অরাজ
আর্টওয়ার্ক: দ্য রোলিং ডেথ শিল্পী: ফারহানা ইয়াসমিন সূত্র: ফেসবুক
প্রচ্ছদ » ইসাবেল ফ্রে।। হার্ড ইমিউনিটি: মহামারির নয়া উদারবাদ

ইসাবেল ফ্রে।। হার্ড ইমিউনিটি: মহামারির নয়া উদারবাদ

অনুবাদ: ইকরামুল হক

ভূমিকা

করোনা মোকাবেলায় লকডাউন ও হার্ড ইমিউনিটি–দুটি পন্থা নিয়ে শুরু থেকেই চলছে তর্ক-বিতর্ক। লকডাউন-কোয়ারেন্টাইন-সামাজিক বিচ্ছিন্নতা নিও লিবারাল শাসনে কি ধরনের বাস্তাবতা নির্মাণ করে; কেমন করে শাসন-প্রণালীর কৃৎকৌশল হিসেবে আত্মীকৃত হয় এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও পুলিশি ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করে তোলে তা এখন বেশ পষ্ট।

অন্যদিকে মুক্ত বাজার ব্যবস্থায় হার্ড ইমিউনিটি মুনাফামুখিন প্রকল্পের নীতির সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ।

বাংলাদেশে আমরা দুই ধাপে এই দুটো পন্থাকেই নীতি হিসেবে প্রয়োগ করতে দেখেছি আমরা। সরকারি হিসেবে যখন অর্ধলাখ মানুষ করোনা আক্রান্ত এবং প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, এমন সময়ে লকডাউন শিথিল করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, করোনার সঙ্গে বসাবাস করতে হবে। উন্নয়নের বাগাড়ম্বড়, সমাজের নিম্নকোটির উপর ভয়ঙ্কর শোষণ এবং এই রাজনৈতিক ব্যবস্থার গণবিরোধী রূপ উন্মোচিত হয়েছে।

হার্ড ইমিউনিটি এবং নিও লিবারালিজমের সম্পর্ক পাঠের ইশারা এই প্রবন্ধ।  প্রবন্ধটি গেল মার্চে The Quarantimes -এ প্রকাশিত হয়। হার্ড ইমিউনিটি কেন এবং কিভাবে মানুষ খেকো মুনাফার স্বার্থে গৃহীত হয়, তা-ই আলোচিত হয়েছে এই প্রবন্ধে।

এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর নেদারল্যান্ড আনুষ্ঠানিকভাবে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার নীতি গ্রহণ করে। পাঠের সময় এটা খেয়াল রাখা দরকার।

আর্টওয়ার্ক: ডেথ বাই ভাইরাস
শিল্পী: গ্রে ওয়াট
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

মূল প্রবন্ধ

কোভিড-১৯ মোকাবেলায় যখন ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ লকডাউনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন ইউরোপের কিছু দেশ ‘হার্ড ইমুনিটি’ নামে  ভিন্ন এক কৌশলের পথে হাঁটছিল। জনগণের মাঝে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং যথাসাধ্য টেস্ট করার ব্যবস্থা না রেখে তাদের লক্ষ্য ছিল অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের মাঝে এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ করে দেয়া, যাতে করে জনগণের একটা বড় অংশের এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সর্বপ্রথম এই হার্ড ইমুনিটির প্রস্তাব উত্থাপন করেন, যিনি বেশ কিছুদিন আগ পর্যন্তও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার পক্ষে ছিলেন না । কিন্তু সেই যুক্তরাজ্য যখন আনুষ্ঠানিকভাবে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা ঘোষণা করে, তখনও নেদারল্যান্ড এবং সুইডেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমালোচনাকে গ্রাহ্য না করে হার্ড ইমিউনিটির পথে হাঁটছিল।

হার্ড ইমুনিটির পক্ষে তাদের যুক্তি ছিল, যেহেতু মহামারির লাগাম পুরোপুরি টেনে ধরা যাবে না এবং যেকোন মুহূর্তে আবার সংক্রমণ ঘটাতে পারে, সেহেতু দীর্ঘমেয়াদি হার্ড ইমিউনিটি হচ্ছে এই ভাইরাসের লাগাম টেনে ধরার একমাত্র উপায়।

পুরো দেশকে লকডাউন রাখার পরিবর্তে তারা যেটা করেছে তা হল বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মানুষকে বাড়ির ভেতরে কোয়ারেন্টাইনে রেখে, কম ঝুঁকিপূর্ণ মানুষকে আক্রান্ত হবার সুযোগ করে দেয়া । যাই হোক, এই নীতিকে অসংখ্য মহামারি এবং জীবাণু বিশেষজ্ঞ সমালোচনা করে বলেছেন যে, এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং অবৈজ্ঞানিক নীতি। এই নীতির কারণে অনেক মানুষের মৃত্যুও ঘটতে পারে। লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের প্রকাশিত গবেষণা রিপোর্টের কারণে ব্রিটিশ সরকার তার হার্ড ইমিউনিটি নীতি থেকে সড়ে আসে, সেই রিপোর্টে বলা হয়েছিল ব্রিটেনে যদি এই নীতি প্রয়োগ করা হয় প্রায় ২,৫০০০০ মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে। এখন ভাইরাস যেভাবে ছড়াচ্ছে চাইলেও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের বাড়িতে আইসোলেসনে রাখা সম্ভব না। উপরন্তু এর ফলে স্বাস্থ্য ব্যাবস্থার উপর ভয়ানক চাপ পড়ার এবং পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে।

মহামারির নয়া উদারবাদ

কেন যুক্তরাজ্যের মত একটি দেশ এরকম ঝুঁকিপূর্ণ নীতি শুরুতে নেয়ার চিন্তাভাবনা করেছিল এবং কেন কিছু কিছু দেশ এখনো এই নীতি মেনে চলছে? এর কারণটা হচ্ছে নিও লিবারেলিজম । আশির দশক থেকে, আমরা নিও লিবাররেলিজমের রাজনৈতিক প্যারাডাইমের দ্বারা শাসিত হচ্ছি, যেটা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় স্বীকৃত সামাজিক নীতিগুলোর স্থলে বেসরকারিকরণ এবং অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যাবস্থা চালু করেছে। এর বিশ্বাস হল যে, বাজারের অন্তর্নিহিত ন্যায়ই একটি রাজনৈতিক যুক্তি গঠন করতে পারে, যা আক্ষরিক অর্থে মুনাফার প্রশ্নটিকে জনগণের সামনে আনে। মননের উপর এর উপনিবেশিক দখল মানুষের মাথায় এই ধ্যান-ধারণা ঢুকিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছে যে, মানুষ তার নিজের দোষে গরিব কিংবা কর্মহীন থাকে।

আর্টওয়ার্ক: মডার্ন টাইম
শিল্পী: অ্যান্টোনিও রদ্রিগেজ
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

নিও লিবারেলিজমের বিড়ম্বনা হল, এটা সমাজের গতিশীলতার একটা বিভ্রম তৈরি করার মধ্য দিয়ে সামাজিক বৈষম্যের পুনরুত্থান ঘটায়। এটি ধরে নেয়া হয় যে, মুক্ত বাজারে যে কেউ এর প্রয়োগ ঘটাতে পারে, আর এতে করে দারিদ্র হয়ে পড়লে সেটা তার নিজের দোষ।

কিন্তু এই ধারণাটা শুধুমাত্র বানোয়াটই না, রীতিমত একটা উগ্রতা। নিও লিবারেলিজমের ফলে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে, গরীবরা আরও গরীব হচ্ছে। এটা একদিকে যেমন গরীবের উপর কাঠামোগত সহিংসতাকে উস্কে দিচ্ছে, একই সাথে তাদেরকে সেই সহিংসতার বিরুদ্ধে যেকোন প্রকার প্রতিরোধের চেষ্টাকে বাধা প্রদান করছে।

হার্ড ইমিউনিটি হচ্ছে মহামারির নিও লিবারেলিজম। অনেকটা মুক্ত বাজার অর্থনীতির উপর শর্তহীন বিশ্বাসের মত, হার্ড ইমিউনিটি এই অনুমানের উপর ভর করে চলছে যে, একটা মহামারি থেকে উত্তরণের সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে এর উপর কোন প্রকার নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা না করা। কিন্তু নিও লিবারেলিজম মতোই, এই হার্ড ইমিউনিটি নীতির কারণে অসহায়, গরীব, বাস্তুহারা, বয়স্ক, শারীরিকভাবে অসমর্থ, উদ্বাস্তু এবং অসুস্থ মানুষদের উপর অবর্ণনীয় দুর্ভোগ নেমে আসবে। এই নীতির কারণে পরিস্কারভাবে নিম্ন আয়ের মানুষের বিপদে পড়বে। কারণ অসুস্থ হওয়ার সাথে আর্থ সামাজিক অবস্থার একটা সম্পর্ক রয়েছে। যদি রোগীর চাপ সামাল দিতে না পেরে স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা ভেঙ্গে পড়ে তাহলে এই শ্রেণির মানুষেরা সবচেয়ে বেশি কোভিড-১৯ এর মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়বে।

ভঙ্গুর কল্যাণ রাষ্ট্র  ব্যাবস্থা

ইউরোপের দুইটা গুরুত্বপূর্ণ নিও লিবারেল রাষ্ট্র হল যুক্তরাজ্য এবং নেদারল্যান্ড, যে দেশ দুইটি এই হার্ড ইমিউনিটির পক্ষে ছিল এবং এটা মোটেই কোন দৈবক্রম ঘটনা না। গত কয়েক দশক ধরে এই রাষ্ট্রগুলো নিওলিবারেল পলিসি বাস্তবায়ন করার পিছনে যথেষ্ট সময় ব্যয় করেছে। পরিকল্পনামাফিক ভাবে তারা বাসস্থান, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় সংকোচন করেছে। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকর লকডাউন পলিসির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার সাথে তাদের এই রাজনৈতিক অবস্থানের একটা সুসামঞ্জস্য আছে। যাই হোক কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সুইডেনের অবস্থান একটা ধোঁয়াশার মধ্যে আছে: সুইডেন এমন একটা রাষ্ট্র যেটা তার ভালো সামাজিক এবং কল্যাণমূলক রাষ্ট্রনীতির জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত। কিন্তু সুইডেনের মতো এতো চমৎকার সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক রাষ্ট্র পর্যন্ত নিও লিবারেল পলিসি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি। ইউরোপের বেশিরভাগ দেশের মতো, কল্যাণরাষ্ট্রগুলোও গত কয়েক দশকে তার নীতি থেকে দূরে সরে এসেছে।

করোনা মহামারিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ‘কার্ভ কে শুইয়ে দেয়া’ যাতে করে গুরুতর এবং নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রগুলোতে ধারণ ক্ষমতার চাইতে বেশি রোগী উপচে না পড়ে। কিন্তু এই তিন দেশে গুরুতর রোগীদের পরিচর্যা করার সক্ষমতা এতো কম যে, কড়া লকডাউন দিয়েও রোগীর চাপ সামাল দেয়া যাচ্ছে না। যুক্তরাজ্য এবং নেদারল্যান্ডে জনপ্রতি বেডের সংখ্যা ইতালির চেয়ে কম এবং সংখ্যায় সেটা ইতালির অর্ধেক। সুইডেনকে মনে করা হয় ইউরোপের অন্যতম সেরা কল্যাণ রাষ্ট্র, সেখানেও বেডের সংখ্যা ইতালির অর্ধেকেরও কম।

আর্টওয়ার্ক: থ্রি মাস্ক
শিল্পী: হাসান ব্লেবেল
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

যদি এই রাষ্ট্রগুলো হাসপাতালগুলোতে রোগীর উপচে পরা ভিড় সামাল দিতে চাইত, সেক্ষেত্রে তাদের অনেক আগে থেকেই এটা নিয়ে কাজ করতে হত। কিন্তু ইতোমধ্যেই সেই প্রস্তুতির জাহাজ বন্দর ছেড়ে চলে গেছে। লকডাউন ব্যবস্থাপনা শুধুমাত্র অর্থনীতির উপর চাপ তৈরি করেনি, এটা একই সাথে গত কয়েক দশক ধরে চলে আসা নিও লিবারেল পলিসির কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্য খাতের ভঙ্গুর দশাকে উন্মোচিত করেছে। এখন হার্ড ইমিনিটি একটা ব্যর্থ সরকারের উপর দায় না চাপিয়ে স্বাস্থ্য খাতের ব্যর্থতার উপর দায় চাপিয়ে দিয়ে সরকারের দায়মুক্তির একটা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। যেমনটা দেখা যায় ব্যক্তির দরিদ্রতার জন্য বেশি পরিশ্রম না করাকে এবং অসুস্থ হওয়ার জন্য কোয়ারেন্টাইন বিধি না মানাকে দায়ী করা হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষের মৃত্যুর জন্য সরকারকে দায়ী করা যাচ্ছে তার আগ পর্যন্ত প্রকৃতি , ভাগ্য কিংবা ব্যক্তির নিজের দোষ কোনটাই বিবেচ্য বিষয় না।

হার্ড ইমিউনিটি শুধুমাত্র অপবিজ্ঞান বা অপনীতিই নয়, এটা একটা জীববৈজ্ঞানিক যুদ্ধক্ষেত্র। অনেক মানুষ শুধুমাত্র এই নীতির কারণে মার যাবে এবং সরকার এর কোন দায় নিবে না। কিন্তু মানুষ মারার এই কৌশল যে এই প্রথম চালু হয়েছে সেরকমটা না। গত কয়েক দশক ধরে বিশ্ব যে রাজনৈতিক ভাবাদর্শ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে এটা তারই একটা অংশ, যে ভাবাদর্শ এসেছে কট্টর মুক্তবাজার সামাজিক ডারউইনবাদ থেকে। কারণ যে মানুষ অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থার উপর আস্থা রাখতে পারে সে অনিয়ন্ত্রিত মহামারির উপরও আস্থা রাখতে পারবে  রাখবে-এমনকি এর ফলে যদি মানুষের মৃত্যুও ঘটে।

ইকরামুল হক