নেই।

কী করতে হবে বা কার কথা আমলে নিতে হবে সে ব্যাপারে আমাদের বেশিরভাগই নিশ্চিত না। রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রসমূহের সুপারিশগুলোর সাথে রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের বার্তা সাংঘর্ষিক এবং এই মিশ্র বার্তাসমূহ অত্যন্ত সংক্রামক এই ভাইরাসের ক্ষয়-ক্ষতি প্রশমিত করার ক্ষেত্রে আমাদের সময়কে আরও সংকুচিত করেছে।

এই হলো সেই মোক্ষম পরিস্থিতি যখন আমরা সকলে উদ্বিগ্ন থাকার ফলে সরকার ও বৈশ্বিক এলিটদের পক্ষে এমন সব রাজনৈতিক এজেণ্ডা চরিতার্থ করা সম্ভব হয় যা অন্যক্ষেত্রে প্রবল বিরোধিতার মুখোমুখি হতে পারত। এহেন ঘটনাপ্রবাহ কেবল করোনভাইরাস দ্বারা উদ্ভূত সংকটের ক্ষেত্রেই অনন্য তা নয়; বরং রাজনীতিবিদ এবং সরকারসমূহ কয়েক দশক ধরে ‘শক ডকট্রিন’ হিশেবে পরিচিত এই নীলনকশাই অনুসরণ করে আসছে। অ্যাক্টিভিস্ট ও লেখক নাওমি ক্লেইম ২০০৭ সালে লিখিত বইয়ে একেই ‘শক ডকট্রিন’ হিশেবে অভিহিত করেছেন।

ইতিহাস হচ্ছে যুদ্ধ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও অর্থনৈতিক সঙ্কট এর আঘাত এবং আঘাত পরবর্তী পরিণতির প্রবাহমানতা। ‘দুর্যোগ পুঁজিবাদ’ (Disaster Capitalism)-এ এই পরিণতিকেই রূপায়িত করা হয়। পূর্বনির্ধারিত, মুক্ত-বাজার ‘সমাধান’ দ্বারা সংকটগুলোর যে ‘সমাধান’ হাজির করা হয় তা বিদ্যমান বৈষম্য ও শোষণকে আরো তীব্র করে তোলে।

ক্লেইন বলেন যে, আমরা ইতিমধ্যেই দুর্যোগ পুঁজিবাদকে জাতীয় পর্যায়ে প্রবল পরাক্রমে বিরাজ করতে দেখছি; করোনা ভাইরাসের প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প ৭০০ বিলিয়ন ডলারের একটি উদ্দীপক প্যাকেজ প্রস্তাব করেছেন যা পে-রোল ট্যাক্সকে সংকুচিত করার মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তাকে ধ্বংস করবে এবং মহামারির বদৌলতে ব্যবসায় লোকসানের শিকার হওয়া শিল্পখাতগুলোকে সহায়তা প্রদানের মত কর্মসূচিকে অন্তর্ভূক্ত করবে।

ক্লেইনের ভাস্যমতে, ‘তারা এটা এজন্য করছে না যে তারা মনে করে মহামারির ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার এটাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা ; বরং তারা এটা এজন্য করছে যে আগে থেকেই পরিকল্পিত এসব কৌশল বাস্তবায়নের একটা মওকা তাদের সামনে হাজির হয়েছে’।

করোনাভাইরাসের ‘আঘাত’ কীভাবে এক দশকেরও বেশি সময় আগে তাঁর বর্ণিত ঘটনাপ্রবাহের পরিসর তৈরি করছে সেই ব্যাপারে ‘VICE’ ক্লেইনের সাথে আলাপ করেছে।

প্রশ্ন : একেবারে গোড়া থেকে শুরু করা যাক। দুর্যোগ পুঁজিবাদ কী? ‘শক মতবাদ’ এর সাথে এর সম্পর্ক কী?

নাওমি ক্লেইন : দুর্যোগ পুঁজিবাদকে আমি যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেছি তা সত্যিই সোজাসাপ্টা। এটি বেসরকারি শিল্পগুলো যেভাবে বড় আকারের সঙ্কট থেকে সরাসরি মুনাফার জন্য চাঙ্গা হয় তার বিবরণী পেশ করে। দুর্যোগ ও যুদ্ধ থেকে মুনাফা অর্জনের ধারণা নতুন কিছু নয়, তবে বুশ প্রশাসনের অধীনে ৯/১১’র পরে এই প্রবণতা আরো গভীরতর হয়েছে। যখন প্রশাসন এই ধরনের অনন্ত নিরাপত্তা সঙ্কট ঘোষণা করেছিল এবং একই সাথে এটি বেসরকারিকরণ ও আউটসোর্স করেছিল — এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল অভ্যন্তরীণ বেসরকারি সুরক্ষা রাষ্ট্রের পাশাপাশি ইরাক ও আফগানিস্তানের [বেসরকারি] আক্রমণ ও দখল। ‘শক ডকট্রিন’ হ’ল বড় আকারের সংকটকে পুঁজি করে বৈষম্যকে পদ্ধতিগতভাবে আরও গভীরতর করে তোলার রাজনৈতিক কৌশল যা এলিটদের আরো সমৃদ্ধ করে এবং অন্য সকলকে আরো নিঃশেষ করে। সংকটের মুহুর্তগুলোতে, মানুষ সাধারণত সেই সংকট উতরানোর নিত্যনৈমিত্তিক জরুরি পরিস্থিতির দিকেই মনোনিবেশ করে; এবং যাই হোক না কেন ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের উপর খুব বেশি ভরসা রাখার প্রতি ঝোঁক থাকে। সঙ্কটের মুহুর্তগুলোতে আমরা সাধারণত মূল ঘটনা থেকে আমাদের নজর কিছুটা হলেও অন্যত্র সরিয়ে নেই।

প্রশ্ন : রাজনৈতিক কৌশলটি কোথা থেকে আসে? আমেরিকান রাজনীতিতে আপনি এর ইতিহাস কীভাবে চিহ্নিত করবেন?

নাওমি ক্লেইন : শক-মতবাদ কৌশলটি এফডিআরের অধীনে মূল নতুন চুক্তির প্রতিক্রিয়া হিসাবে ছিল। অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান বিশ্বাস করেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মহামন্দা ও ধূলোঝড়ের প্রতিক্রিয়ায় গৃহীত নতুন চুক্তির অধীনে সমস্ত কিছু ভুল হয়েছে। দেশে অধিকতর সক্রিয় সরকার গড়ে উঠেছে, যা কিনা সরকারি কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও ত্রাণ সরবরাহের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রত্যক্ষ সমাধানকে নিজের লক্ষ্য হিশেবে নিয়েছিল। আপনি যদি মুক্তবাজার অর্থনীতির কট্টরপন্থী সমর্থক হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি জানেন যে, যখন বাজার ধসে পড়ে তখন তা, বড় বড় করপোরেশানগুলোর স্বার্থ উদ্ধার করে এমন নিয়ন্ত্রণবিহীন পলিসি গ্রহণের চেয়ে বরং অধিক স্বতস্ফূর্তভাবে নিজেকে প্রগতিশীল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিয়ে যায়। অর্থাৎ প্রগতিশীল নীতিসমূহের আবির্ভাব ঘটে যেইসব মুহূর্তে সেসব মুহূর্তকে পথ ছেড়ে দিলে যে ‘সংকট’ তৈরি হবে তাকে প্রতিহত করার জন্যই শক ডকট্রিনের আবির্ভাব ঘটেছিল। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এলিটরা বুঝতে পারে যে সংকটের মুহুর্তগুলোই তাদের অজনপ্রিয় নীতিসমূহের তালিকা চাপিয়ে দেয়ার মোক্ষম সময়, যার এই দেশে এবং বিশ্বজুড়ে সম্পদের আরো মেরুকরণ সম্ভব হয়।

আর্টওয়ার্ক: করোনা প্যানিক
শিল্পী: পেড্রো
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

প্রশ্ন : এই মুহুর্তে আমাদের একাধিক সংকট ঘটমান: একটি মহামারি, এটির ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত অপ্রতুলতা এবং পতনোন্মুখ স্টক মার্কেট। আপনি কি ব্যাখ্যা করবেন আপনার শক মতবাদ প্রকল্পের সাথে এই প্রত্যেকটি উপাদান কীভাবে খাপ খায়?

নাওমি ক্লেইন : আসলে ভাইরাস নিজেই একটা শক । এবং এটি এমনভাবে ব্যবস্থাপিত হয়েছে যা বিভ্রান্তি বাড়িয়ে সুরক্ষা হ্রাস করেছে। আমি মনে করি না যে এটি কোন ষড়যন্ত্র, বরং ঠিক এইভাবেই মার্কিন সরকার এবং ট্রাম্প এই সঙ্কটের তালগোল পাকিয়েছে। ট্রাম্প এ পর্যন্ত এটিকে জনস্বাস্থ্য সংকট নয় বরং উপলব্ধিজনিত সংকট হিশেবে চিহ্নিত করেছেন এবং তার পুনর্নির্বাচনের সম্ভাব্য সমস্যা হিসাবে বিবেচনা করেছেন। পরিস্থিতির এই হচ্ছে সবচাইতে খারাপ দিক, বিশেষত আমেরিকার জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি নেই এবং শ্রমিকদের সুরক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় আছে। সংকটের এই ঘনীভবন সর্বোচ্চ ঝাঁকুনি তৈরি করেছে। এই পরিস্থিতি শিল্পখাতগুলোকে আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার অজুহাত হিশেবে ব্যবহৃত হবে যার ফলে আমরা জলবায়ু সঙ্কটের মতো চরম কোন সঙ্কটের কেন্দ্রে ঠেলে দিচ্ছে। এয়ারলাইন, গ্যাস ও তেল, সমুদ্র শিল্পের মতো শিল্পগুলোর পতন তারা এই সুযোগে ঠেকাতে চায়।

প্রশ্ন : ইতোপূর্বে আমরা এই নাটকটি কীভাবে মঞ্চস্থ হতে দেখেছি?

নাওমি ক্লেইন : The Shock Doctrine বইয়ে আমি হারিকেন ক্যাটরিনার পরে এটি কীভাবে ঘটেছিল তা নিয়ে কথা বলেছি। হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের মতো ওয়াশিংটন থিংকট্যাঙ্কগুলো ক্যাটরিনার জন্য মুক্তবাজারের অনুকূল সমাধানগুচ্ছ হাজির করেছিল। আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি, ঠিক একইরকমের প্রকল্প এই ক্ষেত্রেও আনা হবে। আসলে, ক্যাটরিনা গ্রুপের প্রধান ছিলেন মাইক পেন্স। ২০০৮ সালে, আপনি ব্যাংকগুলোকে আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার ক্ষেত্রে দেখেছেন যেখানে বিভিন্ন দেশ ব্যাংকগুলোকে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের সাদা চেক দিয়েছিল। কিন্তু এর আসল প্রভাব টের পাওয়া গিয়েছিল অর্থনৈতিক কৃচ্ছতাসাধন তথা সামাজিক সেবাসমূহ সংকোচন নীতির মধ্যে।সুতরাং এখন যা কী চলছে কেবল তাই নয়, যখন এই সমস্ত কিছুর জন্য কড়া মাসুল চুকানোর পরিস্থিতি হাজির হবে তখন তারা কীভাবে তা পাশ কাটায় সেটাই মূল বিবেচ্য।

প্রশ্ন : করোনাভাইরাসের ইতোমধ্যেই যে দুর্যোগ পুঁজিবাদের মওকা হাজির হয়েছে তার ক্ষয়ক্ষতি প্রশমনের জন্য জনগণ কী করতে পারে? হারিকেন ক্যাটরিনা বা সর্বশেষ বৈশ্বিক মন্দার সময়ে যে সংকটের মধ্যে আমরা ছিলাম, বর্তমানে কি আমরা তার চেয়ে ভালো পরিস্থিতিতে আছি? নাকি পরিস্তিতি আরো করুণ হয়েছে?

নাওমি ক্লেইন : যখন আমরা কোন সঙ্কটে পতিত হই তখন আমরা আরো পিছিয়ে কিংবা ভেঙ্গে পড়ি, অথবা আরো লায়েক হয়ে উঠি এবং মনোবল ও মমত্ববোধের দুর্গ হয়ে উঠি যা ইতোপূর্বে আমাদের পক্ষে সম্ভব বলে আমরা মনে করতাম না। এবারো একই রকমের পরীক্ষার মুখোমুখি আমরা। আমি কিছুটা আশাবাদী কারণ এবার বিকশিত হওয়া ও আমাদের সমস্ত দুর্বলতার গোড়া এই সংকটকে ভিন্নভাবে মোকাবেলা করার মত রাজনৈতিক বিকল্প এবং সেই বিকল্পকে সমর্থন যোগানোর মত বৃহৎ রাজনৈতিক আন্দোলন বর্তমানে আছে ; যা ২০০৮ এ ছিল না। গ্রিন নিউ ডিলের সমস্ত পরিকল্পনার মূলে কাজ করছে এই ধারণাই : এরকম একটা মুহুর্তের জন্য তৈরি হওয়া। আমরা কোনভাবেই আমাদের সাহস হারাতে পারি না; সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, সার্বজনীন শিশু যত্ন, অসুস্থতাকালীন সবেতন ছুটি প্রদানের জন্য আমাদের আগের তুলনায় আরও কঠোর লড়াই করতে হবে — কারণ এই সমস্ত কিছুই অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত।

আর্টওয়ার্ক: করোনা ভাইরাস
শিল্পী: মোহাম্মদ সাবানেহ
শিল্পী: কার্টুন মুভমেন্ট

প্রশ্ন : সরকারসমূহ এবং বৈশ্বিক এলিটরা তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে যদি মহামারির সঙ্কটকে ব্যবহার করে, তাহলে পরস্পরের প্রতি যত্নশীল হওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ কী কী করতে পারে?

নাওমি ক্লেইন : ‘নিজের ভরণপোষণ আমি নিজেই করব এবং প্রচলিত সর্বোৎকৃষ্ট বীমাটাই আমি পাব; আপনার যদি ভাল বীমা না হয় তবে এটি সম্ভবত আপনারই দায়, আমার নয়’। ‘যে জিতবে সেই সিকান্দার’ মার্কা অর্থনীতি এই ধারণাই আমাদের মস্তিষ্কে গ্রথিত করে। সংকটের এমন মুহুর্তগুলো পরস্পরের প্রতি আমাদের ছিদ্রান্বেষী মানসিকতাকেই উন্মোচন করে। কিন্ত এরকম কঠিন সময়ে আমরা উপলব্ধি করি বিচ্ছিন্নতা ও অপরের প্রতি নির্লিপ্তির যে বোধ চরম নির্মম এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আমাদের মধ্যে গেঁথে দিতে চায়, তার চেয়ে অনেক বেশি আমরা পরস্পরের সাথে যুক্ত। ভালো স্বাস্থ্যব্যবস্থা থাকলেই আমরা নিরাপদ থাকব এরকমটা আমরা মনে করতেই পারি; কিন্তু যে লোক আমাদের খাদ্য তৈরি করে বা আমাদের খাবার সরবরাহ করে, আমাদের বাক্সপেটরা গোছগাছ করে, তাদের যদি ভালো স্বাস্থ্যসেবা না থাকে কিংবা অসুখ-বিসুখের ক্ষেত্রে তারা যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর সুযোগ না পায় (অসুস্থতার সময়ে সবৈতনিক ছুটি না থাকার কারণে বাড়িতে অবস্থানের কথা নাহয় বাদই দিলাম) মনে করার কোন কারণ নাই যে আমরা নিরাপদ থাকব। যদি পরস্পরের যত্ন না নেই, তাহলে আমরা নিজেরাও অযত্নে থাকব। সেক্ষেত্রে আমরা চোরাবালিতে আটকা পড়ব। সমাজকে সংগঠিত করার বিভিন্ন উপায় আমাদের বিভিন্ন অংশকে আলোকিত করে। আপনি যদি জানেন আপনি এমন কোনও সিস্টেমে আছে যা মানুষের খেয়াল রাখেনা এবং সম্পদের ন্যায্য বন্টন করে না; তার মানে আপনার নিষ্ক্রিয় সত্তাটি জ্বলে উঠতে শুরু করেছে। সুতরাং নিষ্ক্রিয় না থেকে, সচেতন হোন এবং ভাবুন। কেবলমাত্র আপনার নিজের এবং আপনার পরিবারের যত্ন নেয়ার কথা না ভেবে, আপনার প্রতিবেশী এবং সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা মানুষটির দিকে নজর রাখুন।

সারোয়ার তুষার