অরাজ
আর্টওয়ার্ক: এগেন্স্ট টর্চার শিল্পী: ইয়াসের আবু হামিদ সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট
প্রচ্ছদ » টোটালিটারিয়ান পদ্ধতি : রাখাল বালকদের ভেড়া পালার রাজনীতি

টোটালিটারিয়ান পদ্ধতি : রাখাল বালকদের ভেড়া পালার রাজনীতি

  • ইরফানুর রহমান রাফিন

আমরা একটা পারফেক্ট দুনিয়ায় বাস করি না। আমাদের পৃথিবীতে প্রচুর ইনজাস্টিস আছে, ইনইকুয়ালিটি আছে। এটা একটা ফ্যাক্ট।

এই ইনজাস্টিস আর ইনইকুয়ালিটি আমরা কীভাবে ডিল করবো– এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে একটা টোটালিটারিয়ান পদ্ধতি উনিশ শতক থেকে তৈরি করা হয়েছে।

এই পদ্ধতির প্রথম ধাপ ‘নিজেকে’ ডিফাইন করা। একজন সামাজিক মানুষের একইসাথে অসংখ্য পরিচয় থাকে। টোটালিটারিয়ানরা এইসব পরিচয় থেকে যে-কোনো একটা বেছে নেয়, সেটাকে এবসলিউট করে তোলে, বাকি সব পরিচয়কে ইগনোর করে।

আর্টওয়ার্ক: আইডিওলজি
শিল্পী: ভ্লাদিমির কাজানোভস্কি
সূত্র কার্টুন মুভমেন্ট

এর পরের ধাপ হচ্ছে ‘অপরকে’ ডিফাইন করা। এই ক্ষেত্রেও আগের ধাপের কর্মপ্রণালীই অনুসৃত হয়। যাকে ‘অপর’ মনে করা হচ্ছে, তার বহু পরিচয় থেকে একটি পরিচয় বেছে নিয়ে সেটাকে এবসলিউট ধরে নেয়া হয়, বাকি সব পরিচয়কে ইগনোর করে।

তৃতীয় ধাপ হলো, এই পৃথিবীতে যা কিছু আনজাস্ট আর ইনইকুয়াল, তার সব দায় ‘অপরের’ ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া। তাকে ডিহিউম্যানাইজ করা, এবসলিউট শত্রু হিসেবে দেখা। তার বিরুদ্ধে একটা সিস্টেমেটিক প্রোপাগান্ডা ক্যাম্পেইন চালানো।

চতুর্থ ধাপ হলো, ‘অপরের’ বিরুদ্ধে ‘নিজের’ একটা পার্টিসংগঠন প্রতিষ্ঠা করা, সেটার জন্য একদল কর্তা খুঁজে বের করা। এই কর্তারা তত্ত্বগতভাবে ‘অপরের’ বিরুদ্ধে ‘নিজের’ প্রতিনিধি, বাস্তবে অবশ্য এদের কাজ ভেড়া পালা। কেউ তাদের বিরোধিতা করলে সেটাকে ‘নিজের’ বিরোধিতা হিসেবে দেখা হবে, দেখা হবে ‘অপরের’ দালালি হিসেবে, এবং পার্টিসংগঠনের ভেতরেবাইরে সম্ভাব্য সকল উপায়ে কার্যকর বিরোধিতার পথ আটকে দিতে হবে।

এর পরের ধাপ, ‘অপরের’ বিরুদ্ধে ‘নিজের’ একটা ব্যাপক মোবিলাইজেশন ঘটানো, এবং যে-কোনো উপায়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা।

তার পরের ধাপ, ক্ষমতায় গিয়ে রাষ্ট্রকে তত্ত্বগতভাবে ‘নিজের’ হাতে আর বাস্তবে কর্তাদের হাতে কেন্দ্রীভূত করা, সব ধরনের রাজনৈতিক বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করা।

সর্বশেষ ধাপ, যে ‘অপরকে’ এবসলিউট শত্রু হিসেবে দেখা হয়েছে, তাদেরকে ওপর গণহত্যা চালানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা।

আর্টওয়ার্ক: রি-রেভ্যুলিউশন
শিল্পী: শেরিফ আরাফা
সূত্র কার্টুন মুভমেন্ট

সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুদ্ধোত্তর পূর্ব ইওরোপ, ফ্যাসিস্ট ইতালি, নাৎসি জার্মানি, জাতীয়তাবাদী স্পেন, গণতান্ত্রিক কম্পুচিয়া বা ইসলামিক স্টেট তাদের মতাদর্শিক পার্থক্য সত্ত্বেও কমবেশি এই টোটালিটারিয়ান পদ্ধতিই অনুসরণ করেছে। ম্যাককার্থি যুগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও একই কাজ করেছে। এই ‘অপরের’ নাম কোথাও ‘প্রতিবিপ্লবী’ বা ‘শ্রমিক শ্রেণীর শত্রু’, কোথাও ‘ইহুদি-বলশেভিক চক্রী’ বা ‘গণশত্রু’, কোথাও ‘কুফফার’, আর কোথাও ‘কমি’… কিন্তু উদ্দেশ্য একটাই: কোনো না কোনো মানবগোষ্ঠীর ডিহিউম্যানাইজেশন।

বাম-ডান বা সেকুলার-রিলিজিয়াস ভেদে ধাপগুলোর সিকোয়েন্সে বৈচিত্র্য থাকতে পারে,আগে পরে হতে পারে, কিন্তু মূল পদ্ধতিটা একই। সবগুলো ধাপ হয়তো সকলে অনুসরণ করে না, কেউ কেউ হয়তো গণহত্যা চালায় না, চরম দমনপীড়নেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু মোটা দাগে এদের সকলের পদ্ধতিই টোটালিটারিয়ান।

শুধু মাঠের রাজনীতি দিয়ে টোটালিটারিয়ানিজম হয় না। এর জন্য বুদ্ধিবৃত্তি লাগে,মেধাবী মানুষ লাগে। প্রয়োজন হয় ইডিওলোগের।

এই ইডিওলোগরা টোটালিটারিয়ানিজমকে একটা আকর্ষণীয় চেহারা দেয়। কবিতা লেখে,ছবি আঁকে,বা গান বানায়। সাংস্কৃতিক মাধ্যম ব্যবহার করে টোটালিটারিয়ানিজমকে লোকপ্রিয় করে।

এদের কেউ কেউ একপ্রকার তত্ত্ব চর্চাও করে। সেটার উদ্দেশ্যও এক। তত্ত্বপ্রিয় মানুষদের কাছে টোটালিটারিয়ানিজমকে আকর্ষণীয় করে তোলা।

লিবারাল সমাজে এক ধরনের অ্যালিয়েনেশন তৈরি হয়। মানুষ তার পাশের লোকটাকেও ভয় পেতে থাকে,তার মধ্যে কিছু একটা আঁকড়ে ধরে বাঁচার প্রবণতা তৈরি হয়। জার্মান ইহুদি দার্শনিক হান্না আরেন্ডট মনে করেন,এই অ্যালিয়েনেশনের এক ধরনের সমাধান হিসেবে নিজেকে হাজির করে টোটালিটারিয়ানিজম,তাই তা বহু হতাশ মানুষের কাছে এতোটা গ্রহণযোগ্য মনে হয়।

আর্টওয়ার্ক: স্ট্রং আর্ম
শিল্পী: ভ্লাদিমির কাজানোভস্কি
সূত্র কার্টুন মুভমেন্ট

টোটালিটারিয়ান মানুষদেরকে নিয়ে সবচে বড়ো সমস্যাটা হচ্ছে, এরা কেউ এরশাদ সিকদার না, যে দেখেই কারো ভয় লাগবে। অন্তত বিপ্লবের আগ পর্যন্ত এদের অনেকেরই খুব মহৎ একটা চেহারা থাকে,যা বিশেষত দুনিয়াদারি না বোঝা আবেগসর্বস্ব তরুণদের ইনসিকিউরিটিকে ট্রিগার করে তাদেরকে পলিটিকালি সিডিউস করার কাজে আসে। টোটালিটারিয়ান কর্তাদের অনেকেই চমৎকার ভাষণ দিতে পারে, এদের ব্যক্তিত্ব প্রায়শই অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়  এবং এরা একটা নিজস্ব ভাষারীতি তৈরি করে নেয়। যেমন এরা যখন বলে কেয়ার নেয়া,তখন সেটা আসলে একটা ইউফেমিজম ছাড়া কিছুই নয়, যার আসল অর্থ মনস্তাত্ত্বিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। এরা যখন মেকি আক্ষেপের সুরে বলে জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারছি না, তখন সেটাও আর একটা ইউফেমিজম, যার আসল অর্থ পর্যাপ্ত পরিমাণ ভেড়াকে দলে ভেড়াতে পারছি না। এদের সবকিছুই ফেইক, এমনকি আত্মসমালোচনাটুকু পর্যন্ত ফেইক। কিন্তু এরা একটা পার্মানেন্ট স্টেট অফ ডিলিউশনের মধ্যে থাকে,বাস্তবতা থেকে কমপ্লিটলি ডিটাচড হওয়ায় এরা একটা মেক-বিলিভ ওয়ার্ল্ডে বাস করে,যেখানে তাদের নিজেদেরকে সত্যের সৈনিক মনে হয়।

আমাদেরকে একটা বেটার ওয়ার্ল্ডের জন্য ইনজাস্টিস আর ইনইকুয়ালিটির বিরুদ্ধে লড়তে হবে, কিন্তু সর্বপ্রকার টোটালিটারিয়ান টেম্পটেশনকে প্রত্যাখ্যান করে।

৬ জুলাই ২০১৯

ইরফানুর রহমান রাফিন

ইরফানুর রহমান রাফিনের জন্ম ১৯৯২এ, ঢাকার শাহবাগে। হোম টাউন কুমিল্লা। বিদ্যাশিক্ষা শহিদ বাবুল একাডেমী, সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ, এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পেশাগত জীবনের শুরু বাংলাদেশ অধ্যয়ন কেন্দ্র (সিবিএস) গবেষণা সহকারী হিসেবে, পরবর্তীতে মানব উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্রে (এইচডিআরসি) গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন, বর্তমানে তাসফিয়া তানজিম আহমেদ প্রমার সাথে ব্রেড অ্যান্ড রোজেস নামক একটি অনুবাদমূলক লেখালিখির উদ্যোগে প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে আছেন। ধর্ম থেকে ইতিহাস আর রাজনীতি থেকে সংস্কৃতি বহু বিষয়ে অপার আগ্রহ আছে তার, এসব বিষয়ে নিজের ওয়েবসাইটে লেখেন, এছাড়াও পত্রপত্রিকায় ও ওয়েব পোর্টালে তার লেখা ছাপা হয়েছে। প্রকাশিত বইঃ চলে যাওয়া সময় (কবিতা, আনন্দম: ২০১৯) এবং এক অসাধারণ অন্ধ সময়ের স্মৃতি (উপন্যাস, [কলকাতা] কাউন্টার এরাঃ২০২০ [ঢাকা] আফসার ব্রাদার্স: ২০২১)। ইমেইল যোগাযোগ: irrafin2020@gmail.com।