অরাজ
আর্টওয়ার্ক: দ্য কিলার ক্রিটিক আসাসি শিল্পী: কাটাজ সূত্র: পিনটারেস্ট
প্রচ্ছদ » একটি আষাঢ়ে গল্প

একটি আষাঢ়ে গল্প

  • শহিদুল ইসলাম

এক.
১৯৮১ সালে লিখেছিলাম ‘সাম্প্রতিক আবিষ্কারের আলোকে মানুষের উৎপত্তি ও তার ক্রমবিকাশ’ নামে একটি প্রবন্ধ। সেটি ছাপা হয়েছিল মফিদুল হক সম্পাদিত গণসাহিত্য পত্রিকার নবম বর্ষ: চতুর্থ-দশম সংখ্যা; আশ্বিন ১৩৮৮, অক্টোবর ১৯৮১ সংখ্যায়। মানুষের জন্ম কবে? মানুষ এলো কোথা থেকে? আজ যে চেহারা নিয়ে আমরা পৃথিবীতে বিচরণ করছি, এই চেহারা নিয়েই কি আমরা পৃথিবীতে এসেছি? এসব প্রশ্ন মানুষকে যুগে যুগে ভাবিয়েছে। জন্ম নিয়েছে হাজারো মিথ ও ধর্মের। পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম এসব প্রশ্নের একটা সমাধান দেবার চেষ্টা করে এসেছে। বহুকাল পর্যন্ত মানুষ বিশ্বাস করে এসেছে, সৃষ্টির প্রথম দিনটি থেকে মানুষ এই পৃথিবীতে বাস করছে মানুষ হিসাবেই। ধর্মীয় প্রভাবের আওতায় মানুষ কোনদিন ভাবতেই পারেনি যে নিম্নতর প্রাণিজগতের সঙ্গে রয়েছে আত্মীয়তার বন্ধন।

শহিদুল ইসলাম

১৯৯১ সালে নরওয়ে ভাষায় প্রকাশিত জাস্টিন গার্ডারের সফির জগত বইতে দু’টি প্রশ্ন উত্থাপন করে ১৪ বছরের সফিকে দর্শনের ক্রমইতিহাস শিখিয়ে ছিলেন। সে প্রশ্ন দু’টি হল: ‘তুমি কে?’ এবং ‘পৃথিবী কোথা থেকে এল?’ আদি গ্রিক দর্শন থেকে তিনি সাম্প্রতিককালের দর্শনের ইতিহাস উপন্যাসের মত তুলে ধরেছেন।

২০০৪ সালে রোনাল্ড রাইট তিনটি প্রশ্ন উত্থাপন করে মানুষের ভবিষ্যত কি তা খোঁজার চেষ্টা করেছেন। সে তিনটি প্রশ্ন হল: এক. আমরা কোথা থেকে এলাম? দুই. আমরা কে? ও তিন. আমরা কোথায় চলেছি? রাইট বলছেন যে, মনে হতে পারে তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। ভবিষ্যতে মানুষের কি হবে, তা কি আগে থেকে বলা যায়? কিন্তু রাইট মনে করেন, তা সম্ভব যদি আমরা প্রথম দু’টি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই। সে ইতিহাস তো আমাদের সামনেই আছে। তিনি আমাদের সভ্যতাকে একটি জাহাজ মনে করেন। প্রকৃতির সব আত্মীয়-স্বজনকে সে জাহাজে তুলে আমরা ভবিষ্যতের দিকে ছুটে চলেছি। সে জাহাজের গতিবেগ ক্রমাগত বাডছে। অতীতের চাইতে সে জাহাজ আজ অনেক বড়। আরো বেশি ভারাক্রান্ত। যে জাহাজে আজ আমরা চলেছি, সে জাহাজ কেবল সর্বকালের সর্ববৃহৎ জাহাজ নয়, সেটাই একমাত্র জাহাজ। অতীতে একটি জাহাজ ডুবলে আমাদের রক্ষার্থে আর একটি জাহাজে ওঠার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু আজ আর কোনো জাহাজ নেই। আজকের জাহাজ ডুবলে আর কোনো জাহাজ আমাদের উদ্ধার করতে আসবে না। তার অর্থ নির্ঘাত মৃত্যু। অন্যান্য প্রাণীর মত আমরাও ভুল করি। তারপর শিখি। এভাবেই আমরা এতদূর এসেছি। কিন্তু আজ ভুল করা বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়।

আমরা অধিকাংশ আজও ভিক্টোরিয়ো যুগের উন্নয়ন দর্শনে বিশ্বাসী। সে দর্শনের মূল কথা উন্নয়ন সবসময় উন্নয়নমুখি। তার গতি একমুখি। কেবল সামনের দিকে এগিয়ে চলে। সমাজ পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু সে পরিবর্তন কেবল উন্নয়নমুখি। এটাই হল ভিক্টোরিয়ো যুগের দর্শনের আসল কথা। উন্নয়ন কি কেবল প্রকৃতিক? স্তন্যপায়ী জীব সরীসৃপ থেকে দ্রুতগামী, উল্লুক ষাঁড়ের চেয়ে চালাক, মানুষ সবার চেয়ে চালাক। কিন্তু আমাদের প্রাযুক্তিক সংস্কৃতি প্রযুক্তির উন্নয়ন দিয়ে বিচার করা হয়। ঘুষির চাইতে মুগুর অনেক বেশি উন্নত, তীর-ধনুক মুগুরের চেয়ে ভাল এবং বুলেট তীর-ধনুকের চাইতে অনেক বেশি উন্নত।

আজ বিশ্বের বহু বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদ জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনবরত সাবধানবাণী উচ্চারণ করে চলেছেন। সুইডেনের ১৬ বছরের স্কুল ছাত্রী গ্রেটা থানবার্গ তো বলেইছে, আমাদের ঘরে আগুন লেগেছে। সে আগুন নেভানোর জন্য বিশ্বের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে এখুনি তৎপর হতে আহবান জানিয়েছে। তার সে ডাক পৃথিবীর কোনায় কোনায় পৌঁছে গেছে। তা এক বিরাট আন্দোলনের সূচনা করেছে। কিন্তু কোন দিক থেকে কোনো শুভ সংবাদ আসছে না। কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের ফল আমরা ইতিমধ্যে পেতে শুরু করেছি। সমগ্র পৃথিবী আজ অগ্নিদগ্ধ। জলবায়ু দূষণ চরম পর্যায়ে চলে গেছে। মানুষের তৈরি প্লাস্টিক মাত্র একশ’ বছরের মধ্যে আমাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁডিয়েছে। আজ প্লাস্টিকমুক্ত পৃথিবী গড়ার জন্য সারা বিশ্বে বিভিন্ন সংস্থা গড়ে উঠেছে।

আর্টওয়ার্ক: সামিট
শিল্পী: ফাদিটুন
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

আজ পৃথিবীর জনসংখ্যা ৭.৭ বিলিয়ন। আগামী ২০৫০ সালে তা ৯.৭ বিলিয়নে পৌঁছাবে এবং ২১০০ সালে ১১ বিলিয়নে। অর্থাৎ আর মাত্র ৩০ বছরের মধ্যে আমাদের আরো দুই বিলিয়ন মানুষের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যে হস্তক্ষেপ অপরিহার্য হয়ে পড়বে। এখুনি আমাদের দেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে উন্নয়নের ঢক্কানিনাদ শোনা যাচ্ছে, তাতে লক্ষ লক্ষ উদ্ভিদ ও প্রাণী নিশ্চিহ্ন হবার পথে। ১৯৭০ সালের পর আমাদের বৈষয়িক উন্নয়নের ফলে ৬০ ভাগ প্রাণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও শাসকশ্রেণীর কানে সেসব সাবধানবাণী প্রবেশ করছে না। প্রাযুক্তিক উন্নয়ন চোখে দেখা যায়। তাই প্রাযুক্তিক উন্নয়নের প্রতি পৃথিবীর সমস্ত সরকার একাট্টা। বুলেট ট্রেন, নয়নাভিরাম নগর- বন্দর-শহর, আকাশছোঁয়া ভবন, রিসোর্ট, পাঁচতারা হোটেল তৈরির দিকেই সবার মনোযোগ। জলবায়ুর ক্ষতি হোক কোন ক্ষতি নেই। লক্ষ কোটি গাছ কেটে, নদীনালা ভরাট করে সেখানে হাই রাইজ ভবনসহ ইকোপার্ক ইত্যাদি তৈরি করলে মানুষ একদিন সেই নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কথা ভুলে যাবে। যেমন আমরা জঙ্গলাকীর্ণ গুলশান বনানীর কথা ভুলে গেছি। পৃথিবীর উন্নতদেশের আলোকোজ্জ্বল শহরগুলি দেখে আমরা অবাক হয় ভাবি দেশটি কত উন্নত। কিন্তু যে প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করে সেইসব শহর গড়ে উঠেছে, আমরা তা ভুলে যাই।

তাই জন রাইটের জাহাজটি ডুবেছ। ষষ্ঠবারের মত পৃথিবী প্রাণ শুন্য হতে চলেছে। টাইটানিক জাহাজের মত আমাদের মানব-সৃষ্ট সভ্যতার জাহাজটি ডুবছে। আমরা ছুটাছুটি করছি। উদ্ধার করার কেউ নাই। অবশেষে সত্যিই একদিন জাহাজটি ডুবলো। পৃথিবী পৃষ্ঠ সবরকম প্রাণচাঞ্চল্য, শব্দ দূষণ, বায়ু দূষণ, পানি দূষণের জন্য আর কোন প্রাণী রইলো না। প্রাণশূন্য পৃথিবী মহাশূন্যে তার দৈনন্দিন ঘুর্ণনে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে রইলো।

দুই.
বহু বছর নিঃসঙ্গ, প্রাণহীন পৃথিবী কক্ষপথে ঘুরেছে। নিঝুম, উদ্ভিদ, প্রাণীর নেই কোন কোলাহল। নেই মানুষের অত্যাচার। কত বছর কেটে গেছে কেউ জানে না। কবে যে সেখানে আবার নতুন প্রাণের সঞ্চার হল, তা’ও কেউ বলতে পারে না। তারপর বছরের পর বছর ঘুরে আসে। পৃথিবী আবার ফুলে ফলে ভরে ওঠে। নতুন নতুন গাছগাছড়া, নতুন নতুন প্রাণীর কোলাহলে আবার পৃথিবী নতুনভাবে জেগে ওঠে।

দশ হাজার পর সেখানে উদ্ভব ঘটে এক নতুন বুদ্ধিমান প্রাণী। তখনও তার নাম ছিল না। কে দেবে তাদের নাম। মানুষের মত দেখতে কিন্তু মানুষ নয়। সবই মানুষের মত কেবল তাদের কপালের ওপর একটিমাত্র চোখ। আমরা দু’চোখ দিয়ে যা দেখতে পাই না। তারা একচোখ দিয়ে অনেক বেশি দেখতে পায়। ক্রমে তারা পৃথিবী দখল করে। হিংস্র প্রাণীগুলি তাদের বুদ্ধির কাছে হার মেনে তাদের শাসন মেনে নেয়।

আর্টওয়ার্ক: ডেট্রোয়েট ম্যুরাল

সময় গড়িয়ে চলে। তাদের সংখ্যা ক্রমাগত বাডতে থাকে। তারা সমাজ, সভ্যতা, বড় বড় সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। সৃষ্টি হয় সামাজিক বিভাজন। অধিকাংশ মানুষ উৎপাদনে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও দু’বেলা দু’মুঠো খাবার পায় না। আর মুষ্টিমেয় শাসকশ্রেণী বিলাস-ব্যাসনে সমাজের মাথায় বসে থাকে। তাদের খেদমত করার জন্য একদল মধ্যবর্তী মানুষের সৃষ্টি হয়। তারা শাসক শ্রেণীর সেবা করে বেশ ভালভাবে জীবন যাপন করে। গড়ে ওঠে শিল্প কলকারখানা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-গবেষণাগার, বাজার, যাতায়াত ব্যবস্থা। যা প্রয়োজন তার সব কিছু গড়ে তোলে নতুন পৃথিবীর নতুন শাসকশ্রেণী। মাঠে-ঘাটে-কলকারখানায় হাড্ডিসার মানুষ পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়েও শাসকশ্রেণীর মন ভেজাতে পারে না।

জ্ঞানে বিজ্ঞানে তারা বহু কিছু আবিষ্কার করে। কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনের দুঃখ দূর হয় না। গতরখাটা মানুষগুলো ভিতরে ভিতরে ফুঁসতে থাকে। মাঝে মাঝে অসন্তোষের আগুন জ্বলে ওঠে। তখন শাসকশ্রেণী অনন্ত অসীম আকাশে এক বিরাট উপগ্রহ স্হাপন করল। তার এমন শক্তি যে কেবল কোন বহিঃশক্তি নয়, দেশের মধ্যে গোলমাল সৃষ্টিকারীদের মুহুর্ত নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। শত শত বছর পার হয়ে গেল। মানুষের মনে সেই উপগ্রহটি ঈশ্বরের স্থান গ্রহণ করল। সবাই তাকে স্রষ্টার আসনে বসিয়ে তার পূজোঅর্চনা করতে শুরু করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল সমাজ ও নৃবিজ্ঞানী এবং পুরাতত্ববিদ পৃথিবীর ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছিল।

তিন.
একদল সমাজ বিজ্ঞানী ও পুরাতত্ত্ববিদ পাঁচ বছর গবেষণা পরিচালনার পর একটি পুরানো সভ্যতার সন্ধান পায় যার বয়স দশ হাজার বছর। তারা আবিষ্কার করে যে, তখন অনেক ধরনের প্রাণীর সাথে ‘মানুষ’ নামের এক বুদ্ধিমান প্রাণী বাস করতো। তারাও আজকের মত বিশ্বময় নানা ধরনের সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল। যারা সবচে’ উন্নত মারণাস্ত্র তৈরি করেছে, তারা অন্যসব জাতি, রাষ্ট্র, সংস্কৃতির ওপর আধিপত্য স্থাপন করেছে এবং নতুন এক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। এখনকার মত তখনও সমাজ ছিল ধনী ও দরিদ্রে বিভাজিত। এখনকার মত তখনও মুষ্টিমেয় শাসক শ্রেণী বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে শাসন ও শোষণ করতো। যারা সম্পদ উৎপাদন করতো, তাঁরাই অর্ধভুক্ত থাকতো। তাদের কোন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার ছিল না। শাসকশ্রেণী তাদের সুবিধার্তে আইন তৈরি করতো এবং সবাইকে তা মানতে বাধ্য করা হত। সেসব আইন প্রয়োগের জন্য আদালত, পুলিশ, সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিল।

আর্ট্ওয়ার্ক: আইডেনটিটি
শিল্পী: ভ্লাদিমির কাজানভস্কি
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

সেইসাথে তারা ‘ঈশ্বর’ নামে এক শক্তিশালী আন্তঃবিষয়ী সত্তার ধারণা প্রচার করে, যিনি অসীম ক্ষমতার অধিকারী। তার খেদমত করার জন্য সারা পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ উপাসনালয় গড়ে তোলে এবং সেগুলি দেখভালের জন্য লক্ষ লক্ষ খেদমতগার নিয়োগ করে। তারা সেই  ‘আন্তঃবিষয়ী’ সত্তার প্রতি সমস্ত মানুষের বিশ্বাস ও সভয় শ্রদ্ধা আদায়ে সর্বদা ব্যস্ত থাকতো। শাসক শ্রেণী তাদের সর্বোতভাবে সাহায্য করে। তাদেরও কোন অভাব থাকে না। তারা ‘স্বর্গ-নরকের’ ধারণার সৃষ্টি করে। যারা ঈশ্বরের আদেশ মত চলবে, তাদের জন্য এক অনন্ত আনন্দ-সুখের স্বর্গে যাবে আর যারা বেয়াদবি করবে তারা নরকের অনন্ত লেলিহান আগুনে পুডবে। শাসক শ্রেণীর শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তারা। তাছাড়া উচ্চ শিক্ষিত একদল মানুষের সৃষ্টি হয়। তাদের বলা হত ‘বুদ্ধিজীবী’। তারা নিত্য নতুন দর্শন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি সৃষ্টি ক’রে সমাজ-সভ্যতার প্রভূত উন্নতি সাধন করে। তখনকার শাসকশ্রেণী তাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করে। তাদের বড় বড় পুরস্কার, খেতাবে ভূষিত করে। তারা শাসকশ্রেণীর শাসন টিকিয়ে রাখতে বড় বড় গবেষণা করে, বই-পুস্তক লেখে। এতে শাসকশ্রেণী খুশি হয়। আর যে দু’চার জন বুদ্ধিজীবী বেয়াদবি করে, সত্য প্রকাশ করে, তাদের জন্য কঠোর শাস্তি নির্ধারণ করে। এ রকম বেয়াদব বুদ্ধিজীবীর নামও তারা খুঁজে পেয়েছে। আবিষ্কারের পর গবেষকদল সিদ্ধান্ত নিল যে তারা তাদের গবেষণাপত্রটি প্রধান শাসকের হাতে তুলে দেবেন।

তারা তার সাক্ষাতকারের জন্য আবেদন করল। রাজা মাত্র প্রধান গবেষকের সাথে সাক্ষাতের অনুমতি দিল। সঠিক সময়ে প্রধান গবেষক রাজার দরবারে গেল। তিনি সহাস্যে তাকে আহবান করলেন। তিনি তার গবেষণার বিষয় জানতে চান। গবেষক সব কিছু খুলে বলে। শোনার পর রাজা সহাস্যে তার গবেষণালব্ধ ফলের জন্য বাহবা দিলেন। গবেষকের চেহারা আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠল। তখন রাজা বলেন, ‘দেখ, আজ থেকে প্রায় তিন হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষ মহাশূন্যে ঐ সর্বশক্তিমান মহাকাশযানটি প্রতিস্থাপন করে গেছেন এবং তিন হাজার বছর ধরে পৃথিবীর সব মানুষ তা সাগ্রহে বিশ্বাস ক’রে গ্রহণ করেছে। তোমাদের এই গবেষণালব্ধ ফলাফল যদি প্রকাশ করো, তাহলে তার পরিণাম কী হতে পারে?’ গবেষকের প্রশ্নবোধক চেহারার দিকে চেয়ে রাজা বলেন, ‘তোমার এই সত্য কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। বরং তারা মিছিল ক’রে আমার কাছে আসবে তোমার বিচারের জন্য। তখন আমি কী করবো? শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে আমাকে তো কিছু করতেই হবে। জনগণ তোমাদের মৃত্যুদণ্ড চাইতে পারে। তাদের চাপের মুখে আমাকে কিছু করতেই হবে।’ গবেষক বলে, ‘তাহলে কি সত্য প্রকাশ করা যাবে না?’ রাজা বলেন, ‘তোমার ইচ্ছা হলে তুমি তা প্রকাশ করতে পার। কিন্তু তার দায়ভার তোমাকেই নিতে হবে। তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সমাজবিজ্ঞানী। আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে আমাকে তোমার বিচার করতে হবে। আদালত কী রায় দেয়, তা তো আমি জানি না। আমাকে সেইমত ব্যবস্থা নিতে হবে।’

আর্টওয়ার্ক: সেল্ফ এক্লোজার
শিল্পী: এলিনা
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

একথা শুনে গবেষক নীরব হয়ে যান। কিছুক্ষণ নীরবতার পর রাজা বললেন, ‘দেখ, তোমাকে আমি ভালবাসি। তাই তোমার সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুবিধার্তে আমি দু’টি বিকল্প রাস্তার কথা বলবো। যেটি ইচ্ছা গ্রহণ করার তোমার পূর্ণ অধিকার আছে।’ উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে গবেষক রাজার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। রাজা বললেন, ‘এক, তুমি সত্য প্রকাশ করো এবং তার পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকো এবং দুই, তুমি ফাইলটি আমাকে দাও। বদলে তুমি গবেষণার জন্য যত টাকা প্রয়োজন তুমি পাবে। লক্ষ-কোটি যত চাও, তোমার সহকর্মীদের নিয়ে আরো উন্নত গবেষণা পরিচালনা করো। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কারে তোমাকে ভূষিত করা হবে। সমগ্র পৃথিবী তোমার জয়গান করবে। তুমি ঠিক করো তুমি কোনটা গ্রহণ করবে।’ গবেষক কিছু সময় নিস্তব্ধ থেকে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করলেন। ঘড়ির কাঁটার শব্দ যেন গর্জন করছে। রাজা ঠোঁটের কোনায় এক টুকরো মৃদু হাসি ধরে রেখে তার সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। তারপর গবেষক নিরবে ফাইলটি রাজার হাতে তুলে দিল। রাজা সহাস্যে সেটি নিয়ে বললেন, ‘এই তো তুমি সুন্দর সিদ্ধান্ত নিলে। তুমি তো জান যে দশ হাজার বছর আগে সত্য কথা বলে কতজনকে প্রাণ দিতে হয়েছে। আমি চাইনি তুমি তাদের পথ বেছে নাও।’ একথা বলে রাজা দশ কোটি টাকার একটি সিলমোহর গবেষকের হাতে তুলে দিলেন।

গবেষক সেটি নিয়ে সালাম জানিয়ে বেরিয়ে এল। সত্যি কিছুদিনের মধ্যে তার খ্যাতি সমগ্র বিশ্ব ছডিয়ে পড়ল। একদিন রাজা এক বিরাট সম্বর্ধনার মাধ্যমে পৃথিবীর সর্বোচ্চ সম্মানটি তার গলায় ঝুলিয়ে দিলেন।

শহিদুল ইসলাম

বাংলাদেশের যে মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবী জীবননিষ্ঠ মননের সদনুশীলনে আত্মনিয়োজিত, শহিদুল ইসলাম নিরলস চর্চার মধ্য দিয়ে নিজেকে সেই গোষ্ঠীর অন্যতম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে নিতে পেরেছেন। গত পাঁচ দশক ধরে তিনি লিখছেন। সমাজনীতি, রাষ্ট্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বিজ্ঞানমনস্কতা, শিক্ষা, শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে অনবরত লিখে চলেছেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।

তিনি স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন এক সমাজব্যবস্থার, অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থার যেখানে মানুষ পাবে মানুষের অধিকার। বিষয়গুলো নিয়ে তাঁর গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে। তিনি বিজ্ঞানের দর্শন নিয়েও গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করেন।

শহিদুল ইসলামের জন্ম ১৯৪০ সালে ১০ ফেব্রুয়ারি, পাবনার ঈশ্বরদীতে। তিনি সাঁড়া মাড়োয়ারি উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা, পাবনা এওয়ার্ড কলেজ থেকে আইএসসি, রাজশাহী কলেজ থেকে বিএসসি (অনার্স) এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করেন।

তিনি ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত রসায়ন বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষকদের একজন ছিলেন। ২০০০-২০০৩ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নবপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। ২০১৩-১৫ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু ইনস্টিটিউট অব লিবারেশন ওয়ার অ্যান্ড বাংলাদেশ স্টাডিজ এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। সম্পাদনা করেছেন 'সমাজ ও প্রগতি জার্নাল'।

তাঁর উল্লেখযোগ্য বই: শিক্ষাভাবনা, প্রসঙ্গ শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় ও স্বায়ত্তশাসন, আমরা কি ধরনের শিক্ষা চাই?, বিজ্ঞানের দর্শন, চিন্তার স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস, একাত্তরে বাংলাদেশের অভ্যুদয়, দেশভাগ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, জাতীয়তাবাদ: সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, সাম্প্রদায়িকতা রাষ্ট্র ও রাজনীতি, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ: মিথ ও বাস্তবতা, মৃত্যুহীন প্রাণ, শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধ।

২০১৩ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান।

বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি নিজকে নিয়োজিত করেছেন জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক নানা গবেষণায়।